খুব বড় বড় কথা বলেছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প! নির্বাচিত হলে রশিয়া-ইউক্রেন এবং হামাস-ইসরাইল সংঘাত বন্ধে তিনি দ্রুতই সফল হবেন বলে অঙ্গীকার করেছিলেন। যদিও নির্বাচিত হয়ে দায়িত্ব নেওয়ার ছয় মাস অতিক্রান্ত হওয়ার পর সংঘাত বন্ধ হওয়া তো দূরের কথা, এর তীব্রতা আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। গাজায় ছয় সপ্তাহের একটি যুদ্ধবিরতি স্থায়ী যুদ্ধ বন্ধে যেমন রূপ নিতে পারেনি, তেমনি রাশিয়া-ইউক্রেনের মধ্যকার সংঘাত থামেনি এক দিনের জন্যও। বরং বলতে হয়, মার্কিন শক্তিমত্তা নিয়ে এখন নানান প্রশ্ন উঠছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প কি রাজনৈতিক জ্ঞানের অভাব রাখেন কি না এবং এর ফলে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি আন্তর্জাতিক সংকট নিয়ন্ত্রণে আগের তুলনায় তার কার্যকারিতা হারিয়েছে কি না এসব নিয়ে চলছে অনেক বিশ্লেষণ। পশ্চিমা বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের একচ্ছত্র প্রভাব সাম্প্রতিক সময়গুলোতে অনেকটাই খর্ব হয়েছে, ইউরোপের সঙ্গে স্পষ্ট দূরত্ব আগামী দিনে ন্যাটোর প্রাসঙ্গিকতাকেও নতুন করে প্রশ্নের সম্মুখীন করেছে।
যে যুদ্ধও শুরু হয়েছিল আজ থেকে প্রায় সাড়ে তিন বছর আগে, এখানে ইউক্রেনের কতটা দায় ছিল বা রাশিয়ার কতটা আগ্রাসী মনোভাব এর মূলে ছিল, এসব কিছু বিশ্লেষণ করতে গেলে সবচেয়ে বড় যে সত্যটা বের হয়ে আসবে, সেটা বড়ই নিষ্ঠুর। রাশিয়ার আগ্রাসন থেকে ইউক্রেনকে নিরাপদ রাখার নাম করে কার্যত পরিকল্পিত কায়দায় পশ্চিমা স্বার্থকে সংরক্ষণ করতে বাধ্য করা হয়েছে ইউক্রেনকে। ফলে যখনই দেশটির কোনো সরকার দায়িত্ব নিয়েছে, সেই সরকারকে হয় রাশিয়া, না হয় পশ্চিমা স্বার্থের অনুকূলে কাজ করতে হয়েছে।

তবে এক্ষেত্রে রুশ স্বার্থের সহায়ক কোনো সরকারের পরণতি যেমন ভালো হয়নি, মার্কিন নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা সমর্থনপুষ্ট সরকারের পক্ষ্যেও নির্বিঘ্নে দেশ পরিচালনা করা সহজ ছিল না কখনো। ২০১৪ সালে ক্রিমিয়া দখল থেকে শুরু করে এই সাড়ে তিন বছরের যুদ্ধে ইউক্রেনের ২০ শতাংশের বেশি ভূখণ্ড দখলে নেওয়া রাশিয়ার বিরুদ্ধে সেরকম কার্যকর প্রতিরোধব্যবস্থা গড় তুলতে ব্যর্থ হয়েছে পশ্চিমা মদদপুষ্ট জেলেনেস্কি সরকার। যুদ্ধ বন্ধের প্রতিশ্রুতি দিলেও দায়িত্ব নেওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এখন এই যুদ্ধের জন্য বরং দোষারোপ করছেন জেলেনেস্কিকেই।
এটাই হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র! কয়েক মাস আগে যখন এ বিষয়ে আলোচনার জন্য জেলেনেস্কি আমন্ত্রিত হয়ে হোয়াইট হাউজে গেলেন, ফিরে এলেন অপমানিত হয়ে। এর মূলে ছিল আসলে জেলেনেস্কির সে সময়ের মার্কিন স্বার্থের অনুকূলে ইউক্রেনের বিরল খনিজ পদার্থে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রবেশাধিকার দিতে অনীহা। ব্যস, এই যুদ্ধের সমস্ত দায় গিয়ে পড়ল তার ওপর! যে যুদ্ধ তারা যুক্তরাষ্ট্রের কথায় শুরু করেছে, তাদের সহায়তা ছাড়া এটা চালিয়ে নেওয়া অসম্ভব, তাছাড়া কেবল ইউরোপীয় মিত্রদের সহায়তাও যথেষ্ট নয়, এমন উপলব্ধি থেকে একপর্যায়ে গত এপ্রিল মাসে ট্রাম্পের কথামতো ইউক্রেনের বিরল খনিজসম্পদের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের প্রবেশাধিকারসংক্রান্ত একটা চুক্তি করতে বাধ্য হয় ইউক্রেন। এর পরও বাইডেনের শাসনামল অবসানের পর রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে পর্যাপ্ত রসদ সরবরাহে ট্রাম্পের দ্বিধাহীনতা কাটেনি। এর মূল কারণ পুতিনের সঙ্গে তার দীর্ঘদিনের কথিত সুসম্পর্ক, যা স্বার্থের নিরিখে বিচার্য বলে অভিমত অনেকের।
