ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পহেলগামে বন্দুকধারীদের হামলায় ২৬ জন নিহত হওয়ার ঘটনার রেশ ধরে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দুই দেশ ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সশস্ত্র সংঘর্ষ শুরু হয়েছে। ২২ এপ্রিল থেকে চলমান এ সংঘাতে পালটাপালটি হামলার মধ্যে পাকিস্তান এবং দেশটির নিয়ন্ত্রণাধীন কাশ্মীরের অন্তত ৯টি স্থানে ‘অপারেশন সিঁদুর’ নামে অভিযান পরিচালনা করে ভারত। পালটা হামলা হিসেবে ঐ রাতেই ভারতের পাঁচটি যুদ্ধবিমান ধ্বংসের দাবি করে পাকিস্তান। দিল্লি ও ইসলামাবাদের মধ্যে চলমান এই যুদ্ধে পাকিস্তানের হামলায় এই লেখা পর্যন্ত ভারতে অন্তত ১৬ জন নিহত ও প্রায় ৬০ জন আহত হয়েছে বলে দাবি করেছে ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়। অন্যদিকে ইসলামাবাদের দাবি, ভারতের ‘অপারেশন সিঁদুর’ শুরুর পর পাকিস্তান ও দেশটির নিয়ন্ত্রণাধীন আজাদ কাশ্মীরে ৩২ জন নিহত ও ৫০ জন আহত হয়েছে। এমন একটি পরিস্থিতিতে সীমান্তের উভয় পাশের লাখ লাখ মানুষকে তাড়া করে ফিরছে একটাই প্রশ্ন—এরপর কী হতে চলেছে?
বিশ্লেষকরা ইতিমধ্যে মন্তব্য করেছেন, এবারের ‘পাকিস্তান-ভারত সংঘর্ষ’ ঐতিহাসিক এ দুই শত্রুকে বিগত কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে উত্তেজনাপূর্ণ অবস্থার মুখে এনে দাঁড় করিয়েছে। পাকিস্তানের ভূখণ্ডে দিল্লির ‘অপারেশন সিঁদুর’ অভিযান চালানোর পর ‘প্রতিশোধ’ হিসেবে ভারতীয় ভূখণ্ডে পালটা আঘাত হানার সংকল্প ব্যক্ত করেছিল ইসলামাবাদ। যদিও পাকিস্তানকে ভারতের ওপর সে ধরনের প্রতিশোধ নিতে দেখা যায়নি এখনো। মজার বিষয় হলো, এরই মধ্যে নিজেদের ‘বিজয়ী’ দাবি করে বক্তব্য-বিবৃতি দিয়েছে উভয় পক্ষ! তবে বাস্তবতা হলো, উভয় দেশই স্পষ্টত আতঙ্কে কাঁপছে।

ইসলামাবাদের বক্তব্য, চির প্রতিদ্বন্দ্বী দিল্লির যুদ্ধবিমান গুলি করে ভূপাতিত করেছে তারা। গত বৃহস্পতিবার মাত্র এক রাতের ব্যবধানেই দেশ জুড়ে কমপক্ষে ২৫টি ভারতীয় বিমান উড্ডয়নকারী ড্রোন ভূপাতিত করার দাবি করে পাকিস্তান হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছে, এটা নয়াদিল্লির ‘নতুন গুরুতর উসকানি’।
লক্ষণীয়, ‘অপারেশন সিঁদুর’ অভিযানের পর ভারতীয় গণমাধ্যমগুলো উচ্ছ্বসিত ছিল! পহেলগাম ট্র্যাজেডির পর দিল্লির ‘তীক্ষ’ ও ‘সুদৃঢ়’ প্রতিক্রিয়ার প্রশংসা করে ‘ন্যায়বিচারের আঘাত’ শিরোনামে সম্পাদকীয় লেখে ভারতের একটি শীর্ষস্থানীয় ইংরেজি সংবাদপত্র। দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস প্রথম পৃষ্ঠা জুড়ে যে সংবাদ প্রকাশ করেছে, তার শিরোনামেও প্রতিধ্বনিত হয়েছে একই সুর—‘ন্যায়বিচার বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে’।
জনসাধারণের উদ্দেশে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফের প্রতিক্রিয়াও অভিন্ন ছিল। জাতির উদ্দেশে গভীর রাতে দেওয়া এক ভাষণে তিনি হুংকার ছেড়ে বলেন, ‘শত্রুদের হাঁটু গেড়ে বসাতে মাত্র কয়েক ঘণ্টা সময় লেগেছে’। অন্যদিকে দিল্লির দাবি, ভারতীয় ভূখণ্ডের ওপর চালানো সবচেয়ে মারাত্মক জঙ্গি হামলার পেছনে থাকা দুই ইসলামপন্থি গোষ্ঠী—লস্কর-ই-তৈয়বা এবং জইশ-ই-মোহাম্মদের ‘সন্ত্রাসী অবকাঠামো’ ধ্বংস করে দিয়েছে তারা। নয়াদিল্লি সাফ জানিয়ে দিয়েছে, ভারতীয় বাহিনী কোনো সামরিক অবকাঠামো লক্ষ্য করে হামলা চালায়নি এবং এমনকি বেসামরিক নাগরিকদেরও হত্যা করা হয়নি।
