মধ্যপ্রাচ্য সফরে রয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এ সফরে তিনি আমেরিকার জন্য কী ধরনের সাফল্য বয়ে আনবেন, তা ‘প্রচলিত কূটনীতি’ দিয়ে পরিমাপযোগ্য নয়। ১৩ মে সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদে উড়ে যান ট্রাম্প। তিন দিনব্যাপী সফরে সৌদি আরবে পৌঁছেই প্রাথমিক বৈঠক সারেন সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের সঙ্গে। এরপর সৌদি-মার্কিন বিনিয়োগ ফোরামে দুই দেশের মধ্যে কয়েকটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
হোয়াইট হাউজ সূত্রে জানা গেছে, এ দিন রিয়াদের সঙ্গে ১৪২ বিলিয়ন ডলারের ‘ইতিহাসের সবচেয়ে বড় সামরিক সরঞ্জাম বিক্রির চুক্তি’ হয়েছে ওয়াশিংটনের। বিবৃতিতে বলা হয়, অস্ত্র বিক্রি চুক্তির আওতায় মোট পাঁচটি খাত রয়েছে; এগুলো হলো—বিমানবাহিনীর আধুনিকায়ন ও মহাকাশ সক্ষমতা, আকাশ ও ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থা, সমুদ্র ও উপকূলীয় নিরাপত্তা, সীমান্ত নিরাপত্তা ও স্থলবাহিনীর আধুনিকায়ন এবং তথ্য ও যোগাযোগব্যবস্থা আধুনিকায়ন।
হোয়াইট হাউজের বিবৃতিতে আরো বলা হয়, চুক্তির আওতায় সৌদি আরবের সশস্ত্র বাহিনীর সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য দেশটির সেনাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে। কাজ করা হবে সৌদি আরবের সামরিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং সামরিক চিকিত্সাসেবার উন্নয়নে। অস্ত্র চুক্তি ছাড়াও দুই দেশের মধ্যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, গ্যাস টারবাইন, উড়োজাহাজসহ বিভিন্ন বিষয়ে চুক্তি হয়েছে। চুক্তি স্বাক্ষরের পর মোহাম্মদ বিন সালমানকে ‘অসাধারণ একজন মানুষ’ অভিহিত করে ট্রাম্প বলেন, সৌদি আরব একটি ‘চমত্কার জায়গা’। এখানে ‘চমত্কার মানুষ’ বসবাস করেন।
বিশ্লেষকদের ধারণা ছিল, শান্তিচুক্তি বা অস্ত্র বিক্রির বিষয়কে সামনে রেখেই মধ্যপ্রাচ্য সফরের সিদ্ধান্ত নিয়েছে ট্রাম্প প্রশাসন। যদিও সিরিয়ার বর্তমান নেতৃত্বের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়ে, সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানকে ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করে আব্রাহাম চুক্তিতে যোগদানের আহ্বান জানিয়ে এবং রিয়াদকে ঐতিহাসিক অস্ত্র প্যাকেজে রাজি করিয়ে এরই মধ্যে ‘চমক সৃষ্টি’ করেছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প।
তবে এসব সংবাদের ভিড়ে ট্রাম্পের এই সফরকে আলাদা করে দেখার অবকাশ রয়েছে এই কারণে যে, মধ্যপ্রাচ্য থেকে যুক্তরাষ্ট্র সম্ভবত শত শত বিলিয়ন ডলারের নতুন বিনিয়োগ পেতে চাইছে এবং সফরে এর ওপরেই বেশি মনোযোগ থাকবে। জানা যায়, শুধু সৌদি আরব থেকেই ৬০০ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ পেতে পারে যুক্তরাষ্ট্র।
