মাইরের ওপর ওষুধ নাই—এই আপ্তবাক্যটি আমাদের প্রজন্ম হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করেছে। এটি কেবল একটি প্রবাদবাক্য ছিল না, ছিল আমাদের শৈশবের অলিখিত সংবিধানের প্রথম অনুচ্ছেদ। যে কোনো সমস্যা, যে কোনো অন্যায়ের একমাত্র সমাধান ছিল ‘মাইর’।
আর এখনকার প্রজন্ম? কী নরম, কী তুলতুলে! তাদের বাবা-মায়েদের মুখে কেবল একটাই বুলি, ‘আমার সোনা, আমার মানিক!’ যা চায়, চোখের পলকে হাজির। মার নেই, বকা নেই, কেবল আদর আর আদর! কে না জানে যে অতি আদরে ছেলেপেলেরা বাঁদর হয়ে যায়? আর এই ‘পুতুপুতু’ প্রজন্মকে যখন আমাদের ছেলেবেলার গল্প শোনাই, তখন তাদের চোখ ছানাবড়া হয়ে যায়। তারা কল্পনাও করতে পারে না, এককালে আমরা কত কত তুচ্ছ কারণে মার খেতাম!
তবে এখন চিত্রটা আরো জটিল। একদিকে যেমন পুতুপুতু একটি প্রজন্ম তৈরি হচ্ছে, ঠিক তার পাশেই মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে এক ভয়ংকর নতুন প্রজন্ম। এরা এতটাই বেপরোয়া যে, কারো কথা শোনে না, কোনো নিষেধ-বারণ মানে না, এমনকি কাউকে ভয়ও পায় না। দলবদ্ধভাবে এরা পরিচিতি পেয়েছে কিশোর গ্যাং নামে। দেশের আনাচে-কানাচে আজ তাদের তৎপরতা ছড়িয়ে পড়েছে। এই গ্যাংয়ের সদস্যরা দলবদ্ধভাবে নেশা করে, নানা অপরাধমূলক কাজ করে, এমনকি কাউকে পছন্দ না হলে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতেও দ্বিধা করে না। তাদের এই ভয়ংকর কার্যকলাপ দেখে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও রীতিমতো চিন্তিত। আর অভিভাবকরা তো তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে হতাশ ও বিচলিত। এই কিশোরদের ওপর যেন কারো কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। এদের কর্মকাণ্ড দেখলে নিজেদের বাল্যকালের কথা মনে পড়ে। আমরা তো সামান্য দুষ্টুমি করারও সুযোগ পাইনি, অথচ এরা অবলীলায় বড় বড় চাপাতি হাতে নিয়ে মহড়া দেয় এবং প্রকাশ্যে ছিনতাই করে। এদের দেখার কেউ নেই। না পরিবার না আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এই কিশোর গ্যাং ভয়ংকর হয়ে ওঠার পেছনে অনেক কারণ আছে। তবে পরিবার থেকে মাইরের চর্চা পুরোপুরি উঠে যাওয়ার পেছনে এর ভূমিকা কিছুটা থাকলেও থাকতে পারে। ‘কর্পোরাল পানিশমেন্টের বিপক্ষে’ যারা তারা হয়তো এই কথা শুনে তেড়ে আসবেন। কাজেই নিজেদের বাল্যকালের কাহিনি বলাটাই এক্ষেত্রে সবচেয়ে নিরাপদ!