তবে পাকিস্তানের বক্তব্য ভিন্ন। তাদের পরিষ্কার দাবি, অপারেশন সিঁদুর অভিযানে পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের বেশ ভেতরের একটি স্থানে হামলা চালায় ভারত। এটি মূলত ১৯৭১ সালে উভয় দেশের মধ্যে সংঘটিত সর্বাপেক্ষা বৃহত্ সংঘাতের পর থেকে পাকিস্তানের অবিসংবাদিত ভূখণ্ডে চালানো সবচেয়ে গভীর আক্রমণ। পাকিস্তানি কর্মকর্তাদের মতে, পাঞ্জাবের আরো বেশি কিছু স্থানে হামলা চালিয়েছে ভারতীয় সেনাবাহিনী। আক্রমণ করেছে সামরিক বাহিনীর প্রাণকেন্দ্র ও শরিফ সরকারের আবাসস্থলে পর্যন্ত। এর চেয়েও সাংঘাতিক বিষয়, রাতের অন্ধকারে তারা একটি মসজিদে হামলা করেছে, যার ফলে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশটির লাখ লাখ ধর্মপ্রাণ মানুষ সংক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে।
বিশ্লেষকরা জানিয়েছেন, সামনের দিনগুলোতে ঠিক কী ঘটতে চলেছে, তা মূলত নির্ভর করছে ইসলামাবাদের পরবর্তী পদক্ষেপের ওপর। ওয়াশিংটনভিত্তিক দক্ষিণ এশিয়া বিশ্লেষক মাইকেল কুগেলম্যান বলেছেন, ‘সবার দৃষ্টি এখন পাকিস্তানের দিকে’। তিনি ব্যাখ্যা করে বলেন, ‘ভারতীয় বিমান ভূপাতিত করার মধ্য দিয়ে পাকিস্তান নিজেকে রক্ষা করতে পেরেছে এবং এই মর্মে তারা নিজেদের বিজয়ী দাবি করেছে। বিষয়টি এতটুকুতে সীমাবদ্ধ থাকলে তো কোনো কথাই নেই।’ তবে তিনি সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, ‘পাকিস্তান যদি নতুন করে হামলা চালানোর সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে সব ধরনের হিসাবনিকাশ ভুল প্রমাণিত হয়ে যাবে। সমস্ত বাজি বন্ধ হয়ে যাবে।’ ঠিক তেমন একটি পরিস্থিতিতে কী ঘটতে পারে, সে সম্পর্কে বেশির ভাগ বিশ্লেষক একমত যে, একটি পারমাণবিক-সশস্ত্র সংঘাত এ দুই রাষ্ট্রকে তো বটেই, প্রতিবেশী দেশগুলোসহ গোটা অঞ্চলটিকেই মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেবে। আর সেই অবস্থায় এতদঞ্চলের ছোট ও দরিদ্র জাতিগুলোর অবস্থা কোন পর্যায়ে উপনীত হবে, তাই বড় চিন্তা।
ভারত ও পাকিস্তান ইতিমধ্যে কাশ্মীর নিয়ে তিন তিনটি যুদ্ধে জড়িয়েছে। ফলে আরেকটি সংঘাতের পরিণতি কতটা ভয়াবহ হতে পারে, তা তাদের অজানা নয়। সাত দশক আগে ব্রিটিশরা এই অঞ্চল থেকে চলে যাওয়ার সময়, তথা ভারত বিভাজনের সময় থেকেই ভারতের তুলনায় পাকিস্তান তুলনামূলক পিছিয়ে। রাজনৈতিক অস্থিরতা থেকে শুরু করে উদ্বেগজনক জঙ্গি বিদ্রোহ, জলবায়ু বিপর্যয় এবং অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলার মুখে ক্রমবর্ধমান চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন দেশটি। অন্যদিকে, ভারত আপাতদৃষ্টিতে বেশ শক্তিশালী অবস্থানেই রয়েছে। ভারতীয় সামরিক বাহিনীকে উন্নত হিসেবেই বিবেচনা করা হয়। অর্থনৈতিকভাবেও ভারত এগিয়ে—পাকিস্তানের চেয়ে ১০ গুণ বড় আকারের অর্থনীতি নিয়ে দিল্লির গর্ব করার কথা নতুন নয়।
তবে ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের ফরেন পলিসি প্রোগ্রামের সিনিয়র ফেলো তানভি মাদান মনে করেন, ‘সংঘাত আরো তীব্র হলে ভারতের অনেক কিছু হারাতে হতে পারে।’ মাদান অবশ্য এ-ও মনে করেন, ‘অতীতে আমরা যেমনটা প্রত্যক্ষ করেছি, তার ভিত্তিতে হিসাব করলে, এ দুই যুক্তিবাদী পক্ষ’ বৃহত্তর যুদ্ধের পথে সহসাই পা বাড়াতে চাইবে না।’
