স্বাস্থ্যই জীবনের সবচেয়ে বড় সম্পদ। এই সম্পদ রক্ষা করতে হলে যেমন প্রয়োজন সচেতনতা, তেমনি প্রয়োজন মানসম্মত চিকিৎসা ও নিরাপদ ওষুধ। আশার কথা, বাংলাদেশে ওষুধশিল্প আজ এক সম্ভাবনাময় খাত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। দেশীয় কোম্পানিগুলো দেশের ৯৮ শতাংশ ওষুধের চাহিদা পূরণ করার পাশাপাশি বিশ্বের প্রায় ১৫০টিরও বেশি দেশে রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে। কিন্তু এই অর্জনের আড়ালে যে অন্ধকার ক্রমশ গভীর হচ্ছে, তা হলো ভেজাল ও নকল ওষুধের ভয়াবহ বিস্তার।
ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের তথ্যমতে, দেশে তালিকাভুক্ত ৩০২টি ওষুধ কোম্পানির মধ্যে নিয়মিত উৎপাদনে আছে মাত্র ২২৯টি। এর মধ্যে বাজারে প্রচলিত কেবল ২০-২৫টি কোম্পানির ওষুধ, যাদের গুণমান ও নির্ভরযোগ্যতা বিশ্ব জুড়ে স্বীকৃত। অথচ গ্রাম-উপজেলা পর্যায়ে ছড়িয়ে পড়েছে অসংখ্য নাম-না-জানা প্রতিষ্ঠানের নকল, নিম্নমানের ও ভেজাল ওষুধ। আশঙ্কার বিষয় হলো—দেশীয় বাজারে ভেজাল ও নকল ওষুধের বার্ষিক বাণিজ্য প্রায় ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকারও বেশি। সম্প্রতি দৈনিক জাতীয় ইত্তেফাক পত্রিকার প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে বাজারজাত হওয়া ওষুধের প্রায় ৪০ শতাংশই ভেজাল বা নকল।
এই ভেজাল ওষুধ কেবল রোগ নিরাময়ে ব্যর্থ নয়, বরং রোগীর জীবন ঝুঁকির মুখে ঠেলে দেয়। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে, যেখানে প্রশাসনিক তদারকি নগণ্য, সেখানে এই ভেজাল ওষুধ যেন এক নীরব মৃত্যুর ফাঁদ। অ্যান্টিবায়োটিকের নামে বাজারে প্রচলিত ভেজাল ওষুধ শরীরে ওষুধপ্রতিরোধী জীবাণু তৈরি করে, যা ভবিষ্যতে ভয়াবহ স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণ হতে পারে। আরো ভয়াবহ সত্য হলো—ক্যানসার, ডায়াবেটিস, হৃদেরাগসহ বিভিন্ন জটিল রোগের ভেজাল ওষুধ রোগীকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়। এমনকি গর্ভবতী মায়েদের ক্ষেত্রেও এসব নকল ওষুধ প্রাণঘাতী হতে পারে।
দেশে বাজারজাত হওয়া ওষুধের প্রায় ৪০ শতাংশই ভেজাল বা নকল। এই ভেজাল ওষুধ কেবল রোগ নিরাময়ে ব্যর্থ নয়, বরং রোগীর জীবন ঝুঁকির মুখে ঠেলে দেয়। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে, যেখানে প্রশাসনিক তদারকি নগণ্য, সেখানে এই ভেজাল ওষুধ যেন এক নীরব মৃত্যুর ফাঁদ।
কেন এই অবস্থার সৃষ্টি? এর প্রধান কারণ হলো—অসাধু ব্যবসায়ীদের মুনাফালোভ, ঔষধ প্রশাসনের দুর্বল নজরদারি এবং আইন প্রয়োগে শিথিলতা। মাঝেমধ্যে ভ্রাম্যমাণ আদালত কিছু অভিযান চালায় বটে, তবে তা বেশির ভাগ সময়েই সামান্য জরিমানায় সীমাবদ্ধ থাকে। অথচ এই অপরাধ দমন করতে হলে প্রয়োজন কঠোর আইন প্রয়োগ, অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি এবং প্রশাসনিক কঠোরতা।
এখানে ভোক্তার ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ। মানুষ যদি সচেতন না হয়, যদি স্বীকৃত ফার্মেসি থেকে ওষুধ না কেনে, তবে এই সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। চিকিৎসকদেরও উচিত, প্রেসক্রিপশন দেওয়ার সময় নির্ভরযোগ্য কোম্পানির নাম উল্লেখ করা এবং রোগীদের সঠিক উৎস থেকে ওষুধ কেনার পরামর্শ দেওয়া।
অতএব, ভেজাল ওষুধবিরোধী লড়াই যেন কেবল সরকারের দায়িত্ব নয়, এটি হতে হবে প্রশাসন, চিকিৎসক, ওষুধশিল্পসংশ্লিষ্ট এবং জনগণের সম্মিলিত প্রচেষ্টার বিষয়। প্রশাসনকে শক্তিশালী করা, পরীক্ষাগারসুবিধা বৃদ্ধি, কঠোর শাস্তির বিধান এবং সর্বোপরি জনসচেতনতা বাড়ানোই পারে এই ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে আমাদের পরিত্রাণ দিতে। জনস্বাস্থ্যের এই নীরব ঘাতক—ভেজাল ও নকল ওষুধের ছড়াছড়ি অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে, নইলে এই অদৃশ্য বিপর্যয় আমাদের জাতির স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে চরম সংকটে ফেলতে পারে।
লেখক : শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
(এই লেখা লেখকের একান্ত ব্যক্তিগত অভিমত; এ সংক্রান্ত কোনো দায় দৈনিক মূলধারা বহন করবে না)