আমরা বিচিত্র কারণে মার খেতাম। কাঁদলেও মার, না কাঁদলেও মার! আসলে আমাদের ছেলেবেলায় মার খাওয়ার কোনো নির্দিষ্ট কারণ ছিল না, এর প্রকারভেদ ছিল বিচিত্র। ধরা যাক, মার খাবার পর আপনি কাঁদতে শুরু করলেন। ব্যস, সঙ্গে সঙ্গে আরেক দফা মার, কারণ ‘কাঁদিস কেন বেয়াদব, বেশি লেগেছে বুঝি?’ আবার ধরুন, মার খেয়ে আপনার চোখে জল এলো না, আপনি হয়তো ভেতরে ভেতরে কষ্ট চেপে রাখলেন। ওমা! তাতেও বিপদ! ‘মার খেয়েও কাঁদিস না? ঢং করছিস, নাকি খুব বেশি তেড়ে গেছিস?’ এই বলে আবার মার। শুধু মার খেয়েই নয়, না মারা সত্ত্বেও কান্নাকাটি করলে তো কথাই নেই, নির্ঘাত আপনার পিঠে দু’ঘা পড়ত ‘মিথ্যা কান্নার’ অভিযোগে।
খেলার প্রতি আমাদের এক অদ্ভুত টান ছিল। খেলতে গিয়ে সময় জ্ঞান থাকত না। যদি খেলা নিয়ে বেশি মেতে থাকতেন, সন্ধ্যা নামার আগে বাড়ি না ফিরতেন, তবে কপালে মার অবধারিত। এখনকার কিশোর গ্যাংয়েরা যে দলবেঁধে গভীর রাত পর্যন্ত বাইরে থাকে, তার ফল যদি আমাদের সময়ে ভোগ করতে হতো, তাহলে কী যে অবস্থা হতো! আবার ধরুন, খেলতে গিয়ে নিজেই মার খেয়ে এলেন, তখনো মার; কারণ ‘মার খেয়ে আসিস কেন? তোর কি হাত-পা নেই?’ তার চেয়েও বড় বিপদ ছিল যদি খেলতে গিয়ে কাউকে মেরে আসতেন। সেক্ষেত্রে ‘অমুকের ছেলেকে মারলি কেন?’ এই বলে আপনার ওপর লাঠির বাড়ি পড়ত। আর মজার ব্যাপার হলো, মারামারি করে হেরে এলে যেমন মার খেতাম, তেমনই কাউকে বেশি করে পিটিয়ে এলেও মার জুটত। কী বিচিত্র বিচার! আমাদের রাষ্ট্র বুঝি সেখান থেকেই শিখেছে!
আমাদের সময়ে গুরুজনদের প্রতি ছিল এক ধরনের অলিখিত সামরিক শৃঙ্খলা। বড়দের কথার উত্তর না দিলে মার খেতাম, কারণ ‘কিরে, কানে শুনিস না?’ আবার যদি বড়দের কথায় ত্যাড়া উত্তর দিতেন, তবে তো কথাই নেই, ‘বড়দের সঙ্গে তর্ক করিস?’ বলে জুটত চড়-থাপ্পড়। এখনকার কিশোর গ্যাংগুলো তো গুরুজনদের ধমকানো তো দূরের কথা, প্রকাশ্যেই তাদের বিরোধিতা করে। কেউ উপদেশ দেওয়ার সময় গুনগুন করে গান করলে বা বিড়বিড় করে পড়লে তেড়ে আসত কড়া ধমক। আর বাড়িতে অতিথি এলে বা কারো বাড়ি গিয়ে নমস্কার/সালাম না দিলে কপালে কী জুটত, তা বলাই বাহুল্য!
খাবার-দাবার নিয়েও আমাদের জীবন ছিল বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। অতিথি এলে তাকে খাবারের প্লেট দিতে গিয়ে প্লেট থেকে খাবার মুখে দিতে গিয়ে ধরা পড়লে, সে ছিল এক চরম কেলেঙ্কারি! মার তো খেতেই হতো, সঙ্গে ‘বেয়াদব, পেটুক!’ খেতাব ফ্রি। অতিথিরা খাওয়ার সময় খাবারের দিকে হা করে তাকিয়ে থাকলে, আপনার চোখ তুলে নিত বড়রা। ‘হাভাতে কোথাকার! হা করে তাকিয়ে আছিস কেন?’ এই ছিল তাদের প্রশ্ন। আবার, খেতে না চাইলে মার, কারণ ‘খেতে চাস না কেন? শরীর খারাপ করবি?’ আর বেশি সময় নিয়ে বা বেশি দ্রুত খাওয়া-দাওয়া করলে, দুটোতেই বিপদ!