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বিশ্ব মঞ্চে ভারতের মর্যাদা বৃদ্ধির প্রতিশ্রুতি দিয়ে রেখেছেন। অলিম্পিক আয়োজনের দৌড়ে নাম লিখিয়েছে দিল্লি। উপরন্তু, চীনকে পেছনে ফেলে ‘বিশ্বের উৎপাদন কেন্দ্র’ হিসেবে জাতিকে গড়ে তোলার চেষ্টা করছেন মোদি। তবে এ রকম নানামুখী সমীকরণের প্রেক্ষাপটে ভারতকে নিরাপত্তা হুমকির মুখেও পড়তে হচ্ছে। বিশেষ করে, চীনের সঙ্গে সীমান্তে বিরোধপূর্ণ সম্পর্ক দিল্লির মাথাব্যথার বড় কারণ হয়ে উঠেছে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে।
এমন একটি পটভূমিতে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে এবারকার দ্বন্দ্ব-উত্তেজনা স্বাভাবিকভাবেই উদ্বেগ বাড়াচ্ছে। ‘অপারেশন সিঁদুর’ হামলার পর ভারত তড়িঘড়ি ঘোষণা করে যে, ২২ এপ্রিলের গণহত্যার বিষয়ে তাদের প্রতিক্রিয়া ছিল ‘সুনির্ধারিত, পরিমাপিত এবং অ-উত্তেজক’। তারা এ-ও স্পষ্ট করে বলেছে যে, এটা পর্যটকদের ওপর গণহত্যা চালানোর প্রতিক্রিয়া হিসেবে পরিচালিত অভিযানমাত্র। ভালো সংবাদ হলো, নয়াদিল্লির শীর্ষ কর্মকর্তারা এরই মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, মধ্যপ্রাচ্য ও রাশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ ও পক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। এর পেছনে সম্ভবত পাকিস্তানের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ তৈরি করাই তাদের উদ্দেশ্য। দ্য এশিয়া গ্রুপের সিনিয়র উপদেষ্টা নিশা বিসওয়াল এমনটাই মনে করেন।
অন্যদিকে, পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতারা নিজেদের বিমান বাহিনীর বিজয়ের কথা উল্লেখ করে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন। যদিও ভারতের নেতারা বিষয়টি পাশ কাটিয়ে গেছেন। এমনকি তারা এখন পর্যন্ত কোনো ভারতীয় বিমানের ক্ষয়ক্ষতির কথাও স্বীকার করেননি। তবে ফরাসি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সূত্র ভারতের একটি নতুন এবং সবচেয়ে উন্নত ‘রাফায়েল যুদ্ধবিমান’ নিখোঁজের কথা জানিয়েছে।
দক্ষিণ এশিয়া বিশ্লেষক কুগেলম্যানের যুক্তি হলো, ঐতিহাসিকভাবে এই সংকটে মধ্যস্থতাকারী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উত্তেজনা প্রশমণের চেষ্টা করতে পারে। তবে ট্রাম্প প্রশাসন কতটা আন্তরিক, তা এখনো স্পষ্ট নয়। চীন উত্তেজনা হ্রাসের আহ্বান জানিয়েছে বটে, কিন্তু ভারতের সঙ্গে তিক্ত সম্পর্কের কারণে বেইজিংয়ের কার্যকর মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করতে পারাটা স্বভাবতই দুরূহ। এক্ষেত্রে বরং শীর্ষ মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করতে পারে আরব উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলো—বিশেষ করে কাতার, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত। এর কারণ, উভয় পক্ষের সঙ্গেই এসব দেশের সুসম্পর্ক রয়েছে।
মূল কথা হলো, বেশির ভাগ বিশ্লেষক ‘উভয় দেশের সামনেই এই সংঘাত এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে’ বলে মনে করলেও যুদ্ধের গতিমুখ এখন পর্যন্ত উত্তেজনাপূর্ণ, অপ্রত্যাশিত ও বিপজ্জনক বলেই প্রতীয়মান।
লেখকদ্বয় : সাংবাদিক
সিএনএন থেকে ভাষান্তর : সুমৃৎ খান