বাংলা ক্যালেন্ডারের ১১ জ্যৈষ্ঠ, আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মদিন। বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে তাকে জাতীয় কবির স্বীকৃতি দেওয়ার পর আশা করেছিলাম, তার জন্মজয়ন্তী জাঁকজমকভাবে পালন করা হবে। কিন্তু যেমনটা আশা করেছিলাম তেমনটা যে হয়নি, তা যে কোনো নজরুলভক্তকে জিগ্যেস করলেই তার সদুত্তর পাওয়া যাবে। এই দিন দেশে বা রাজধানীতে কতটা আড়ম্বর ও আন্তরিকতার সঙ্গে তাকে স্মরণ করা হয়েছে এবার? সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কিছু পোস্ট, কিছু আনুষ্ঠানিক অনুষ্ঠান—এই সীমিত পরিসরেই যেন আটকে আছে নজরুল স্মরণ। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। অথচ এই কবিই একদিন আমাদের অস্তিত্বের লড়াইয়ে সাহস ও চেতনার অনন্ত উৎস ছিলেন।
স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশে যখন সাহিত্য-সংস্কৃতির দিকনির্দেশনায় শূন্যতা দেখা দেয়, জাতি তখন ফিরে তাকায় বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের দিকে। মুক্তিযুদ্ধে ‘চল্ চল্ চল্’, ‘কারার ঐ লৌহকপাট’ বা ‘নিম্নে উতলা ধরণীতল’—এসব গান কেবল সুর নয়, ছিল সংগ্রামের মন্ত্র। তার কবিতা ও গান মুক্তিযোদ্ধাদের প্রেরণা জুগিয়েছে। নজরুলের গান ‘অরুণ প্রাতের তরুণ দল’ দুঃসময়ে সাহসী তরুণদের সাহস জুগিয়েছে, নেতৃত্বে উজ্জীবিত করেছে।
তবে এ-ও সত্য, নজরুলের প্রাপ্য সম্মান শুধু যুদ্ধকালীন প্রেরণার জন্য নয়, তিনি ছিলেন সাম্য, মানবতা ও অসাম্প্রদায়িকতার চিরপ্রবহমান কণ্ঠ। তার চিন্তা ও দর্শন আজও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। কিন্তু আমরা কি সেই গভীরতা নিয়ে নজরুলকে ধারণ করেছি?
নজরুলকে ঘিরে কিছু গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ অবশ্যই গ্রহণ করা হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে তাকে সমাহিত করা হয়েছে, প্রতিষ্ঠিত হয়েছে নজরুল ইনস্টিটিউট, তার নামে একটি বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠেছে এবং সরকারিভাবে জন্ম ও মৃত্যু দিবস পালন করা হয়। ১৯৭২ সালে খোদ সরকার প্রধানের উদ্যোগে ভারতে অবস্থানরত নজরুলকে বাংলাদেশে আনা হয় এবং নাগরিকত্ব প্রদান করা হয়। সে সময় কবি ছিলেন শারীরিক ও মানসিকভাবে অক্ষম, বাক্রুদ্ধ। তার পরও তাকে ঘিরে জাতি পেয়েছিল এক আত্মিক শক্তির উত্স।
নজরুলের শবযাত্রায় রাষ্ট্রপ্রধান, সশস্ত্র বাহিনীর তিন প্রধান, জ্ঞানী-গুণী জনসহ অসংখ্য মানুষ উপস্থিত ছিলেন। আবালবৃদ্ধবনিতা-ধর্মবর্ণগোত্র-নির্বিশেষে মানুষ এই মহত্ কবির বিদায়ে একাত্ম হয়ে দাঁড়িয়েছিল। নজরুল জীবিত অবস্থায় লিখেছিলেন—‘মসজিদের পাশে আমায় কবর দিও ভাই, সেখান থেকে মুয়াজ্জিনের যেন আজান শুনতে পাই’—জাতি তার সেই চাওয়াকে শ্রদ্ধাভরে বাস্তবায়ন করেছিল।
তবে এই সম্মান ও স্মরণ শুধু কাগজে কলমে থাকলে চলবে না। বাস্তবতা হলো, নজরুলকে আমরা পূর্ণভাবে আত্মস্থ করতে পারিনি। এখনো তার রচনাকে রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে কাটাছেঁড়া করা হয়। অনেক সময় তার গান বিকৃত সুরে পরিবেশিত হয়, যা তার মূল চেতনার অবমাননা। পাঠ্যক্রমে তার স্থান সীমিত, বিশেষত ইংরেজি মাধ্যমের পাঠ্যবইয়ে তার উপস্থিতি প্রায় নেই বললেই চলে।
তরুণ প্রজন্মের অনেকেই নজরুলের নাম জানে, কিন্তু তার দর্শন, কবিতা ও গান তাদের জীবনে প্রবেশ করতে পারেনি। সামাজিক ও শিক্ষাগত পরিমণ্ডলে নজরুলচর্চা একরকম উত্সবভিত্তিক এবং দায়িত্বশীল নয়। অথচ আজকের বাংলাদেশে বৈষম্য, ধর্মীয় উগ্রতা ও মূল্যবোধের অবক্ষয়ের বিপরীতে নজরুল হতে পারতেন সবচেয়ে শক্তিশালী কণ্ঠস্বর।
নজরুল বলেছিলেন, ‘আমি ধর্মের খোঁজ করি না, খোঁজ করি মানুষের।’ এই একটি বাক্যেই লুকিয়ে আছে আজকের সমাজের প্রয়োজনীয় চিকিত্সা। অথচ আমরা তাকে সংরক্ষণ করেছি ফ্রেমে, সংকলনে কিংবা দিবসভিত্তিক কিছু কর্মসূচিতে। নজরুলের অসাম্প্রদায়িক চেতনা এখনো অনেকের কাছে অস্বস্তিকর, ফলে তাকে পরিপূর্ণভাবে গ্রহণে আমরা দ্বিধান্বিত।
এখন সময় এসেছে নতুন করে নজরুলকে কাজে লাগানোর। তাকে আর কেবল স্মরণ করার জন্য নয়, বরং নতুন বাংলাদেশ গড়ার জন্য প্রয়োজন। তার বিদ্রোহ এখন দরকার চেতনায়, জাতি গঠনের ভিত রচনায়। প্রয়োজন নজরুলকে পাঠ্যক্রমে সঠিকভাবে অন্তর্ভুক্ত করা, তরুণ প্রজন্মকে তার গান-কবিতার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া এবং সাংস্কৃতিক অঙ্গনে তার ভাবনাকে নীতিগতভাবে গুরুত্ব দেওয়া।
নজরুল আমাদের ইতিহাসের অংশ নন মাত্র, তিনি হতে পারেন আমাদের ভবিষ্যতের দিশারি।