পরিবার একটি রাষ্ট্রের ভিত্তি, সভ্যতার প্রাথমিক পাঠশালা এবং মানবিকতার প্রথম বিদ্যালয়। সমাজবিজ্ঞানীরা মনে করেন, পরিবারের কাঠামো এবং মানসিকতা কোনো জাতির ভবিষ্যত্ নির্ধারণে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যে কোনো টেকসই উন্নয়ন পরিকল্পনার মূলেই থাকতে হবে পরিবারকে ঘিরে নীতিমালা ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। কারণ রাষ্ট্রের সব উন্নয়ন প্রকল্প ও পরিকল্পনা শেষমেশ ব্যক্তির কল্যাণে পৌঁছাতে চায়। আর ব্যক্তির গঠন শুরু হয় পরিবার থেকেই। তাই পরিবারভিত্তিক নীতিমালা ছাড়া টেকসই উন্নয়ন কেবল কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ থেকে যাবে।
জাতিসংঘ ১৯৯৩ সালের ২০ সেপ্টেম্বরের সাধারণ অধিবেশনে প্রতি বছর ১৫ মে ‘আন্তর্জাতিক পরিবার দিবস’ পালন করার সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯৯৪ সালকে ঘোষণা করা হয় ‘আন্তর্জাতিক পরিবার বর্ষ’। ১৯৯৫ সাল থেকে এ দিবস নিয়মিত পালিত হয়ে আসছে। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য—‘টেকসই উন্নয়নের জন্য পরিবারভিত্তিক নীতিমালা’—বহুমাত্রিক তাত্পর্যে ভরপুর। সময়ের প্রেক্ষাপটে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও প্রাসঙ্গিক এক আহ্বান।
টেকসই উন্নয়নের সংজ্ঞা অনুযায়ী, বর্তমান প্রজন্মের প্রয়োজন মেটানোর সময় ভবিষ্যত্ প্রজন্মের প্রয়োজন যেন ব্যাহত না হয়, তা নিশ্চিত করাই এর মূল লক্ষ্য। এক্ষেত্রে পরিবারের ভূমিকাই মুখ্য। টেকসই সমাজ গঠনে শুধু অবকাঠামো নয়, প্রয়োজন টেকসই মানুষ; যার জন্ম, লালনপালন ও গঠনের কেন্দ্রবিন্দু পরিবার। সত্, আদর্শবান ও মানবিক মানুষ গড়তে হলে পারিবারিক শিক্ষা, অনুশাসন ও নৈতিকতা অপরিহার্য।
পরিবার সমাজের প্রাচীনতম প্রতিষ্ঠান। রক্তের বন্ধন ও সামাজিক সম্পর্কের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা এ প্রতিষ্ঠানটির জন্মের ইতিহাস অনেক পুরোনো। যখন মানুষ গুহা ছেড়ে খোলা আকাশের নিচে কৃষিকাজ শুরু করে, তখন থেকেই পরিবারের প্রয়োজনীয়তা সামনে আসে। কৃষিকাজের জন্য জমির মালিকানা, উত্পাদিত শস্য সংরক্ষণের জন্য গোলাঘর ও নিরাপদ বসবাসের জন্য ঘরবাড়ি গড়ে তুলতে গিয়ে মানুষ পরিবার গঠন করে।
ক্রমে সম্পদ বণ্টন ও রক্ষণাবেক্ষণের প্রয়োজনে গড়ে ওঠে বিবাহ, উত্তরাধিকার ও সম্পদ বণ্টনের নীতিমালা। জন্ম নেয় সম্পত্তির মালিকানা ও পরিবারের ভেতরে দায়িত্ব বণ্টনের চর্চা। সমাজের ক্রমবিকাশের সঙ্গে সঙ্গে পরিবার নামক প্রতিষ্ঠানটির কাঠামোতেও আসে পরিবর্তন। যৌথ পরিবার ভেঙে একক পরিবারের ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়। পারিবারিক কাঠামোর এ পরিবর্তনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রগতি, উন্নত চিকিৎসাব্যবস্থা এবং সুস্থ-সাবলীল জীবনযাপনের সুযোগ।