আমেরিকার উপসাগরীয় অংশীদার ও মিত্ররা ট্রাম্পের এ সফরে স্বভাবতই তীক্ষ্ন দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকবে ট্রাম্প প্রশাসনের দিকে। ট্রাম্পের এই সফরের সাফল্য পরিমাপ করতে তারা সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং সৌদি আরবের কাছে উন্নত সেমিকন্ডাক্টর চিপ বিক্রির ওপর থেকে ট্রাম্প প্রশাসন নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয় কি না, সেটা বিবেচনা করবে। অন্যদিকে, চীনাদের তুলনায় উপসাগরীয় রাজতন্ত্রের সঙ্গে মার্কিনিদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক নিশ্চিত করার বিষয়েও সবার সতর্ক দৃষ্টি থাকবে। যদিও বেইজিং উপসাগরীয় দেশগুলোর সবচেয়ে বড় জীবাশ্ম জ্বালানি গ্রাহক।
যাহোক, মধ্যপ্রাচ্যের নিরাপত্তা হুমকি বা শান্তি আলোচনার সময় শেষ হয়ে গেছে, এমন নয়। ফলে এ নিয়ে ট্রাম্প কী ভাবছেন, সেদিকেও খেয়াল রয়েছে সবার। সবাই তাকিয়ে আছে, গাজা যুদ্ধ নিয়ে কী সিদ্ধান্ত আসে এবং হামাসের হাতে এডান আলেকজান্ডার নামক মার্কিন বন্দি বা জিম্মির মুক্তির বিষয়ে কী কথা হয়, সেদিকে।
আলোচনায় ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে নিশ্চয়ই কথা হবে। ট্রাম্প নিশ্চিত আলোচনা করবেন সৌদি-ইসরাইল কূটনৈতিক স্বাভাবিকীকরণের পথ খুঁজে বের করার বিষয় নিয়ে। এরকম নানা ‘স্বপ্ন’ রয়েছে ট্রাম্পের এবং সেগুলো পূরণের জন্যই তিনি মধ্যপ্রাচ্যে ছুটে গেছেন বলে ধরে নেওয়া যেতে পারে।
তবে, সফর-সংশ্লিষ্ট মধ্যপ্রাচ্যের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথোপকথনে আমার কাছে যেটা মনে হয়েছে, দেশগুলোর সঙ্গে চুক্তি সম্পাদনের বিষয়কেই সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে দেখবে ট্রাম্প প্রশাসন। সহজ করে বললে, এতদঞ্চলের ‘স্থায়ী সমস্যা’ নিয়ে পড়ে না থেকে বরং উপসাগরীয় বিনিয়োগের স্রোতে সাঁতার কাটতেই বেশি পছন্দ করবেন ট্রাম্প!
রিয়াদে এক অসাধারণ ভাষণ দিয়েছেন ট্রাম্প; তিনি বলেন, ‘নতুন প্রজন্মের নেতৃত্ব আমাদের চোখের সামনেই পুরোনো দ্বন্দ্ব ও অতীতের ক্লান্তিকর বিভাজনের পথ পাড়ি দিচ্ছে। একই সঙ্গে তারা এমন এক ভবিষ্যতের রূপরেখা অঙ্কন করছে, যেখানে মধ্যপ্রাচ্য বিশৃঙ্খলা নয়, বরং সংজ্ঞায়িত হবে বাণিজ্য দ্বারা; যেখানে এই ভূখণ্ড সন্ত্রাসবাদ নয়, বরং রপ্তানি করবে প্রযুক্তি এবং যেখানে বিভিন্ন জাতি ও ধর্মের মানুষ বিনির্মাণ করবে এমন এক নবতর শহর, যেখানে একে অন্যের জন্য অস্তিত্বের হুমকি হয়ে উঠবে না।’
উপসাগরীয় ‘বিনিয়োগ বা অর্থের জন্য এই প্রতিযোগিতা’ বেইজিংয়ের সঙ্গে ট্রাম্প প্রশাসনের চলমান বাণিজ্যিক অচলাবস্থা এবং প্রযুক্তি প্রতিযোগিতায় শীর্ষস্থান ধরে রাখার একটি প্রতিযোগিতাও বটে। সম্প্রতি ট্রাম্প ঘোষিত শুল্ক আরোপসংক্রান্ত আলোচনাও এ সফরে ঘুরেফিরে আসবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শুল্ক ১৪৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৩০ শতাংশে এবং চীন ১২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশে রাখার বিষয়ে ভাবছে, যাতে করে ‘শুল্ক সংঘাত’ নিয়ে আশঙ্কার অবকাশ না থাকে। এমন মনোভাবের পেছনে ট্রাম্পের নজরে থাকা একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হলো, বাইডেন প্রশাসনের ‘এআই ডিফিউশন রুল’ বাতিল করার সিদ্ধান্ত। বাইডেন জামানায় সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরবসহ কিছু দেশে উন্নত সেমিকন্ডাক্টর চিপ রপ্তানির ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। ভারত, মেক্সিকো, ইসরাইল, পোল্যান্ডসহ আরো কিছু দেশের ওপর বিধিনিষেধ আরোপের পেছনে এই আশঙ্কা ছিল যে, এগুলোর রপ্তানি আটকানো না গেলে, বিশেষ করে চীনের কাছে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ‘ফাঁস’ হয়ে যেতে পারে।
