সম্প্রতি নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত গণিত বিভাগের এক ছাত্রী আত্মহত্যা করেছেন। ঘটনাটি দেশ জুড়ে আলোড়ন তুলেছে। এর আগে চলতি বছরের ২৬ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের এক সাবেক শিক্ষার্থীও নিজের জীবন শেষ করেন। দুঃখজনক হলেও সত্য, সরকারি পরিসংখ্যান ও গবেষণা বলছে— প্রতি বছর শতাধিক শিক্ষার্থী আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছেন। যার বড় অংশই ঘটছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো ক্যাম্পাসে আত্মহত্যার ঘটনা বারবার আলোচনায় আসছে। শুধু গত বছরই বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে চার জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন, যা আমাদের জন্য ভয়াবহ সতর্কবার্তা।
শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার পেছনে নানা জটিল কারণ কাজ করে। গবেষণায় দেখা গেছে, সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখছে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর শিক্ষার্থীরা পরিবার থেকে দূরে গিয়ে নতুন পরিবেশে খাপ খাওয়ানোর চেষ্টা করেন। স্বাধীন জীবনের আনন্দ থাকলেও একাকিত্ব, পারিবারিক চাপ, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা, পড়াশোনার প্রতিযোগিতা এবং ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তায় তারা ক্রমে হতাশ হয়ে পড়েন। কেউ কেউ কোলাহল থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেন, আর শেষমেশ আত্মহননের পথ বেছে নেন।
তবে শুধু মানসিক চাপ নয়, সামাজিক বাস্তবতাও আত্মহত্যার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। পারিবারিক কলহ, প্রেমে ব্যর্থতা কিংবা বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপড়েনও বড় ভূমিকা রাখে। নেট দুনিয়ার অন্ধকার দিক— অনলাইন জুয়া, মাদকাসক্তি, পর্নোগ্রাফি কিংবা অতি উচ্চাভিলাষী জীবন যাপনের স্বপ্ন শিক্ষার্থীদের বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন করছে, আর যখন সেই স্বপ্ন ভেঙে যায় তখন তারা হতাশার গভীরে নিমজ্জিত হন।
গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, আত্মহত্যার শিকার শিক্ষার্থীদের মধ্যে নারীর সংখ্যা তুলনামূলকভাবে বেশি। এর কারণ হলো— একদিকে পারিবারিক নিয়ন্ত্রণ ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির চাপ, অন্যদিকে ক্যাম্পাস জীবনের প্রতিযোগিতা ও সম্পর্কের জটিলতা আটকে যাওয়া। সামাজিক লজ্জার ভয়ে অনেকেই সমস্যার কথা প্রকাশ করতে পারেন না, ফলে ভেতরে ভেতরে ভেঙে পড়েন।
প্রশ্ন হলো— দায় কার? শিক্ষার্থীর দুর্বলতা, নাকি পরিবার, সমাজ, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও রাষ্ট্রের উদাসীনতা? সত্যি বলতে, দায় এককভাবে কারো নয়। তবে সবচেয়ে বড় দায় আমাদের সামাজিক কাঠামো ও রাষ্ট্রীয় অবহেলার। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মানসিক স্বাস্থ্যসেবার কার্যকর ব্যবস্থা নেই। কোথাও নামমাত্র কাউনসেলিং ইউনিট থাকলেও সেখানে নেই পর্যাপ্ত জনবল বা প্রশিক্ষিত মনোরোগ বিশেষজ্ঞ। ফলে শিক্ষার্থীরা সংকটে পড়লে সহায়তা পান না। রাষ্ট্রও বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে দেখছে না। আমরা এখনো মনে করি, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি মানেই ভবিষ্যত্ নিশ্চিত, অথচ বাস্তবে শিক্ষার্থীদের নানা সংকট মোকাবিলা করতে হয়।
সমাধান কী? প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে মানসিক স্বাস্থ্যসেবাকেন্দ্র গড়ে তুলতে হবে, যেখানে থাকবে প্রশিক্ষিত কাউনসেলর ও মনোরোগ বিশেষজ্ঞ। প্রথম বর্ষ থেকেই শিক্ষার্থীদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক সেমিনার আয়োজন জরুরি। মনে রাখতে হবে— একজন শিক্ষার্থী শুধু নিজের জন্য নয় পরিবার, সমাজ এবং দেশের জন্যও অমূল্য সম্পদ। তাই তাদের জীবন রক্ষা মানে দেশের ভবিষ্যৎ রক্ষা করা।
লেখক : গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়।
(এই লেখা লেখকের একান্ত ব্যক্তিগত অভিমত; এ সংক্রান্ত কোনো দায় দৈনিক মূলধারা বহন করবে না)