এই পরিবর্তন যেমন ইতিবাচক দিক উন্মোচন করেছে, তেমনি নেতিবাচক প্রভাবও ফেলে গেছে সমাজে। পুষ্টিকর খাদ্য, উন্নত চিকিত্সা এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধির ফলে মানুষ এখন যেমন আগের চেয়ে বেশি স্বাস্থ্যবান ও আয়ুষ্কাল বেশি, তেমনি প্রযুক্তির প্রভাবে অনেকেই আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠেছে। মানুষ পরিবারকে বোঝা ভাবছে, দায়িত্ব এড়িয়ে যাচ্ছে। পারিবারিক বন্ধন এখন শিথিল; বেড়েছে বিচ্ছিন্নতা, আত্মীয়তা ও সৌহার্দের অভাব। এই অবক্ষয়ের ফলে সমাজে লোভ, হিংসা, প্রতিহিংসা, দুর্নীতি ও নৈতিকতাবোধহীনতা বাড়ছে।
পরিবার রাষ্ট্রের সবচেয়ে ক্ষুদ্র একক হলেও এর গুরুত্ব অপরিসীম। পরিবার যদি দায়িত্বশীলতা, সততা ও মূল্যবোধে গড়ে না ওঠে, তাহলে সমাজ দুর্নীতিগ্রস্ত ও অবক্ষয়গামী হয়। একজন দুর্নীতিবাজ শুধু নিজেকে নয়, পরিবার ও সমাজকেও বিপদে ফেলেন। তিনি পরিবারে বেড়ে ওঠা নতুন প্রজন্মকে ভুল আদর্শ দেন, যেখান থেকে দুর্নীতির চক্র আরো বিস্তৃত হয়। সন্তানরা বাবা-মায়ের নৈতিকতাহীন কর্মকাণ্ড দেখে শেখে এবং এভাবেই দুর্নীতির শিকড় সমাজে আরো গভীরে প্রোথিত হয়।
আমরা ভুলে যাই—আমগাছে জাম ধরে না, খারাপ পরিবার থেকে ভালো মানুষ জন্ম নেয় না। বস্তুত, একজন সন্তানের প্রথম শিক্ষালয় পরিবার, প্রথম শিক্ষক বাবা-মা। বাবা-মায়ের আচরণ, নৈতিকতা ও মূল্যবোধ শিশুর মানসগঠনে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখে। ভালো পরিবার ভালো নাগরিক গড়ে তোলে; আর ভালো নাগরিকই পারে একটি উন্নত রাষ্ট্র গড়তে।
বর্তমান বিশ্বের নানা চ্যালেঞ্জ; যেমন—জলবায়ু পরিবর্তন, অর্থনৈতিক বৈষম্য, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও মানসিক স্বাস্থ্যসমস্যা—এসব মোকাবিলায় পরিবারভিত্তিক সমাধান খোঁজা জরুরি। পরিবারে সচেতনতা তৈরি করা, শিক্ষা ও নৈতিকতা চর্চা করা এবং পারস্পরিক সহমর্মিতার পরিবেশ গড়ে তোলার মাধ্যমে সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আনা সম্ভব। রাষ্ট্রীয় নীতিমালায় পারিবারিক বন্ধন রক্ষায় সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা থাকা দরকার।
অনেক পরিবারে দেখা যায়, পরিবারের কোনো সদস্য অনৈতিক উপায়ে অর্থ উপার্জন করছে, আর বাকি সদস্যরা নির্বিকার। কিন্তু বাস্তবে পরিবার তো কেবল রক্তের সম্পর্ক নয়, এটি মূল্যবোধের সমষ্টি। কোনো পরিবার দুর্নীতিগ্রস্ত হলে তার প্রভাব কেবল একটি প্রজন্মেই সীমাবদ্ধ থাকে না, তা ছড়িয়ে পড়ে ভবিষ্যতের ওপরও। আমরা ভুলে যাই, দুর্নীতিবাজ পিতার সন্তান দুর্নীতির ধারকই হয়—কারণ সে বাড়িতে দেখেছে কীভাবে অন্যায়কে লুকিয়ে রাখতে হয়। সে শিখেছে, কীভাবে নীতি না মেনে সুবিধা আদায় করতে হয়। অথচ, আমরা চাই সত্ নাগরিক এবং সেটি পরিবার থেকেই গড়ে তুলতে হবে।