নিউ ইয়র্ক টাইমস এক নিবন্ধে এরই মধ্যে জানিয়েছে যে, ট্রাম্প প্রশাসন এমন একটি চুক্তির কথা বিবেচনা করছে, যার ওপর বিধিনিষেধ দিয়ে রেখেছিল বাইডেন প্রশাসন। জানা যায়, সবচেয়ে উন্নত ‘মার্কিন-পরিকল্পিত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) চিপ এ৪২’ আমদানির জন্য আমিরাতের একটি এআই সংস্থা মার্কিন কোম্পানিগুলোর সঙ্গে অংশীদারত্ব গড়ে তোলে; আর এটা করতে গিয়ে চীনা অংশীদারদের সঙ্গে তাদের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে হয়েছিল। ট্রাম্প এখন স্বভাবতই সেই পুরোনো বিষয়টিতে হাত দিতে চাইবেন।
নিউ ইয়র্ক টাইমস থেকে আরো জানা যায়, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সফরের আগে মার্কিন প্রযুক্তিনীতিতে একটি বড় ধরনের পরিবর্তনের আভাস রয়েছে। অবশ্য এ নিয়ে খোদ ট্রাম্প প্রশাসনের মধ্যেই একধরনের উত্তেজনা লক্ষ করা গেছে! যারা চীনের সঙ্গে মার্কিন বাণিজ্য ও প্রযুক্তিগত অগ্রাধিকারকে এগিয়ে নিতে আগ্রহী, তারা আছেন এই দলে। পাশাপাশি আছেন সেই সব জাতীয় নিরাপত্তা কর্মকর্তা, যারা বেইজিংয়ের হাতে গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তি চলে যাওয়া বা ফাঁস হওয়ার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে থাকেন বিভিন্ন সময়।
ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে এবং পরবর্তী কালে বাইডেন প্রশাসনের সময়, মার্কিন সরকারের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে এই বিতর্ক চলছিল যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কি চীনকে উন্নত চিপস পেতে বাধা দেবে, নাকি প্রযুক্তিগতভাবে চীনাদের থেকে এক বা দুই প্রজন্ম এগিয়ে থাকার চেষ্টা করবে? এই বিতর্কের মীমাংসা হতে যাচ্ছে, বলতে হয়। চীনের হাবভাব দেখে স্পষ্ট বোঝা যায়, বড় কোনো অগ্রগতি অর্জনের জন্য তারা মার্কিন নিষেধাজ্ঞাগুলো এড়িয়ে যাওয়ার কার্যকর উপায় খুঁজে বের করতে চাইছে। এ অবস্থায় বিশেষত এআই প্রযুক্তির দৌড়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এক বা দুই ধাপ এগিয়ে থাকতে হলে অবধারিতভাবে নতুন বিনিয়োগ এবং অংশীদারত্বের প্রয়োজন পড়বে। ঠিক সে কারণেই ট্রাম্প মধ্যপ্রাচ্যের মাটিতে পা রেখেছেন বলে বিশ্লেষকদের ধারণা। অর্থাত্, বিনিয়োগই যে ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্য সফরের মূল উদ্দেশ্য, তা একপ্রকার নিশ্চিত।
এই সফরে ট্রাম্প হয়তো প্রত্যাশা অনুযায়ী বিনিয়োগ বাগিয়ে নেবেন। তবে এই অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়া যুদ্ধ যে তিনি রাতারাতি থামিয়ে দেবেন, তেমন কোনো লক্ষণ নেই। তবে মার্কিন প্রেসিডেন্টের এই সফর সত্যিকার অর্থেই ঐতিহাসিক কিছু বিষয়কে নতুন করে আলোচনায় টেনে এনেছে। এখন দেখার বিষয়, ট্রাম্পের কর্মপরিকল্পনা ঠিক কতটা বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারে!
লেখক : আটলান্টিক কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা
আটলান্টিক কাউন্সিল থেকে অনুবাদ : সুমৃৎ খান