বাংলাদেশ সুজলা সুফলা নদীমাতৃক দেশ। এ দেশের মানুষ সত্যিই আগে অতি স্বাচ্ছন্দ্যময় জীবন যাপন করত। গোলা ভরা ধান আর গোয়াল ভরা গরু—এর অর্থ ছিল এ দেশের মানুষ ছিল পুষ্টিসমৃদ্ধ জাতি। পুষ্টির কোনো অভাব ছিল না গ্রামপ্রধান এই সবুজ মাতৃভূমির। কিন্তু সময় যত গড়াচ্ছে দিন তত পরিবর্তিত হচ্ছে। আমরা যখন ছোট ছিলাম বা ৭০/৮০ বছর আগে ডায়াবেটিস রোগটি অত্যন্ত আভিজাত্যের রোগ ছিল। এই রোগটি যেমন-তেমন মানুষের হতো না। রোগটি হতো বিশেষ অভিজাত শ্রেণির, যারা নেহাতই উন্নত জীবন যাপনে অভ্যস্ত। কিন্তু বর্তমানে রোগটি অত্যন্ত সস্তা হয়ে গরিব-ধনী, অভিজাত-অনভিজাত সবার মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে।
আগে শোনা যেত যক্ষ্মা হলে রক্ষা নেই, ক্যানসারের অ্যানসার নেই ইত্যাদি। তবে এটাও ঠিক ১০/২০/৫০ বছর আগে গ্রামে তখন ক্যানসারের রোগী পাওয়া বড়ই ভার ছিল; যা এখন বলতে গেলে পাড়ায় পাড়ায়। যক্ষ্মার হাত থেকে মানুষকে কিছুটা রক্ষা করেছে যে বিষয়টি, তার মধ্যে অন্যতম টিকা এবং জনসচেতনতা যা জনস্বাস্থ্য শিক্ষার একটি প্রায়োগিক ব্যবস্থাপনা। জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির তথ্যমতে, ২০১৫ সালে শনাক্ত রোগী ছিল ২ লাখ ৯ হাজার ৪৩৮ জন। ২০২৩ সালে সেটি বেড়ে দাঁড়ায় ৩ লাখ ১ হাজার ৫৬৪ জনে, এর মধ্যে ২ হাজার ৪৩৭ জন রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর। শনাক্ত রোগীদের মধ্যে ৫৬ শতাংশ পুরুষ ও ৪২ শতাংশ নারী। ওষুধ-প্রতিরোধী-যক্ষ্মা/ড্রাগ-রেজিস্ট্যান্ট-টিবি (ডিআর-টিবি)/ মালটিড্রাগ-রেজিস্ট্যান্ট-টিবি (এমডিআর-টিবি) রোগীর সংখ্যা ২ হাজার ৭২৯ জন। সরকারি হিসাবে, ২০১৫ সালে যক্ষ্মায় মৃত্যু হয়েছিল প্রতি লাখে ৪৫ জনের। ২০২৩ সালে সেটি কমে প্রতি লাখে হয়েছে ২৫ জন। সে হিসাবে দেশে যক্ষ্মায় মৃত্যু ৪২ শতাংশ কমেছে।
জনস্বাস্থ্য হলো রোগপ্রতিরোধ, জীবন দীর্ঘায়িত করা ও সমাজ, সংস্থা, সরকারি ও বেসরকারি খাত, সম্প্রদায় এবং নাগরিকদের সম্মিলিত ও সংগঠিত প্রচেষ্টা। স্বাস্থ্যের প্রচারের বিজ্ঞান ও শিল্প। এটি একটি বিস্তৃত ও বহুমুখী ক্ষেত্র, যা স্বাস্থ্যের বিভিন্ন দিক; যেমন—মহামারিবিদ্যা, জৈব পরিসংখ্যান, পরিবেশগত স্বাস্থ্য, সামাজিক ও আচরণগত বিজ্ঞান, স্বাস্থ্যনীতি ও ব্যবস্থাপনা এবং স্বাস্থ্য যোগাযোগকে অন্তর্ভুক্ত করে।
জনস্বাস্থ্যের বিষয়টি আজ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এটি স্বাস্থ্যগত চ্যালেঞ্জ ও সুযোগগুলিকে মোকাবিলা করে, যা মানুষ ও সমাজের সুস্থতার ওপর চরম প্রভাব ফেলে। জনস্বাস্থ্য পুষ্টির গুরুত্ব স্বীকার করে, কারণ এটি মানুষের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ফেলে। উন্নয়নশীল দেশগুলিতে জনস্বাস্থ্যের গুরুত্ব বেশি। কারণ এটি এসব দেশে স্বাস্থ্যবৈষম্য হ্রাস করার চেষ্টা করে। এজন্য জনস্বাস্থ্যের ওপর স্নাতকোত্তর অধ্যয়ন এক তাত্পর্যপূর্ণ বিষয়। এটি শিক্ষার্থীদের জনস্বাস্থ্য অনুশীলন, গবেষণা ও নীতিতে নেতৃত্বের ভূমিকার জন্য প্রস্তুত করে।
জনস্বাস্থ্যের লক্ষ্য হলো জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যচাহিদা ও চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা, বিশেষ করে যারা দুর্বল, প্রান্তিক বা সুবিধাবঞ্চিত। টিকাদান, স্যানিটেশন, রোগ নজরদারি, প্রাদুর্ভাব মোকাবিলা, স্বাস্থ্য প্রচার এবং স্বাস্থ্য-শিক্ষার মতো জনস্বাস্থ্যমূলক পদক্ষেপগুলি সংক্রামক ও অ-সংক্রামক রোগ, আঘাত ও প্রতিবন্ধকতার বোঝা প্রতিরোধ বা হ্রাস করতে পারে। এভাবেই জনস্বাস্থ্য জনগণের স্বাস্থ্য রক্ষা করে এবং উন্নত করে।
