প্রতি বছরের মতো এবারও আগামী ৫ জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবস পালিত হবে। জনসচেতনতা সৃষ্টি করাই এর মূল উদ্দেশ্য। সুইডেন সরকারের উদ্যোগে ১৯৭৪ সালেই দিবসটি প্রথম পালিত হয়। এবারের প্রতিপাদ্য—‘ENDING PLASTIC POLLUTION’ অর্থাত্ প্লাস্টিক দ্বারা সৃষ্ট দূষণের সমাপ্তি। এই স্লোগানটি অতি সুন্দর, শ্রুতিমধুর, হূদয় ছুঁয়ে যায়। কিন্তু বাস্তব অতি কঠিন। প্লাস্টিকের ব্যবহার আমাদের সমাজ-জীবনে এমন ওতপ্রোতভাবে জড়িত যে, এক দিনও আমরা এই পদার্থ ছাড়া চলতে পারি না। প্রতি বছরই দিবসটি আলাদা আলাদা শহরে, আলাদা আলাদা প্রতিপাদ্য নিয়ে পালিত হয়। ২০২৩ সালে প্লাস্টিক দূষণ বন্ধের আহ্বানে ‘প্লাস্টিক দূষণ সমাধানে শামিল হই সকলে’ প্রতিপাদ্য নিয়ে সারা বিশ্বে দিবসটি পালিত হয়।
প্লাস্টিক এমন একটা পদার্থ, যা কিনা পেট্রোলিয়াম থেকে তৈরি এবং প্রাকৃতিকভাবে পচে না। এটি সিনথেটিক পদার্থ। পলিমারাইজেশন অর্থাত্ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণা সংযুক্ত করে লম্বা চেন তৈরি করা হয়। ফলে মাটির গুণাবলি শেষ হয় এবং ঐ মাটিতে ফসল হয় না। নদীনালা, খালবিল সব প্লাস্টিকের আস্তরণ তৈরি করে। পানিপ্রবাহ বন্ধ হয়ে যায়। উন্নয়নশীল দেশের সমস্যার অন্ত নেই। আছে অদক্ষ ও কর্মহীন জনসাধারণের চাপ, আছে আইনশৃঙ্খলার অবনতির চাপ। খাদ্যের অভাব দূরীকরণ, উন্নতমানের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত ইত্যাদিসহ অনেক সমস্যা সরকার দক্ষ হাতে ইচ্ছা করলেই সমাধান সহজ হতে পারে। কিন্তু পরিবেশ দূষণ ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত জটিল ও কঠিন, যা কিনা সময়মতো উদ্যোগ না নিলে দেশ তথা মানবজাতি ধ্বংসের মুখে পড়তে পারে। আমার মতে, সবচেয়ে কঠিন হচ্ছে আমাদের মন মানসিকতার পরিবর্তন। আমাদের ভালো থাকার অঙ্গীকার। এই জন্যই বিশ্বব্যাপী পরিবেশ সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে প্রতি বছর ৫ জুন বিশ্বব্যাপী এই দিবস পালিত হয়ে থাকে।
প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় রেখে এই পৃথিবীকে বাসযোগ্য করাই বিশ্ব পরিবেশ দিবসের উদ্দেশ্য। আমাদের প্রধানতম করণীয় বিষয়গুলো হতে পারে মানুষের অভ্যাস পরিবর্তন, প্লাস্টিকের রিসাইকেল করা, রিইউজ করা। যেখানে সেখানে ময়লা আবর্জনা না ফেলা। এজন্য দরকার কঠোর আইন ও তার সঠিক প্রয়োগ।
একটা পরিচ্ছন্ন ও স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ ব্যবস্থা এস ডি জি ‘SUSTAINABLE DEVELOPMENT GOALS’ অর্জনের প্রথম শর্ত। এই পৃথিবীর জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সংকট, প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য অবক্ষয় ইত্যাদি সংরক্ষণ করে মানুষের জন্য এই পৃথিবী বাসযোগ্য করতে না পারলে এসডিজি বাস্তবায়ন অলীক কল্পনা ও অসম্ভব।
২০২০ সালের এক হিসেবে দেখা যায় যে, ৮৬৮,০০০ টন প্লাস্টিক বর্জ্য উত্পন্ন হয়েছে, যার মাত্র ৪ শতাংশ রিসাইকেল করা গেছে। অথচ, ২০৩০ সালের মধ্যে ৩০ শতাংশ জমি ভরাটের কাজে ও ৭০ শতাংশ রিসাইকেল করার পরিকল্পনা আছে। বাসাবাড়ি ও শিল্পে রিসাইকেল বৃদ্ধি করা হচ্ছে। মুম্বাইয়ের ভারসোভা সমুদ্রসৈকতে ৬ হাজারেরও বেশি মানুষ জড়ো হয়ে জাতিসংঘের পরিবেশ চ্যাম্পিয়ন অব দ্য আর্থ আফরোজ শাহের সমুদ্রসৈকত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতায় যোগ দিয়েছিলেন, যেখানে তারা ৯০,০০০ কেজিরও বেশি প্লাস্টিক সংগ্রহ করেছিলেন। আমার প্রশ্ন, বাংলাদেশে কী করলাম?
বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫
এই আইনের ধারা-২ থেকে দেখা যায় যে, ২ (খ) ‘দূষণ’ অর্থ বায়ু, পানি বা মাটির তাপ, স্বাদ, গন্ধ, ঘনত্ব বা এদের অন্যান্য বৈশিষ্ট্যের পরিবর্তনসহ বায়ু, পানি বা মাটির দূষিতকরণ বা এদের ভৌতিক, রাসায়নিক বা জৈবিক গুণাবলিসমূহের পরিবর্তন, অথবা বায়ু, পানি, মাটি বা পরিবেশের অন্য কোনো উপাদানের মধ্যে তরল, গ্যাসীয়, কঠিন, তেজস্ক্রিয় বা অন্য কোনো পদার্থের নির্গমনের মাধ্যমে বায়ু, পানি, মাটি, গবাদি পশু, বন্যপ্রাণী, পাখি, মত্স্য, গাছপালা বা অন্য সব ধরনের জীবনসহ জনস্বাস্থ্যের প্রতি ও গৃহকর্ম, বাণিজ্য, শিল্প, কৃষি, বিনোদন বা অন্যান্য ব্যাবহারিক ক্ষেত্রে ক্ষতিকারক, অহিতকর বা ধ্বংসাত্মক কার্য; ২ (ঠ) বর্জ্য’ অর্থ যে কোনো তরল, বায়বীয়, কঠিন, তেজস্ক্রিয় পদার্থ যাহা নির্গত, নিক্ষিপ্ত, বা স্তূপীকৃত হইয়া পরিবেশের ক্ষতিকর পরিবর্তন সাধন করে।
এখানে প্লাস্টিকের কোনো সংজ্ঞা পেলাম না! অথচ আমরা (UNEP) UNITED NATIONS ENVIRONMENT PROGRAMME স্বাক্ষরকারী দেশ। যার অর্থ পরিবেশ সংরক্ষণ করতে আমরা অঙ্গীকারবদ্ধ। জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচি এর নেতৃত্বে ও সহায়তায় স্বল্প মূল্যের গৃহনির্মাণ একটা প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে। কিন্তু পরিবেশ সংরক্ষণের জন্য প্লাস্টিকের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বিশ্বব্যাপী প্রচারে আমরা সম্পৃক্ত হতে পারিনি।
প্লাস্টিকের বিকল্প যেমন, স্টেইনলেস স্টিল, কাঁচ, প্লাটিনাম সিলিকন, মৌচাক, কাঠ, বাঁশ, কাগজ, কার্ডবোর্ড, বাইয়োপ্লাস্টিক, মাশরুম পাকেজিং (যেটি স্টাইরোফোম তৈরিতে ব্যবহার করা হয়), সুপারিগাছের পাতার প্লেট, গ্লাস, বাটি ইত্যাদি। এই সব বিকল্প সামগ্রী অতি সহজলাভ্য, সহজেই মাটিতে মিশে যায়, পরিবেশের কোনো ক্ষতি না করেই।
আমরা পরিবেশ সংরক্ষণ করব, আবার পরিবেশ ধংসের কাজ বন্ধ করব না। ঘটা করেই দিবস পালন করব, আবার ইটিপি স্থাপন করব না, ওটা ব্যবহারও করব না, রিসাইকেল করব না। পুনরায় ব্যবহার করব না। গৃহস্থালি কাজে, বিশেষ করে রান্নার ঘরে পুনর্বার ব্যবহার একটি অতি সাধারণ ঘটনা। পানির বোতল অহরহ পুনর্বার ব্যবহার হতো। এখন প্রায় সব শেণির মানুষ অনটাইম বোতল ব্যবহার করছেন, যা ভয়াবহ অবদান রাখছে পরিবেশ দূষণে।
ইউরোপের উন্নত বিশ্বের পরিবেশ এখনো সর্বশ্রেষ্ঠ। স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশ, পশ্চিম ইউরোপের দেশ, নরওয়ে, সুইডেন, ইউকে বড় উদাহরণ। এশিয়ার মধ্যেই জাপান, সিংগাপুর উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। কানাডার পরিবেশ বেশ ভালো। সমস্যার অন্ত নেই বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, মায়ানমার, থাইল্যান্ডসহ আরো অনেক দেশ।