যে যুদ্ধের অবসানে ট্রাম্পের পূর্বসূরি বাইডেন কোনো কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেননি, সেই অসম্ভব কাজকে ট্রাম্প কীভাবে সম্ভব করবেন, এটা নিয়ে যে প্রশ্ন আসেনি তা নয়, তার পরও সবার এটাই চাওয়ার ছিল, যদি ট্রাম্পের সঙ্গে পুতিনের সুসম্পর্ক দিয়ে এর অবসান ঘটানো যায়, তাও ভালো। তবে ট্রাম্প যেমন ব্যাবসায়িক চরিত্রকে তার রাজনৈতিক অভিলাষের বাইরে রাখতে পারেননি, পুতিনও এই সুযোগে রাশিয়ার ভূখণ্ডকে সম্প্রসারিত করার অভিপ্রায়কে হাতছাড়া করতে চাইছেন না, আর এই দরকষাকষিতে এই দুজনের দুরভিসন্ধির কাছে নতুন করে বলি হচ্ছে ইউক্রন। বিরল খনিজ পদার্থে প্রবেশাধিকার নিয়ে চুক্তি তো হয়েই গেছে, এরই মধ্যে ইউক্রেনের বিপুল পরিমাণ লিথিয়াম মজুত নিয়ে নতুন করে মার্কিন প্রতিষ্ঠানের (যে প্রতিষ্ঠান ট্রাম্পের অতি ঘনিষ্ঠ) কার্যাদেশ পাওয়ার সম্ভাবনাকে কেন্দ্র করে তিনি সম্প্রতি পুতিনের উদ্দেশে নতুন করে যুদ্ধবিরতি চুক্তি করতে একটা সময়সীমা বেঁধে দিয়েছেন, যা অমান্য করলে রাশিয়াকে আরো কঠিন নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়তে হবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। জবাবে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন তার শর্তের বাইরে কোনো ধরনের যুদ্ধবিরতি চুক্তি সম্পাদনে তার আগের অবস্থানের জানান দিয়েছেন। এক্ষেত্রে ট্রাম্পের যা করার থাকতে পারে, তা হচ্ছে ইউক্রেনকে এতদিন ধরে বন্ধ রাখা সামরিক সহায়তা পুনরায় জোগান দেওয়া, যা তিনি দেবেন বলে সম্প্রতি জানিয়েছেন। তবে তা বাইডেনের সময়কালের মতো এত বিশাল নয়, বলা যায় ইউক্রেনের কাছ থেকে অনেক কিছু নেওয়ার বিনিময়ে কিছুটা ফিরিয়ে দেওয়ার মতো। আর দিন শেষে তিনি রাশিয়ার ওপর নতুন করে নিষেধাজ্ঞার যে হুমকি দিয়েছেন, তা কতটা বাস্তবায়ন করতে পারবেন, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে অনেক। সবাই জানে তিনি পুতিনকে বিশেষ সমীহ করেন, হয়তো ভয়ও করেন।
যে কারণে ইউক্রেনের সঙ্গে রাশিয়ার যুদ্ধবিরতি নিয়ে খুব সহসা কোনো ধরনের চুক্তি হওয়ার সম্ভাবনা নেই, এর মূলে রয়েছে রাশিয়ার দিক থেকে তাদের সিদ্ধান্ত পরিবর্তনে অনমনীয়তা। এখানে পুতিন চুক্তির পূর্বশর্ত হিসেবে খুব স্পষ্ট করে চারটি শর্তের বিষয়ে জানিয়ে দিয়েছেন; প্রথমত, এতদিন ধরে ইউক্রেনের যে ভূমিগুলো রাশিয়া দখল করেছে, এর স্বীকৃতি দিতে হবে; দ্বিতীয়ত, ইউক্রেনকে নিরপেক্ষ থাকতে হবে এবং তার সেনাবাহিনীর ক্ষমতার সীমা থাকতে হবে; তৃতীয়ত, ইউক্রেনে বসবাসরত রুশভাষীদের অধিকার রক্ষা করতে হবে এবং চতুর্থত, ন্যাটো আর পূর্বদিকে অগ্রসর হতে পারবে না। এখানে উল্লিখিত শর্তগুলোর মধ্যে অনানুষ্ঠানিকভাবে যতটুকু জানা গেছে, তা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র নীতিগতভবে ইউক্রেনের