বাঙালি হিসেবে আমরা যতটা না গর্ব বোধ করি, তার চাইতে বেশি গর্ব বোধ করি বাংলা ভাষা নিয়ে। কারণ, এ ভাষা আমরা পেয়েছি আমাদের শহীদ ভাইদের মহান আত্মত্যাগের মাধ্যমে, তাদের রক্তের বিনিময়ে। এ রক্তের ঋণ কিছুটা কমাতে ১৯৫২ সালে ২১ ফেব্রুয়ারিতে লেখক ও সাংবাদিক আব্দুল গাফফার চৌধুরী রচনা করেছিলেন একুশের গান ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি’। গানটির সুরকার ছিলেন আব্দুল লতিফ। গানটি পরবর্তী সময়ে জহির রায়হানের ‘জীবন থেকে নেওয়া’ সিনেমাতে ব্যবহার করা হয়। এ গানের মাধ্যমে ফুটে উঠেছে বাংলা দামাল ছেলেদের আত্মত্যাগের ইতিহাস, তাদের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত করার ইতিহাস।
এতো রক্তের বিনিময়ে পাওয়া ভাষা আমাদের অনেক আবেগের অনেক ভালোবাসার। পৃথিবীতে এমন কোনো জাতি নেই, যে জাতি তার মাতৃভাষা কে ভালোবাসে না। বরং বাঙালিরা আরো অনেক বেশি ভালোবাসে বাংলা ভাষাকে; কারণ, এই ভাষা পেতে আমাদের অনেক মায়ের বুক খালি করতে হয়েছে; যার দরুন আমরা আমাদের ভাষাকে নিজের প্রাণের থেকেও বেশি ভালোবাসি। যে বাংলা ভাষায় আমরা সহজেই কথা বলতে পারছি, লিখতে পারছি, মনের ভাব প্রকাশ করতে পারছি, এক সময় এ ভাষার কোনো স্বাধীনতা ছিল না। চাইলেই আমরা তা ব্যবহার করতে পারতাম না। আমাদের অফিশিয়াল কোনো কাজে বাংলা ভাষাকে ব্যবহার করা হতো না।

বাঙালিদের সব দিক দিয়ে—অর্থাৎ, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, রাষ্ট্রীয় সকল ক্ষেত্রে বৈষম্য করা হতো। একটা সময় পর তারা আমাদের মুখের ভাষাটাও কেড়ে নিতে চেয়েছিল; কিন্তু বাংলার মানুষের দৃঢ় মনোবল বাংলা ভাষার প্রতি অগাধ ভালোবাসা এবং ভাষার জন্য আত্মত্যাগের স্পৃহার কারণে তারা তা পেরে উঠেনি।
বাংলা ভাষা নিয়ে বির্তক শুরু হয়েছিল মূলত ১৯৪৭ সালে— দেশভাগের পর পরই। ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদ অধিবেশনে ইংরেজির পাশাপাশি উর্দুকে রাখা হয়; এই অধিবেশনে কুমিল্লার ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত এর প্রতিবাদ করেন এবং উর্দু ও ইংরেজির পাশাপাশি বাংলাকে রাখতে বলা হয়। এর পেছনে তার যুক্তি ছিল, তৎকালীন পাকিস্তানের ৫৪ শতাংশ মানুষের মুখের ভাষা ছিল বাংলা; অর্থাৎ মোট জনসংখ্যা ছিল ৬ কোটি ৯০ লক্ষ; তাদের মধ্যে শুধু বাংলা ভাষায় কথা বলতো ৪ কোটি ৪০ লক্ষ। বাকিরা উর্দু সহ আরো অন্যান্য ভাষায় কথা বলতো।১৯৫১ সালের আদমশুমারী অনুযায়ী, বাংলা ভাষায় কথা বলতো ৫৪.৬০ শতাংশ; ২৮.০৪ শতাংশ পাঞ্জাবি; ৫.৮ শতাংশ সিন্ধি; ৭.১ শকতাংশ পশতু; ৭.২ শতাংশ উর্দু এবং বাকি ১.৮ শতাংশ অন্যান্য ভাষায় কথা বলতো।