তবে চেষ্টার পর ভালো রেজাল্ট হবেই। প্রয়োজন শৃঙ্খলা। যেমন ভারতের দক্ষিণ অঞ্চলের কোনো একটা মন্দিরের হাজার হাজার লোককে খাওয়ানোর ব্যবস্থা। কিন্তু তাদের রান্নার বর্জ্য ৫ শতাংও অবশিষ্ট থাকে না। তারা এমনভাবে ব্যবস্থাপনা করে যে, পরোটাই কাজে লাগানোর সুযোগ হয়। যেমন, জৈবসার, গোখাদ্য, সারমাটি, ইত্যাদি তৈরি হয়।
জাতিসংঘের পরিবেশ প্রোগ্রামের (ইউএনইপি) পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, আট মিলিয়নেরও বেশি মেট্রিক টন প্লাস্টিক বর্জ্য প্রতি বছর সমুদ্রে প্রবেশ করে। সমুদ্র তলদেশে তদন্ত করে দেখা গেছে, এ যেন প্লাস্টিক বর্জ্যের এক বিশাল মজুত হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা বিপর্যস্ত করেছে সামুদ্রিক জীবন। এই প্লাস্টিক দূষণ সামুদ্রিক প্রাণীদের জন্য বিশাল হুমকির রূপ নেয়, কেন না তারা প্রায়ই ভুল করে প্লাস্টিককে খাবার মনে করে বা বিভিন্নভাবে তাদের শরীর প্লাস্টিকের সঙ্গে জড়িয়ে যায়। প্লাস্টিক বর্জ্য পুড়িয়ে ফেলার ফলে পরিবেশে বিভিন্ন বিষাক্ত পদার্থ মিশে যায়, যার ফলে বায়ুদূষণ ঘটে এবং পরবর্তী সময়ে শ্বাস-প্রশ্বাসজনিত রোগব্যাধির মাত্রা বৃদ্ধি পায়।
প্লাস্টিকের পচন সহজ নয়, বহু বছর পরও এটি ভেঙে গিয়ে মাইক্রোপ্লাস্টিকে পরিণত হয়। বাতাসে আমরা শ্বাস নিই, তার সবখানেই এখন মাইক্রোপ্লাস্টিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। এই ছোট ছোট কণাগুলো আমাদের দেহে প্রবেশ করে এবং বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকির জন্ম দেয়।
পরিবেশ আদালত আইন, ২০১০
প্রতি জেলাতে এক বা একাধিক পরিবেশ আদালত আছে। ধারা-৬ (২) স্পেশাল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত এই আইনের ধারা ৯-এর অধীন অপরাধসহ পরিবেশ আইনে বর্ণিত অপরাধের জন্য নির্ধারিত দণ্ড আরোপ করতে পারে। শুধু কেউ আদালতে মামলা করলে দোষ প্রমাণে ৫ বছর কারাদণ্ড বা ৫০০০/-টাকা জরিমানা, যা ক্ষতিপূরণ হিসেবে দেওয়া যাবে। তবে আইনের বিধানে কোথাও রাস্তার ধারে ঝাড়ু দিয়ে পাশের ড্রেনে ময়লা ফেলা বা জমা করার কোনো শাস্তি বা বিধান নেই।
দীর্ঘদিন আমেরিকাতে বসবাসের অভিজ্ঞতা যাদের রয়েছে, তারা জানেন, নিজ ঘরের সামনে কেউ যদি বরফ পরিষ্কার না করে, তো ভবন মালিককে জরিমানা করা হয়। এই পদ্ধতি সব উন্নত দেশে বিরাজমান। আর যদি দুর্ঘটনার ফলে কোনো পথচারী আহত বা পঙ্গু হন, তো ভবন মালিকের সর্বনাশ। হাজার ডলার ক্ষতিপূরণ ধার্য হবে। কোনো মাফ নেই। আমাদের দেশের আইনের বিধান এখনো এইরূপ শর্ত আরোপ করেনি, যা অনতিবিলম্বে করা দরকার। শহরের পানি নিষ্কাশন বন্ধ করে ঘরবাড়ি নির্মাণ বা খাল দখল বা খালের পানিতে এত বেশি বর্জ্য বিশেষ করে প্লাস্টিক সামগ্রী যা পানির ফ্লো বন্ধ করে পচা পানিতে মশার আবাস তা দূর করার আইনি বিধান বা শাস্তির বিধান এখনই করতে হবে। অন্যথায় পরিবেশ দূষণ থেকে মুক্তি সুদূর পরাহত।