সকালে ঘুম থেকে উঠতে না চাইলে, রাতে ঘুমোতে দেরি করলে, শীতকালে গোসল করতে না চাইলে কিংবা গ্রীষ্মকালে বেশিক্ষণ ধরে গোসল করলে, প্রতিটি ক্ষেত্রেই অপেক্ষা করত শাস্তি। যেন আমরা এক স্বাস্থ্য পরীক্ষার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি, যার সামান্য বিচ্যুতির ফল ছিল মার।
লেখাপড়ার ক্ষেত্রেও কোনো ছাড় ছিল না। জোরে উচ্চারণ করে না পড়ে চুপচাপ বসে পড়ার ভান ধরলে বা বিড়বিড় করে পড়লে, শিক্ষকের কাছে মার খেতাম। পড়ার বইয়ের মধ্যে গল্পের বই রেখে পড়ার সময় ধরা পড়ে গেলে তো কথাই নেই! পরীক্ষার আগে টিভি দেখা ছিল এক ঘোরতর অপরাধ, আর পাশের বাসার কেউ পরীক্ষায় বেশি নাম্বার পেলে, আমাদের কপালে জুটত কপাটের মার। খাতার পৃষ্ঠা নষ্ট করলে বা বই দাগাদাগি করলে, আপনার পিঠে পড়ত বেতের বাড়ি।
আমাদের জীবনে মার খাওয়ার কারণের শেষ ছিল না। দুধ খেতে না চাইলে, আচার চুরি করে খেলে, অন্যের গাছ থেকে আম, জাম, পেয়ারা পেড়ে খেলে, প্রতিটিই ছিল মার খাওয়ার কারণ। সবচেয়ে মজার কারণ ছিল, ‘উষ্ঠা’ অর্থাত্ হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলে! উঠে দাঁড়ানোর পর আরেক দফা মার জুটত এই অপরাধে যে, ‘চোখে দেখে চলতে পারিস না?’ কারো বাসায় বেড়াতে গিয়ে নিজের বাসা মনে করে লন্ডভন্ড করলে, বাড়ি ফিরে আপনাকে কঠিন জবাবদিহি করতে হতো। স্কুলের সামনের কোনো দোকান থেকে বাকিতে কিছু খেলে বা খেলনা কিনলে, সে খবর বাড়িতে পৌঁছলে, আপনার খবর হয়ে যেত। আর দুপুরে না ঘুমালে তো বলাই বাহুল্য!
আমাদের জীবন ছিল এক নিদারুণ সংগ্রামের মঞ্চ। এখনকার পুতুপুতু ছেলেমেয়েরা হয়তো ভাববে, এত মারের মধ্যে আমরা কীভাবে টিকে ছিলাম? তবে মজার ব্যাপার হলো, এইসব মারধরের পরও আমরা হাসিখুশি ছিলাম, আমাদের শৈশব ছিল আরো প্রাণবন্ত, আরো স্মৃতিময়। কারণ, ঐ মারগুলোই আমাদের মানুষ করেছিল, বুঝিয়েছিল জীবনের কঠিন বাস্তবতা।
আজকের প্রজন্ম কি আমাদের এই ‘রোমহর্ষক’ ছেলেবেলার গল্প শুনে নিজেদের ‘পুতুপুতু’ স্বভাব পরিবর্তন করতে চাইবে? নাকি তারা তাদের আরামদায়ক জীবনযাত্রাতেই খুশি থাকবে, যা শেষ পর্যন্ত কিশোর গ্যাংয়ের মতো সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হচ্ছে?
আগে আমরা মাইর খেয়ে মানুষ হয়েছিলাম, এরা মাইর না খেয়ে দানব হয়ে যাচ্ছে। এখন দরকার শুধু আরেকটা মাইর, এইবার শুধু বাঁশের না, মানুষ গড়ার মতো মাইর, যা দেবে শিক্ষা, দায়িত্ববোধ আর একটা সুস্থ সমাজের স্বপ্ন।