একসময় বলা হতো, ডাল-ভাত বাঙালির প্রাণ। দিনের খাটুনির পর দুপুরে গরম ভাতের সঙ্গে ডাল খাওয়াই ছিল সহজ আনন্দ। এমনকি দুই দশক আগেও সাধারণ মানুষ তিন বেলা ডাল-ভাত খেয়ে সংসার চালাতে পারত। কিন্তু আজকের দিন বাজারদরের লাগামছাড়া ঊর্ধ্বগতির কারণে ডাল-ভাতও যেন বিলাসী খাবারে পরিণত হয়েছে।
বাংলাদেশের বড় অংশই মধ্যবিত্ত শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত, যারা সমাজ ও অর্থনীতির চালিকাশক্তি। অথচ এখন তারা অভূতপূর্ব সংকটে। মুদ্রাস্ফীতি, বেকারত্ব আর আয়-ব্যয়ের অসামঞ্জস্যে টিকে থাকার লড়াই চালাতে হচ্ছে প্রতিদিন। আগে যেখানে ৫০০ টাকায় এক সপ্তাহের বাজার হতো, এখন সেই টাকায় এক দিনের বাজার করাই কঠিন। ডাল, চাল, তেল, লবণ, পেঁয়াজ সব কিছুর দাম বাড়তে বাড়তে অসহনীয় হয়ে উঠেছে।
ডাল-ভাত, একসময় যে খাবারকে সবচেয়ে সহজলভ্য মনে করা হতো, এখন অনেকের জন্যই দুঃস্বপ্ন। এক প্লেট ভাতের পাশে সামান্য ডাল বা তরকারিতে তৃপ্তি খোঁজার পরিবর্তে আজকের চিন্তা— আগামীকাল সংসার চালানো সম্ভব হবে তো? শহরের মধ্যবিত্তরা বাজারে গিয়ে প্রতিদিন নতুন দুশ্চিন্তায় পড়ছে। মাসিক ২০-২৫ হাজার টাকার আয়ে সংসার চালানো ক্রমেই কঠিন হয়ে উঠেছে। ভাড়া, পড়াশোনা, চিকিৎসা খরচ মিটিয়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস কেনার মতো টাকা হাতে থাকছে না। হঠাৎ কোনো জরুরি খরচ এলে পুরো সংসারই অচল হয়ে পড়ে।
ডাল-ভাত, একসময় যে খাবারকে সবচেয়ে সহজলভ্য মনে করা হতো, এখন অনেকের জন্যই দুঃস্বপ্ন। এক প্লেট ভাতের পাশে সামান্য ডাল বা তরকারিতে তৃপ্তি খোঁজার পরিবর্তে আজকের চিন্তা— আগামীকাল সংসার চালানো সম্ভব হবে তো?
বাংলাদেশ ব্যুরো অব স্ট্যাটিস্টিকস জানিয়েছে, সাধারণ খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি এখন ১২ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। কয়েক বছর আগে মসুর ডালের দাম ছিল ৭০-৮০ টাকা, এখন তা ১৪০-১৬০ টাকা। মোটা চাল ৩০-৩৫ টাকা থেকে বেড়ে ৫০-৬০ টাকা, ভোজ্য তেল ৮০-৯০ টাকা থেকে বেড়ে লিটারপ্রতি ১৬০-১৭০ টাকা। মৌসুমি সবজি ২০-৩০ টাকা থেকে বেড়ে ৬০-৮০ টাকা। দেশীয় মাছ যেমন কাতল, টেংরা, পুঁটি— সবই নাগালের বাইরে।
এ অবস্থার পেছনে একাধিক কারণ রয়েছে। বিশ্ববাজারে মূল্যবৃদ্ধি, ডলার-সংকট, পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধি, জ্বালানির দাম, সরবরাহ শৃঙ্খল ভাঙন এবং সবচেয়ে বড়— বাজার নিয়ন্ত্রণের অভাব। তার সঙ্গে অসাধু ব্যবসায়ীদের মজুতদারি ও কৃত্রিম সংকট তৈরি পরিস্থিতিকে আরো ভয়াবহ করেছে। মানুষের আয় যেখানে স্থির, ব্যয় সেখানে প্রতিনিয়ত বাড়ছে। ফলে ক্রয়ক্ষমতা দ্রুত কমছে।
এই সংকট মোকাবিলায় সরকারের পাশাপাশি সমাজের বিভিন্ন অংশকেও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। নিত্যপণ্যের বাজারে কঠোর নজরদারি জরুরি। অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। টিসিবির কার্যক্রম বিস্তৃত করে সহজলভ্য করতে হবে, যাতে মধ্যবিত্তও সাশ্রয়ী দামে নিত্যপণ্য পায়। কৃষি ও শিল্পে প্রণোদনা দিয়ে স্থানীয় উৎপাদন বাড়াতে হবে। প্রতিটি ওয়ার্ডে ন্যায্যমূল্যের দোকান চালু করা হলে সাধারণ মানুষ কিছুটা হলেও স্বস্তি পাবে। পাশাপাশি কর্মসংস্থান বাড়িয়ে আয়ের সুযোগ তৈরি করতে হবে।
মধ্যবিত্ত শ্রেণি সব সময় নীরবে বাঁচতে চায়; কিন্তু যখন মৌলিক চাহিদাই পূরণ হয় না, তখন তাদের নীরবতা ভাঙে। রাষ্ট্র এখনই কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে সমাজ ও অর্থনীতি উভয়ই গভীর সংকটে পড়বে।
লেখক : শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ।
(এই লেখা লেখকের একান্ত ব্যক্তিগত অভিমত; এ সংক্রান্ত কোনো দায় দৈনিক মূলধারা বহন করবে না)