ন্যাটোতে যোগদানের ক্ষেত্রে রাশিয়ার এই দাবিকে মেনে নিলেও অপরাপর বিষয়গুলো সম্পূর্ণ ইউক্রেনের আওতাভুক্ত, যা ইউক্রেন ইতিমধ্যে নিজেদের সার্বভৌমত্বের যুক্তিতে নাকচ করে দিয়েছে। তাছাড়া, ন্যাটোতে ইউক্রেনের যোগদনের ক্ষেত্রে মার্কিনিদের সঙ্গে ইউরোপীয় দেশগুলোর স্পষ্ট মতপার্থক্য রয়েছে। ইউরোপ কেবল ইউক্রেন নয়, নিজেদের নিরাপত্তার দৃষ্টিকোণ থেকেও ইউক্রেনকে নিরাপদ করতে চায় এবং ভবিষ্যতে রাশিয়ার পূর্বমুখী বিস্তারের সম্ভাবনা থেকে নিশ্চিত হতে চায়। অথচ ট্রাম্প দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই চলমান দ্বন্দ্ব-সংঘাত আরো প্রকট হয়েছে, যা কিয়েভকে রেখেছে নতুন নতুন রুশ আক্রমণের ঝুঁকির মুখে।
ইউক্রেনের অভ্যন্তরে রাশিয়ার অধিকৃত অঞ্চল ক্রমেই বিস্তৃত হচ্ছে এবং গত ফেব্রুয়ারি মাস থেকে তারা নতুন করে ১৪১৫ বর্গকিলোমিটার এলাকা দখল করে নিয়েছে। বর্তমানে ক্রিমিয়া (২০১৪ সাল থেকে) ছাড়াও পুরো লুহানস্ক, দানেস্ক, জাপরোঝিয়া এবং খেরসানের ৭০ শতাংশের অধিক এবং খারকিভ এবং ডিনিপ্রোপেটোভস্কের অংশবিশেষ রাশিয়ার দখলে রয়েছে। এখানে বলে রাখা ভালো যে, ট্রাম্প দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ইউক্রেনকে দেওয়া সহায়তা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর তারা কেবল ইউরোপীয় মিত্র দেশগুলোর সহায়তায় রাশিয়ার বিরুদ্ধে সীমিত পরিসরে প্রতিরোধ কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছিল। সাম্প্রতিক সময়ে এসে তাই রাশিয়ার উদ্দেশে ট্রাম্পের নতুন এই হুঁশিয়ারি রাশিয়ার মনে নতুন করে কোনো ভয়ের সঞ্চার করতে পারবে কি না সেটা বুঝতে হলে আমাদের জানতে হবে, এই যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার মতো আর্থিক সঙ্গতি রাশিয়ার এখনো রয়েছে কি না।
এক্ষেত্রে আমরা যদ্দুর জানতে পারি, তা হচ্ছে যুদ্ধ শুরুর পর থেকে রাশিয়া নতুন নতুন অনেক নিষেধাজ্ঞার আওতায় এলেও তাদের অর্থনীতিকে তেমন ধসানো যায়নি। এক্ষেত্রে চীন এবং ভারতের মতো দেশগুলো আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে রাশিয়া থেকে তেল এবং গ্যাস আমদানি অব্যাহত রাখে। গত বছর তাদের প্রবৃদ্ধি ছিল ৪.৩ শতাংশ এবং এ বছর তা ২.৫ শতাংশ অর্জিত হবে বলে ধারণা করা যচ্ছে। আর ট্রাম্পের নিষেধাজ্ঞার যে হুমকি রয়েছে, সেগুলো রাশিয়ার জন্য নতুন নয়, যা তদের জন্য নতুন কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে। এক্ষেত্রে ট্রাম্প নতুন করে কার্যত গোটা বিশ্বের সঙ্গে যে বাণিজ্য যুদ্ধের সূচনা করেছেন, এর আওতায় রাশিয়ার পণ্য বর্জনের শর্তে চীন এবং ভারতের জন্য তাদের শুল্কহার কমানোর বিষয়ে প্রস্তাব দিতে পারেন, তবে এটি খুব একটা কাজে আসার সম্ভাবনা নেই। এর কারণ হচ্ছে বিশ্বের এমন দুটি বড় অর্থনীতির সঙ্গে সংঘাত কার্যত যুক্তরাষ্ট্রকেই ক্ষতিগ্রস্ত করবে। আর তাছাড়া তিনি জানেন, রাজনৈতিক অভিজ্ঞতায় তিনি পুতিনের তুলনায় অনেক নবিশ। এক্ষেত্রে ইউরোপকে আস্থায় নিয়ে রাশিয়ার সঙ্গে সমঝোতা ছাড়া এই যুদ্ধ অবসানের কোনো উপায় আছে বলে মনে হয় না।
লেখক : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
(এই লেখা লেখকের একান্ত ব্যক্তিগত অভিমত; এ সংক্রান্ত কোনো দায় দৈনিক মূলধারা বহন করবে না)