চাঁদাবাজি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক এবং সামাজিক জীবনে এক দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা। বর্তমানে সমাজের এক ভয়াবহ সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে চাঁদাবাজি। এটি শুধু ব্যক্তি বা ব্যবসায়ীদের ক্ষতি করে না, বরং দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি এবং আইনশৃঙ্খলার ওপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। স্বাধীনতার পর থেকেই এ সমস্যা বেড়ে চলেছে। এই চাঁদাবাজির ফলে ব্যবসায়ী ও সাধারণ জনগণের জীবনযাত্রা ক্রমাগত দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। চাঁদাবাজি সাধারণত অপরাধী চক্র, সন্ত্রাসী গ্রুপ, রাজনৈতিক কর্মী, ভুয়া সংগঠন, দুর্নীতিগ্রস্ত প্রশাসনিক কর্মকর্তা বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু সদস্য এবং স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিদের দ্বারা হয়ে থাকে।
চাঁদাবাজির মূল কারণগুলোর মধ্যে আইনের দুর্বল প্রয়োগ, অর্থনৈতিক সংকট, রাজনৈতিক প্রভাব ও জনসচেতনতার অভাব অন্যতম। আইনের যথাযথ প্রয়োগ না হওয়ায় এবং রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয়ের কারণে অনেক চাঁদাবাজ সহজেই রক্ষা পেয়ে যায়। বেকারত্ব ও আর্থিক সংকটের ফলে অনেক যুবক অবৈধ পথে পা বাড়িয়ে চাঁদাবাজ চক্রের সঙ্গে যুক্ত হয়। এছাড়া, রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় থাকা সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো নির্বিঘ্নে চাঁদাবাজি চালিয়ে যেতে পারে। অন্যদিকে, ভুক্তভোগীরা ভয়ের কারণে চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে সাহস পান না, যা তাদের আরো বেপরোয়া করে তোলে।
গণঅভ্যুত্থানের পর সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা ছিল, নতুন সরকার চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেবে। একটি স্বচ্ছ ও সুশাসিত বাংলাদেশ গড়ে ওঠার দিকে ধাবিত হবে। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। চাঁদাবাজির চক্র এখনো সক্রিয়। নানা অজুহাতে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে অর্থ আদায় হচ্ছে।
বর্তমানে বেশ কিছু এলাকায় চাঁদাবাজির ঘটনা ভয়াবহভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এসব ঘটনা সাধারণ মানুষের জন্য চরম ভোগান্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। হাটবাজার, বাসস্ট্যান্ড, ফুটপাত এবং বিভিন্ন বাণিজ্যিক স্থানে সংঘবদ্ধ চাঁদাবাজ চক্র সাধারণ ব্যবসায়ী ও শ্রমিকদের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে। অবৈধভাবে চাঁদা আদায় করার কারণে যানবাহনের খরচ বৃদ্ধি এবং ভাড়ার ওপর প্রভাব ফেলছে।
চাঁদাবাজি শুধু ব্যক্তিগত অর্থনৈতিক ক্ষতি করে না, বরং সামগ্রিকভাবে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং সামাজিক স্থিতিশীলতা ব্যাহত করে। তাই চাঁদাবাজি রোধ করতে প্রশাসনের কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া অত্যন্ত জরুরি। চাঁদাবাজি প্রতিরোধে আইনের কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে, যাতে অপরাধীরা রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত তদন্ত ও বিচারের আওতায় আসে। গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে আরো সক্রিয় করে গোপন তথ্য সংগ্রহ ও বিশেষ অভিযান পরিচালনার মাধ্যমে চাঁদাবাজদের দমন করতে হবে। পাশাপাশি, জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে, যাতে তারা ভয়ে না থেকে সাহসের সঙ্গে অভিযোগ জানাতে পারে। রাজনৈতিক দলগুলোরও উচিত নিজেদের মধ্যে থাকা অপরাধীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া। এছাড়া বেকারত্ব দূরীকরণের মাধ্যমে যুবসমাজকে কর্মসংস্থানের সুযোগ দিলে তারা সহজে অপরাধের পথে পা দেবে না, যা চাঁদাবাজি রোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
সব মিলিয়ে চাঁদাবাজি একটি দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা, যা এক দিনে সমাধান সম্ভব নয়। কিন্তু সঠিক পদক্ষেপ এবং জনগণের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায় এটি প্রতিরোধ সম্ভব। গণঅভ্যুত্থানের যে আশা ও উদ্দীপনা জাতির মধ্যে জাগ্রত হয়েছিল, তা কাজে লাগিয়ে একটি চাঁদাবাজিমুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তোলা সম্ভব। আমাদের প্রত্যেকের দায়িত্ব এ কালো ছায়া থেকে দেশকে মুক্ত করা এবং একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে অগ্রসর হওয়া। এখনই সময় একসঙ্গে রুখে দাঁড়ানোর!
লেখক : শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।
(এই লেখা লেখকের একান্ত ব্যক্তিগত অভিমত; এ সংক্রান্ত কোনো দায় দৈনিক মূলধারা বহন করবে না)