মহান সৃষ্টিকর্তা কী অপূর্ব রূপে এই ধরণীকে অলঙ্কৃত করেছেন, তা আমরা কতোটা ভাবি! বনানী, পুষ্প, পাখি, পশু, নদী ও নীলাকাশ—প্রতিটি স্তরে যেন এক অপার সুষমা বিরাজমান। এই দৃশ্য দেখে মানুষের হৃদয়ে জেগে ওঠে শ্রদ্ধা, বিস্ময় ও আত্মবোধ— আমরা কত ক্ষুদ্র! কত অসহায়! এবং এই ক্ষুদ্রত্বই যেন আমাদের সত্যিকার মহত্ত্বের দিকে ঠেলে দেয়। মহাকবি গ্যেটে বলেছিলেন, ‘মানুষ বাইরে দেখতে পায় তাই, যা তার হৃদয়ের অন্তঃস্থলে বিদ্যমান।’ সুতরাং যার হৃদয় কল্যাণে পূর্ণ, বাইরের জগতও তার নিকট এক সুশোভিত উদ্যান বলে প্রতিভাত হয়।
মানুষ চায় তার চিহ্ন রেখে যেতে— মহাকালের গভীরে। এক বাঙালি মনীষী বলেছিলেন, ‘জন্মেছিস যখন দাগ রেখে যা।’ এই দাগ বা চিহ্নই হলো ‘সুকীর্তি’। তবে তা খুব সহজ নয়। বিশেষ করে, ইতিবাচক ভাবমূর্তির ভেতর দিয়ে সমাজ-রাষ্ট্রে মহীয়ান হওয়া খুব সহজ নয়! আমরা জগতের চারিদিকে দেখছি কত ধরনের যুদ্ধ বিগ্রহ, হানাহানি, বিভিন্ন অস্ত্রের চোখ রাঙানি। কিন্তু আমরা কেউ কি চিরকাল বেঁচে থাকতে পারব? মুশকিল হলো— যারা বিপুল ক্ষমতাশালী হয়ে যান— তাদের মনোজগৎ যেন অন্যরকম হয়ে যায়। ক্ষমতার অতিউষ্ণ প্রতাপে অনেকেই মনে করেন, তারা যেন অমর! কিন্তু তারা যদি প্রতিক্ষণ স্মরণে রাখতেন—রাতে ঘুমোতে যাচ্ছি, সেই ঘুমই শেষ ঘুম হতে পারে; যেই খাবারটা খাচ্ছি— সেই খাবারটাই শেষ খাবার হতে পারে। আমরা যেখানেই থাকি না কেন, মৃত্যু আমাদের নাগাল পাবেই; যদি আমরা কোনো শক্ত ও সুদৃঢ় দুর্গে অবস্থান করি, তবুও মৃত্যুর হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পারব না। মহান আল্লাহ তায়ালা আমাদের মৃত্যুর সময়ও ঠিক করে দিয়েছেন।
মুশকিল হলো, ক্ষমতাবানরা ভুলে যান ধর্মের কথা, জগতের পরম সত্যকথা। তারা যদি এই সত্য সর্বদা মনে রাখতেন, তাহলে পৃথিবীর ইতিহাসও আজ অন্যরকম হতে পারত। হাজার হাজার বছর ধরে অসভ্য অবস্থা থেকে মানুষ যতই সভ্য হয়ে উঠুক না কেন— ‘মানুষ মানুষের জন্য’— এই সত্যটি সবচাইতে বেশি উপেক্ষিত থেকেছে।
ইতিহাস বলে দেয়, অধিকাংশ মানুষই অমরত্বের বাসনায় নিজস্ব লাভ, ক্ষমতা ও প্রতিপত্তির পেছনে ধাবিত হয়ে পড়ে। অথচ সুকীর্তির মূলে রয়েছে আত্মত্যাগ, জনকল্যাণ ও সতত অহিংসা। একবার এক শিষ্য গুরুদেবকে প্রশ্ন করল— ‘হে প্রভু, অমর হওয়ার উপায় কী?’ গুরু বললেন— ‘তুমি যদি মানুষের হৃদয়ে স্থান করতে চাও, তাহলে মানুষের উপকার করো। তা-ই অমরত্ব।’ এই ব্যাপারে একটি ছোট্ট নৈতিক কাহিনি স্মরণ করা যেতে পারে। এক ব্যক্তি প্রতিদিন নদীর ধারে দাঁড়িয়ে একেকটি মৃতপ্রায় মাছকে জলে ফিরিয়ে দিত। এই ঘটনা দেখে আরেকজন বলল, ‘তুমি তো আর হাজার হাজার প্রাণ রক্ষা করতে পারবে না— এটুকু করে কী হবে?’ সে তখন জবাব দিল— ‘এই একটা প্রাণ তো বাঁচল!’ এটাই হলো সুকীর্তির বীজ—প্রত্যেকটি ক্ষুদ্র কর্ম— যদি তা ন্যায়ের পক্ষে হয়, তার অন্তরালে থাকে এক মহান তাৎপর্য।
বস্তুত, সুকীর্তির মধ্যেই রয়েছে অমরতা। আর সেই কারণে খ্রিস্টীয় পণ্ডিত থমাস ক্যাম্পবেল বলেছিলেন, ‘আমরা যাদের হৃদয়ে বেঁচে থাকি, প্রকৃতপক্ষে তা-ই অমরত্ব; এটা মৃত্যু নয়।’ সুতরাং, আমরা যদি চাই এই পৃথিবীকে আরও সুন্দর, আরও সহিষ্ণু, আরও মানবিক করতে, তাহলে সুকীর্তিকে আমাদের জীবনের চরম ব্রত করতেই হবে— এর কোনো বিকল্প নেই।
আমরা যা কিছু করি না কেন—তাতে যেন থাকে মানুষের কল্যাণ। কারণ, মহাকাল শুধুই মনে রাখে—করেছিল কল্যাণ, আর কে চালিয়েছিল অমানবিকতার কৃপাণ। অতএব, সুকীর্তিই হোক আমাদের লক্ষ্য। তা হবে নীরব অমরত্বের এক অনির্বাণ শিখা— যা মহাকালের গর্ভে অহর্নিশ জ্বলতেই থাকে।