সে হিসেবে তিনি মনে করতেন— উর্দু নয়, বরং বাংলাই হওয়া উচিত পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা। কিন্তু ত্যৎকালীন পাকিস্তানের শাসক শ্রেণি তা মানতে নারাজ! তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সূচনা। ১৯৪৮ থেকে ১৯৫২ দীর্ঘ ৪ বছর ভাষা নিয়ে বির্তক চলে। পাকিস্তানের অদূরদর্শী শাসকরা বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে মেনে নিতে পারেনি; যার ফলস্বরূপ ১৯৫২ সালে তারা উর্দুকে জোর করে আমাদের ওপর চাপিয়ে দেয়। কিন্তু বাংলা ভাষাভাষী বিশাল জনগোষ্ঠী এর প্রতিবাদ করে। সেই সূত্রে শুরু হয় ভাষা আন্দোলন। শহীদের রক্তের বিনিময়ে আমরা পাই বাংলা ভাষা।
১৯৫২ সাল থেকে আমরা ২১ ফেব্রুয়ারীকে ভাষা দিবস, শহীদ দিবস হিসেবে পালন করে আসছি। ১৯৯৯ সালে জাতিসংঘের অঙ্গসংগঠন ইউনেস্কো বাংলাকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দান করে। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, এতো ত্যাগের বিনিময়ে পাওয়া ভাষার কি আমরা আদৌও সঠিক মর্যাদা দিতে পারছি? এ প্রশ্ন থেকেই যায়।
আজকাল বাস-ট্রেনে যাতায়াতের পথে দেখা যায় ভাষার অপব্যবহার। এখনকার অবিভাবকেরা সন্তানকে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে ভর্তি করাতেই বেশি পছন্দ করেন! অনেকে বাংলা ভাষাকে প্রাধান্য দেন না, বাংলায় কথা বলা মানুষদের ছোট করে দেখেন। এমনকি ভাষা শহীদের শ্রদ্ধা জানাতেও দেখা যায় ভিন্নতা!
একটা সময় ছিল, যখন বাংলার মানুষ ২১শে ফেব্রুয়ারি ভোরে উঠে ফুল নিয়ে শহীদ মিনারে যেতো শহীদদের শ্রদ্ধা জানাতে। কৃষক, শ্রমিক, জেলে থেকে শুরু করে সমাজের সকল স্তরের মানুষ সেখানে যেতো। অথচ বর্তমান সময়ে তা আর দেখা যায় না! মানুষকে খালি পায়ে হেঁটে যেতে দেখা যায় না। অথচ এই ভাষা আমরা পেয়েছি কতই না লড়াই সংগ্রামের মাধ্যমে!
আবার এমন অনেকে আছেন, যারা আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলতে দ্বিধা বোধ করে। এর কারণ, তার চারপাশের মানুষ তার ভাষা নিয়ে মজা করে; যেটা থেকে বাচতেই সে তার শিকড়ের ভাষাকে ভুলে তথাকথিত ‘শুদ্ধ বাংলা’ ভাষায় কথা বলার বৃথা চেষ্টা করে!
মনে রাখতে হবে, ভাষা আন্দোলন যতটা না রাজনৈতিক আন্দোলন ছিল, তার চেয়ে বেশি ছিল সাংস্কৃতিক আন্দোলন। বাঙালিরা বাংলার সংস্কৃতিকে ধারণ করেই ভাষা আন্দোলনে নেমেছিল। কিন্তু সেসব আজ অতীত ইতিহাস মাত্র। আমরা বাংলা ভাষাকে সঠিক মর্যাদা দিতে পারছি না বা দিতে ব্যর্থ হচ্ছি। এর থেকে লজ্জা আর কিছুতে নেই!
সুতরাং, জাতির মর্যাদা রক্ষা করতেই অবশ্যই বাংলা ভাষাকে সঠিক মর্যাদা দিতে হবে। ভাষার অপব্যবহার কমাতে হবে। ভাষার যথাযথ ব্যবহার করা শিখতে হবে। সর্বোপরি বাংলা ভাষাকে আমাদের ‘ধারণ’ করতে হবে। সালাম, রফিক, জব্বার, শফিউরের রক্তকে আমরা বৃথা যেতে দিতে পারি না। সবচেয়ে বড় কথা, নিজের দেশকে ভালোবাসাতে হলে ভাষাকে মন থেকে ধারণ করতে হবে। কারণ ভাষা আন্দোলনই ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের পথ নির্দেশক। ভাষা সঠিক মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হোক—এই আমাদের প্রত্যাশা।
লেখক : শিক্ষার্থী, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
ই-মেইল : setu.akter7123@gmail.com