বাংলাদেশের ইতিহাসে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের অবদান শেখ মুজিব-পরবর্তী বাংলাদেশের জাতীয় বিকাশ ও ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনায় অপরিসীম গুরুত্বপূর্ণ। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান তেমনই একজন নেতা, যিনি সীমিত সময়ের জন্য রাষ্ট্র পরিচালনার সুযোগ পেলেও, বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির একটি কার্যকর ফ্রেমওয়ার্ক বা রূপরেখা দিয়ে গিয়েছিলেন। এই লেখায় আমরা সেই রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক চিন্তার তিনটি মূল ভিত্তি নিয়ে আলোচনা করব, যেগুলো আজও বাংলাদেশকে পথ দেখায়।
১. রাজনৈতিক স্বকীয়তা ও বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ
প্রেসিডেন্ট জিয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দর্শনের একটি ছিল বাংলাদেশের নিজস্ব রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিচয় নির্মাণ। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশের জন্ম হলেও, স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে শেখ মুজিবের রাজনৈতিক নেতৃত্বের মধ্যে পাশের দেশ ভারতের প্রতি অতিরিক্ত নির্ভরতা ও সাংস্কৃতিক প্রভাব লক্ষ করা যায়। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান সেই ধারার বিপরীতে অবস্থান নেন। তিনি ‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ’-এর ধারণা উপস্থাপন করেন, যার মাধ্যমে দেশের জনগণের সঙ্গে মাটির, ভাষার, সংস্কৃতির ও ইতিহাসের এক গভীর সম্পর্ক স্থাপন করা হয়।
এই বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ মূলত বাংলাদেশের ভূগোল, সংস্কৃতি, ধর্মীয় বহুত্ববাদ এবং ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে জাতীয় পরিচয় নির্মাণের প্রচেষ্টা। পাকিস্তানি ইসলামি জাতীয়তাবাদ বা ভারতের সংস্কৃতিনির্ভর বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিপরীতে, বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ নিজস্ব রাষ্ট্রের স্বার্থ, ভাষা, সংস্কৃতি এবং জনগণের আত্মপরিচয়কে প্রধান করে তোলে। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন, আত্মনির্ভরশীল ও আন্তর্জাতিকভাবে সম্মানিত জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা; যেখানে ধর্ম, ভাষা ও সংস্কৃতির বৈচিত্র্য সুরক্ষিত থাকে কিন্তু জাতীয় স্বার্থে ঐক্য বজায় থাকে। এটি শুধু একটি রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া নয়, বরং এক গভীর রাষ্ট্রীয় দর্শন, যা স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশে এক নতুন জাতীয় চেতনার জন্ম দেয়।
প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বহুদলীয় গণতন্ত্র চালু করেন, যেখানে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা এবং নাগরিক অধিকারের সম্মান লাভ করে একটি সাংবিধানিক রূপ। তার শাসনামলে তিনি ১৯৭৫ সালের বাকশালের একদলীয় শাসনব্যবস্থা বাতিল করে জনগণকে রাজনৈতিক মতামতের স্বাধীনতা ফেরত দেন। রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়, বন্ধ হয়ে যাওয়া সংবাদপত্রগুলো পুনরায় চালুর অনুমতি দেওয়া হয় এবং বিরোধীদলীয় রাজনীতি চর্চার সুযোগ সৃষ্টি হয়।
অন্যদিকে বহুদলীয় গণতন্ত্র চালুর মধ্য দিয়ে জিয়া কেবল প্রশাসনিক পরিবর্তন আনেননি, বরং তিনি জনগণের রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের পথ প্রশস্ত করেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, একটি জাতিকে এগিয়ে নিতে হলে মানুষের চিন্তা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে এবং রাজনীতিতে প্রতিযোগিতা থাকতে হবে, যাতে নেতৃত্বের বিকাশ ঘটে। রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার এই পরিবেশ নতুন রাজনৈতিক দল, চিন্তা ও নেতৃত্বের উদ্ভব ঘটায়, যা পরবর্তীকালে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
একদলীয় শাসন যেখানে জনগণকে রাষ্ট্রের একটি নিঃশব্দ অনুসারীতে পরিণত করে, সেখানে জিয়ার বহুদলীয় গণতন্ত্র ছিল জনগণকে রাষ্ট্রের সক্রিয় অংশীদার করে তোলার একটি সচেতন প্রয়াস। সেই অর্থে এটি শুধু রাজনৈতিক সংস্কার ছিল না, এটি ছিল বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি ঐতিহাসিক মোড় পরিবর্তন, যা দীর্ঘ মেয়াদে গণতান্ত্রিক চেতনার ভিত্তি স্থাপন করে।
২. মুক্তবাজার অর্থনীতিতে বাংলাদেশের প্রবেশ
শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনামলে বাংলাদেশ যে সমাজতন্ত্রকে রাষ্ট্রীয় নীতির রূপে গ্রহণ করেছিল, তা আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে ছিল এক বিপজ্জনক সময়, যখন বিশ্ব দুই পরাশক্তির মধ্যে তীব্র বিভক্ত ছিল :একদিকে যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন পুঁজিবাদী ব্লক, অন্যদিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন নেতৃত্বাধীন কমিউনিস্ট ব্লক। এই শীতল যুদ্ধের (Cold War) প্রেক্ষাপটে, নতুন স্বাধীন বাংলাদেশ যখন ১৯৭২ সালে মুজিব সরকারের নেতৃত্বে ‘সমাজতন্ত্র’কে সংবিধানে রাষ্ট্রীয় আদর্শ হিসেবে ঘোষণা করল এবং রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে শিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্যকে নিয়ে নিল, তখন তা পুঁজিবাদী পশ্চিমা বিশ্ব, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে সন্দেহের চোখে দেখা হয়। ফলে বাংলাদেশের উন্নয়ন সহযোগিতায় পশ্চিমা বিশ্বের আগ্রহ কমে যায়।
এই প্রেক্ষাপটে জিয়াউর রহমান দেশের অর্থনৈতিক নীতিতে আমূল পরিবর্তন আনেন। তিনি ধাপে ধাপে বাজার অর্থনীতির প্রতি অগ্রসর হন। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগে উত্সাহিত করতে তিনি নীতিগত পরিবর্তন আনেন। প্রাইভেট সেক্টরকে উত্সাহিত করা ও রপ্তানিনির্ভর শিল্প বিকাশ তার অর্থনৈতিক দর্শনের কেন্দ্রবিন্দু ছিল। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, জিয়ার সময়েই বাংলাদেশে প্রথম বারের মতো রপ্তানিমুখী গার্মেন্টস শিল্পের ভিত্তি স্থাপিত হয়। এই শিল্প এখন দেশের অন্যতম বড় বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের খাত এবং কোটি মানুষের কর্মসংস্থানের উত্স। তাই বলা যায়, তিনি যে রপ্তানিনির্ভর শিল্পায়নের পথে দেশকে নিয়ে গিয়েছিলেন, তা আজও আমাদের অর্থনৈতিক ভিত্তিকে শক্তিশালী করে রেখেছে।
৩. শ্রমশক্তির বৈশ্বিকীকরণ ও মধ্যপ্রাচ্যনীতি
প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের তৃতীয় ও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল বাংলাদেশের জনশক্তিকে আন্তর্জাতিক শ্রমবাজার, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যে প্রবেশ করানো। তার কূটনৈতিক দক্ষতা, ইসলামিক বিশ্বের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক এবং ব্যক্তিগত ইমেজের কারণে বাংলাদেশ প্রথম বারের মতো বৃহত্ পরিসরে মধ্যপ্রাচ্যে শ্রমবাজারে প্রবেশের সুযোগ পায়।
তিনি ওআইসির উচ্চ পর্যায়ের কমিটিতে সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হন, বিশেষ করে আল-কুদস কমিটিতে। তার নেতৃত্বে বাংলাদেশ ইসলামিক বিশ্বের সহানুভূতি অর্জন করে এবং বাংলাদেশের শ্রমিকরা সৌদি আরব, কুয়েত, কাতার, ও সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ বিভিন্ন দেশে কাজের সুযোগ পায়।
১৯৮০ সালে ইরান-ইরাক যুদ্ধের সময় তিনি ইসলামি সম্মেলন সংস্থার (OIC) পক্ষ থেকে শান্তি মিশনে নেতৃত্ব দেন, দ্বন্দ্ব নিরসনের চেষ্টা করেন। এই আন্তর্জাতিক নেতৃত্ব তার কূটনৈতিক গ্রহণযোগ্যতা ও বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করে তোলে। এর ফলে লাখ লাখ বাংলাদেশি শ্রমিক বিদেশে কাজ করার সুযোগ পান, যা দেশের রেমিট্যান্স প্রবাহের সূচনা করে এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নে এক নতুন মাত্রা যোগ করে।
প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক চিন্তাধারা ছিল ভবিষ্যত্মুখী, আত্মনির্ভরশীলতাভিত্তিক এবং বৈশ্বিক বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। তিনি গণতন্ত্রের ভিত্তি স্থাপন করেন, সাংস্কৃতিক স্বকীয়তা সংরক্ষণের প্রয়াস চালান, মুক্ত বাজার অর্থনীতির দিকনির্দেশনা দেন এবং বৈদেশিক কর্মসংস্থানের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেন।
এই তিনটি স্তম্ভ—রাজনৈতিক স্বকীয়তা, মুক্তবাজার অর্থনীতি, ও বৈদেশিক শ্রমবাজারে প্রবেশ, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ভিত্তি ও সামাজিক কাঠামোকে দৃঢ় করে তুলেছে। জিয়াউর রহমানের এই দূরদর্শী নেতৃত্ব শুধু ইতিহাসের পাতা নয়, আজও আমাদের রাষ্ট্রীয় নীতি ও জাতীয় বিকাশে গভীরভাবে প্রভাব ফেলছে। তার অবদান তাই কেবল একটি সময়ের নয়, দেশ পরিচালনার একটি টেকসই দর্শনেরও বহিঃপ্রকাশ।
লেখক : চিন্তক ও গবেষক এবং সিডনি পলিসি অ্যান্ড অ্যানালাইসিস সেন্টারের নির্বাহী পরিচালক