খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসাকে মানুষের মৌলিক চাহিদা বলা হয়। এই পাঁচটি বস্তু একটার সঙ্গে অন্যটির পরিপূরক। কিন্তু বর্তমানে যুগের পরিবর্তনে উপরিউক্ত পাঁচ চাহিদার সঙ্গে কর্মসংস্থান শব্দটি আরো অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ। মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে গেলে প্রয়োজন টাকা। টাকা আয়ের মূল উত্স চাকরি, ব্যবসা কিংবা অন্য যে কোনো কর্ম। কিন্তু একজন সক্ষম ব্যক্তি যখন কাজহীন বা বেকার হয়ে পড়ে, তখনই তার ও পরিবারের মৌলিক চাহিদাতে আঘাত লাগে। একজনের ইনকামের পথ বন্ধ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কয়েক জনের মৌলিক চাহিদা পূরণে ঘাটতি দেখা দেয়। টাকা থাকলেই তো অন্ন, বস্ত্র বা বাকি চাহিদাগুলো মিটবে। তাই পাঁচটি মৌলিক চাহিদা নির্ভর করছে আয়ের ওপর।
দেশে কর্মসংস্থানের অভাব বহুদিনের। স্নাতক ডিগ্রিধারী লাখো বেকারের আর্তনাদ আত্মহত্যা পর্যন্তে পৌঁছেছে। প্রতি বছর বাড়ছে বেকারের সংখ্যা। বাংলাদেশের প্রধান অভিশাপ বেকারত্ব ও দুর্নীতি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপের তথ্য অনুযায়ী দ্বিতীয় প্রান্তিকে (অক্টোবর-ডিসেম্বর) বেকারত্বের হার বেড়ে ৪ দশমিক ৬৩ শতাংশে। আগের বছর একই সময়ে ছিল ৩ দশমিক ৯৫ শতাংশ। বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী ২০২৩ সালে বেকারের সংখ্যা ছিল ২৫ লাখ ৫০ হাজার থেকে বেড়ে ২০২৪ সালে ২৭ লাখে পৌঁছেছে। কিন্তু বাস্তবিক চিত্র ভিন্ন। বিভিন্ন সংস্থার জরিপে দেশে অর্ধেক শিক্ষিত জনগোষ্ঠী বেকার। কত শিক্ষিত যুবক-যুবতি হতাশায় ও বিষণ্নতায় জীবন কাটাচ্ছে। তাদের নীরব যন্ত্রণা বোঝার মতো যেন কেউ নেই। একসময় তারা হতাশাগ্রস্ত জীবন ত্যাগ করে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়।
অন্যদিকে ব্যাংকঋণের উচ্চ সুদ, ডলারের দামে অস্থিরতা, বৈশ্বিক মন্দাসহ দেশে ব্যাবসায়িক অবস্থার চিত্রও অস্বাভাবিক। ব্যবসা করতে গেলে প্রয়োজন মূলধনের। মূলধনের স্বল্পতা ও চাকরির অনিশ্চয়তায় বহু যুবক-যুবতির জীবননাশ হয়েছে। দেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হওয়ার পর বেকারের সংখ্যায় যুক্ত হয়েছে আরো বহু মানুষের। একদিকে দেশে বেকারের সংখ্যা ভারী, তার সঙ্গে নতুন করে বেকারের তালিকায় যুক্ত হয়েছে অনেকেই। সরকারি- স্বায়ত্তশাসিত-বেসরকারি বহু প্রতিষ্ঠান থেকে ছাঁটাই হয়েছে অসংখ্য কর্মী। অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কর্মহীন হয়ে পড়েছে বহু মানুষ। চট্টগ্রাম, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, সাভার, আশুলিয়াসহ বিভিন্ন স্থানে গার্মেন্টস বন্ধ ঘোষণা করেছে। রপ্তানিমুখী প্রতিষ্ঠান বন্ধ হওয়াতে একদিকে যেমন অর্থনৈতিকভাবে দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, অন্যদিকে বেকারত্বের সংখ্যা ভারী হচ্ছে। রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ও এলসি জটিলতায় অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হওয়ার উপক্রম রয়েছে। একটি গার্মেন্টসে শত থেকে হাজার হাজার কর্মী কাজ করে। একজন কর্মহীন ব্যক্তির সঙ্গে সঙ্গে দিশেহারা হয়ে যাচ্ছে তার পুরো পরিবার। অনেকেই তাদের পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। তাই অনেক পরিবারে নেমে এসেছে হতাশার ছোঁয়া।
বেকারত্ব দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের পথে মারাত্মকভাবে ব্যাঘাত ঘটায়। বিশাল একটি জনগোষ্ঠীকে বেকারের তালিকায় রেখে দেশের অগ্রযাত্রা কখনোই সম্ভব নয়। বেকারত্ব থেকে সৃষ্টি হয় সমস্যা। চুরি-ডাকাতি, মারামারি-হানাহানি, জুয়া, নেশা, মাদক, অবৈধ ব্যবসাসহ নানান অসামাজিক ও অনিয়মের পথ বেছে নেয় অনেকে। অন্যদিকে চাকরিচ্যুত হওয়ার পর একজন স্বাভাবিক মানুষের জীবনে শুরু হয় অস্বাভাবিক গতিবিধি। নানান অপকর্মে লিপ্ত হয়। পরিবারে শুরু হয় অশান্তি। বেকারত্ব দেশ, জাতি, পরিবার ও সমাজের জন্য অভিশাপ। দেশ পরিচালনায় যে বা যারাই থাকুন, তাদের উচিত দেশে নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা। বেকারত্ব দূর করতে রাষ্ট্রীয় ভূমিকা রাখতে হবে। ব্যাবসায়িক পরিবেশ সৃষ্টি ও সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে। কারিগরি শিক্ষাকে গুরুত্ব দিতে হবে। রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়ে কোনো উত্পাদনশীল কলকারখানাসহ কোনো প্রতিষ্ঠান যেন বন্ধ না হয়, সে বিষয়ে দৃষ্টি দিতে হবে। বন্ধ হওয়া কলকারখানা আবার চালুর ব্যবস্থা করতে হবে। চাকরিচ্যুত কর্মীদের পুনরায় বহালের ব্যবস্থা করতে হবে।