বিশেষ করে, জনস্বাস্থ্য শিক্ষা বিভিন্ন দেশ ও অঞ্চলের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। মানুষের উত্পাদনশীলতা বৃদ্ধি করতে পারে, কর্মে অনুপস্থিতি কমাতে পারে, মানবসম্পদ বৃদ্ধি করতে পারে এবং উদ্ভাবনকে উদ্দীপিত করতে পারে। মহামারি, জৈব সন্ত্রাসবাদ, অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল প্রতিরোধ, জলবায়ু পরিবর্তন এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের মতো উদীয়মান এবং বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্যহুমকির প্রতি সাড়া দেওয়ার জন্য জনস্বাস্থ্য শিক্ষা অপরিহার্য।
বাংলাদেশে একটি বিশাল ও বৈচিত্র্যময় জনসংখ্যা রয়েছে, যারা বিভিন্ন স্বাস্থ্য চ্যালেঞ্জ ও সুযোগের মুখোমুখি। বাংলাদেশে জনস্বাস্থ্যের একটি দীর্ঘ ও সমৃদ্ধ ইতিহাস রয়েছে, প্রাচীনকাল থেকে যেখানে স্বাস্থ্যবিধি, স্যানিটেশন ও রোগ প্রতিরোধ বিষয়ে অনুশীলন করা হতো। বাংলাদেশে জনস্বাস্থ্য শিক্ষাও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিকশিত হয়েছে। বাংলাদেশে এর বিস্তৃত ও গতিশীল পরিধি রয়েছে, যা স্বাস্থ্যের বিভিন্ন ক্ষেত্র এবং মাত্রাকে অন্তর্ভুক্ত করে।
বাংলাদেশে জনস্বাস্থ্যের কিছু গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র হলো :১. সংক্রামক রোগ, যেমন—বাংলাদেশে ডেঙ্গু, যক্ষ্মা, ম্যালেরিয়া, এইচআইভি/এইডস এবং কোভিড-১৯-এর মতো সংক্রামক রোগের উচ্চ চাপ রয়েছে, যা দেশের স্বাস্থ্য ও উন্নয়নের জন্য একটি বড় হুমকি। বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্য বিভাগ টিকাকরণ, রোগ নির্ণয়, চিকিৎসা, নজরদারি এবং গবেষণার মতো কৌশলগুলির মাধ্যমে এই রোগগুলি প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল করার জন্য কাজ করে যাচ্ছে।
২. অসংক্রামক রোগ :বাংলাদেশও অসংক্রামক রোগের, যেমন—হূদেরাগ, ডায়াবেটিস, ক্যানসার এবং দীর্ঘস্থায়ী শ্বাসযন্ত্রের রোগের ক্রমবর্ধমান বোঝার মুখোমুখি হচ্ছে। বাংলাদেশে জনস্বাস্থ্য খাত এই রোগগুলি প্রতিরোধ, পরিচালনা এবং হ্রাস করার জন্য আরো গতিশীল হওয়া দরকার। ৩. মাতৃ ও শিশুস্বাস্থ্য :বাংলাদেশে জনস্বাস্থ্য খাত পরিবার পরিকল্পনা, পুষ্টি, বুকের দুধ খাওয়ানো, নবজাতকের যত্ন এবং কিশোর স্বাস্থ্যের মতো কৌশলগুলির মাধ্যমে মাতৃ ও শিশুর স্বাস্থ্যের অবস্থা উন্নত করার জন্য অভূতপূর্ব ভূমিকা রাখতে পারে। ৪. পরিবেশগত স্বাস্থ্য :বাংলাদেশে জনস্বাস্থ্য পর্যবেক্ষণ, নিয়ন্ত্রণ, অ্যাডভোকেসি এবং শিক্ষার মতো কৌশলগুলির মাধ্যমে পরিবেশগত স্বাস্থ্যের অবস্থা রক্ষা এবং উন্নত করার জন্য অনন্য সাধারণ ভূমিকা পালনের সুযোগ রয়েছে। সর্বোপরি ৫. স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ও নীতি :বাংলাদেশে জনস্বাস্থ্য প্রশাসন, অর্থায়ন, মানবসম্পদ, গুণমান, ন্যায্যতা জবাবদিহির মতো কৌশলগুলির মাধ্যমে স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে শক্তিশালী ও সংস্কার করার জন্য মুখ্য ভূমিকা পালন করতে পারে।