পরিবারে যেমন শিক্ষিত, কর্মঠ, সৃজনশীল সদস্য থাকে, তেমনি শারীরিক বা মানসিকভাবে দুর্বল সদস্যও থাকতে পারে। কেউ দীর্ঘদিন রোগে ভুগছেন, কেউ কর্মক্ষম নন—তবুও তারা পরিবারেরই অংশ। পরিবারে সহমর্মিতা, দায়িত্ববোধ, সহনশীলতা ও ভালোবাসা ছাড়া এসব বৈচিত্র্যকে ধারণ করা সম্ভব নয়। এসব গুণাবলি পরিবারে চর্চিত হলে সমাজে মানবিকতা, সহানুভূতি এবং শান্তি প্রতিষ্ঠা পায়।
পরিবার যদি হয়ে ওঠে মানবিক মূল্যবোধ, ন্যায্যতা ও সহমর্মিতার উত্সস্থল, তাহলে সেই সমাজেও ছড়িয়ে পড়বে স্থিতিশীলতা ও শান্তি। রাজনীতির ক্ষেত্রেও এই মানসিকতা প্রয়োজন; যেখানে নেতারা দায়িত্বশীল পরিবারের সন্তান হয়ে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে বিশ্বাসী হবেন।
পরিবার শুধু দৈহিক নিরাপত্তা বা অর্থনৈতিক সহায়তার ক্ষেত্র নয়, এটি মানসিক প্রশান্তি, সামাজিকীকরণ ও নৈতিক শিক্ষার প্রধান ক্ষেত্র। এই জায়গা থেকেই সমাজের প্রতিটি স্তরে ইতিবাচক পরিবর্তনের শুরু হওয়া উচিত। কিন্তু বর্তমান সময়ে পরিবার ভেঙে পড়ছে—বিচ্ছিন্নতা, স্বার্থপরতা এবং ভোগবাদিতা পরিবারে আগ্রাসন চালাচ্ছে। এই অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করতে হবে পরিবার থেকেই।
বর্তমানে আমরা এমন এক বিশ্ববাস্তবতায় অবস্থান করছি; যেখানে যুদ্ধ, মহামারি, জলবায়ুসংকট, খাদ্যাভাব, দুর্নীতি ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতো সমস্যা প্রতিনিয়ত আমাদেরকে বিপর্যস্ত করছে। এ বাস্তবতায় পরিবারভিত্তিক নীতিমালা এবং টেকসই সামাজিক কাঠামো গড়ে তোলাই একমাত্র পথ। প্রতিটি পরিবারে যদি নৈতিকতা, দায়িত্ববোধ এবং মানবিক মূল্যবোধকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়, তাহলে টেকসই উন্নয়নের স্বপ্ন বাস্তবায়ন সম্ভব।
এমন একটি সমাজ গড়তে হলে সরকারের পাশাপাশি নাগরিক সমাজ, গণমাধ্যম, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং সর্বোপরি পরিবারকেই এগিয়ে আসতে হবে। পরিবার হবে নৈতিক শক্তির ঘাঁটি—যেখানে সন্তানরা শিখবে সত্য, সুন্দর এবং সত্ভাবে বেঁচে থাকার কৌশল। পরিবার থেকেই শুরু হতে হবে সামাজিক নৈতিকতার শুদ্ধি অভিযান। প্রতিটি পরিবার হবে মূল্যবোধের কারখানা, মানবিকতার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র এবং শান্তির প্রাথমিক ঘর। তবেই গড়ে উঠবে টেকসই উন্নয়নের ভিত্তি, এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্ম পাবে একটি সুন্দর, মানবিক ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ।
লেখক : প্রবীণ বিষয়ে লেখক, গবেষক ও সংগঠক