জনস্বাস্থ্য এমন একটি ক্ষেত্র, যার অনেক বৈশিষ্ট্য রয়েছে; যেমন—জনস্বাস্থ্য বিভিন্ন শাখার জ্ঞান ও দক্ষতার ওপর নির্ভর করে; যেমন—চিকিৎসা, নার্সিং, দন্তচিকিৎসা, ফার্মেসি, কীটতত্ত্ব, জীব পরিসংখ্যান, সমাজকর্ম, মনোবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, নৃবিজ্ঞান, অর্থনীতি, আইন ও প্রকৌশল। জনস্বাস্থ্য অনুশীলন, নীতি ও গবেষণাকে অবহিত ও পরিচালনা করার জন্য বৈজ্ঞানিক প্রমাণ ও তথ্যের ওপর নির্ভর করে। এটি ব্যক্তির চেয়ে জনসংখ্যার স্বাস্থ্যের ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে এবং জনসংখ্যার মধ্যে স্বাস্থ্য ও রোগের বণ্টন ও নির্ধারক বিবেচনা করে। জনস্বাস্থ্য অনেক সুযোগ এবং চ্যালেঞ্জও প্রদান করে, কারণ এর জন্য ক্রমাগত শিক্ষা, উদ্ভাবন ও পরিবর্তিত স্বাস্থ্যচাহিদা ও প্রেক্ষাপটের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়া প্রয়োজন।
জনস্বাস্থ্য সম্পর্কে আরো জানতে বিশেষ করে এর প্রায়োগিক জ্ঞান আহরণ প্রয়োজন। এজন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংস্থা দ্বারা পরিচালিত জনস্বাস্থ্য কোর্স বা মানব উন্নয়ন কোর্সে ভর্তি হওয়া যেতে পারে। অর্জন করা যেতে পারে জনস্বাস্থ্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি।
তবে তার জন্য প্রয়োজন মানসম্মত উন্নত বিশ্ববিদ্যালয়। প্রয়োজন আরো বিশেষায়িত জ্ঞানের চর্চা। এক্ষেত্রে জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসাপ্রতিষ্ঠান নিপসম দ্বারা প্রদত্ত স্পেশালাইজড মাস্টার অব পাবলিক হেলথ (MPH) প্রোগ্রামের মতো জনস্বাস্থ্য প্রোগ্রামে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জনের ব্যবস্থা রয়েছে। বাংলাদেশে এর গতিশীলতা বাড়াতে এটিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর এখন সময়ের দাবি।
সারা বিশ্বে রোগপ্রতিরোধ, স্বাস্থ্যকর জীবনধারা প্রচার এবং স্বাস্থ্যসেবার ন্যায্য অ্যাক্সেস নিশ্চিত করার মাধ্যমে সমগ্র জনসংখ্যার স্বাস্থ্য সুরক্ষা এবং উন্নতির জন্য জনস্বাস্থ্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে, এমন বৃহত্তর সামাজিক কারণগুলি মোকাবিলায় তারা পালন করছেন সহায়ক ভূমিকা। যার ফলে নাগরিকরা দীর্ঘ আয়ুর অধিকারী হয়, স্বাস্থ্যসেবায় ব্যয় হ্রাস পায় এবং জীবনযাত্রার মান উন্নত হয়।
এমনি করে জনস্বাস্থ্যের প্রকৃত সুবিধা সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে প্রয়োজন আরো গবেষণা, উন্নত মানের ল্যাব ফ্যাসিলিটি এবং দক্ষ ও অভিজ্ঞ বিশেষজ্ঞ ব্যক্তি। এ ব্যাপারে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে আসছে জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিত্সাপ্রতিষ্ঠান নিপসম। এখন এই স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানটিকে স্পেশালাইজড বিশ্ববিদ্যালয়, অর্থাৎ পাবলিক হেলথ বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর করা একান্ত দরকার। যাতে বিভিন্ন সংক্রামক-অসংক্রামক রোগ বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে জনস্বাস্থ্যবিষয়ক সব সমস্যার যথাযথ ও বিজ্ঞানভিত্তিক সমাধান আমরা লাভ করতে পারি। আমরা আশা করি, এরূপ পদক্ষেপ নেওয়া হলে তা এ দেশের সব শ্রেণি-পেশার মানুষের সুস্থতা নিশ্চিত করে একটি উপভোগ্য জীবন উপহার দিতে সক্ষম হবে।
লেখক : অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, কীটতত্ত্ব বিভাগ, জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসাপ্রতিষ্ঠান (নিপসম), মহাখালী, ঢাকা