ঈদুল আজহা কেবল একটি ধর্মীয় উত্সবই নয়, বরং এটি একটি দায়িত্বশীলতা, পরিচ্ছন্নতা এবং মানবিক আচরণের প্রতীকও বটে। আজ আমরা জানব কীভাবে কোরবানির জন্য একটি সুস্থ পশু নির্বাচন করব, তাকে যত্ন নেব এবং ইসলামি ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে হালালভাবে জবাই করে চামড়া সংরক্ষণ করব।
কোরবানির জন্য সুস্থ পশু চেনার উপায় হলো—এক্ষেত্রে তাড়াহুড়ো করা যাবে না। সময় নিয়ে পশু নির্বাচন করতে হবে। সুস্থ পশু সাধারণত চঞ্চল থাকবে, মাঝেমধ্যে জাবর কাটবে এবং আশপাশে শব্দ হলে সেদিকে তাকাবে। তার চোখ উজ্জ্বল, নাক ভেজা এবং ত্বক টানটান থাকবে। আর অসুস্থ বা স্টেরয়েড দেওয়া পশু কীভাবে চেনা যাবে? আসলে যেসব পশুকে ওষুধ দিয়ে মোটাতাজা করা হয়, তাদের শরীরে অস্বাভাবিক ফোলা দেখা যায়। শরীরে চাপ দিলে গর্ত হয়ে থাকে এবং তা সহজে স্বাভাবিক হয় না। তাছাড়া তাদের নাক শুকনো থাকে এবং তারা ক্লান্ত থাকে।
কোরবানির জন্য উপযুক্ত পশুর বয়স হলো—গরুর বয়স কমপক্ষে দুই বছর, ছাগল বা ভেড়ার এক বছর এবং উটের বয়স পাঁচ বছর হতে হবে। গর্ভবতী, দাঁতহীন, পঙ্গু বা অন্ধ পশু কোরবানির জন্য গ্রহণযোগ্য নয়।
এদিকে পশু কেনার পর বাড়িতে আনার সময় ও পরে আমাদের কিছু করণীয় রয়েছে। পশুকে হাঁটিয়ে না এনে গাড়িতে করে আনাই ভালো। বাড়িতে এনে প্রথমে পটাশ মেশানো পানি দিয়ে গোসল করাতে হবে। তারপর তিন-পাঁচ লিটার স্যালাইন পানি খাওয়াতে হবে। হাট থেকে আসা সবাইকে ভালোভাবে হাত-পা ধুয়ে ফেলতে হবে। প্রথমে কিছু কাঁচা ঘাস বা শুকনো খড় দিতে হবে। ঘণ্টাখানেক পর সামান্য পরিমাণে দানাদার খাদ্য যেমন ভুসি, কুঁড়া, খইল ইত্যাদি দেওয়া যাবে। দানাদার খাদ্য শরীরের ওজনের ১ শতাংশের বেশি যেন না হয়।
কোরবানির আগের দিনও আমাদের বিশেষ প্রস্তুতি রয়েছে। পশুর থাকার জায়গা পরিষ্কার ও আরামদায়ক হতে হবে। প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে গোসল করাতে হবে। কোরবানির ১২ ঘণ্টা আগে দানাদার খাদ্য বন্ধ করে খড় ও পানি দিতে হবে।
ইসলামি শরিয়াহ মোতাবেক হালাল জবাইয়েরও কিছু নিয়ম আছে, যাতে পশু কষ্ট না পায়। জবাইয়ের আগে পশুকে শান্ত করতে হবে। শ্বাসনালি, খাদ্যনালি, রক্তনালি কাটা বাধ্যতামূলক ; তবে স্পাইনাল কর্ড কাটা যাবে না। জবাইয়ের সময় পশুকে কষ্ট না দেওয়ার জন্য শান্তভাবে বাঁধতে হবে, হইচই করা যাবে না। ধারালো ছুরি ব্যবহার করতে হবে এবং যথাসম্ভব দ্রুত প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হবে। শিশু ও দুর্বল মানসিকতার মানুষদের দূরে রাখতে হবে।
কোরবানির মাংস প্রক্রিয়াজাতকরণ ও সংরক্ষণও গুরুত্বপূর্ণ। পাকস্থলীর খাদ্যনালি গিঁট দিয়ে বাঁধতে হবে, যাতে মাংস নোংরা না হয়। এরপর সতর্কতার সঙ্গে চামড়া ছাড়িয়ে, অভ্যন্তরীণ অঙ্গগুলো বের করে পরিষ্কার করতে হবে। মাংস স্তূপ না করে ছড়িয়ে ঠান্ডা করতে হবে, এরপর ছোট ছোট প্যাকেটে ফ্রিজে রাখাই ভালো। একবার গলে গেলে দ্বিতীয় বার ফ্রিজিং করা যাবে না, এতে মাংস নষ্ট হয়।
এবার বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও পরিবেশ সম্পর্কেও আমাদের সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে। কোরবানির বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় সরকারি নির্দেশনা মেনে চলা বাঞ্ছনীয়। জবাই সরকারনির্ধারিত জায়গায় করতে হবে। রক্ত, মল ও অন্যান্য বর্জ্য একত্র করে গর্তে পুঁতে ফেলতে হবে। স্থান পরিষ্কার করে ব্লিচিং পাউডার ও চুন ছিটাতে হবে। পরিবেশ যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে।
চামড়া সংরক্ষণ ও ভালো চামড়া পেতেও আমাদের বিশেষ কিছু করণীয় রয়েছে। জবাইয়ের আগে পশুকে গোসল করাতে হবে। চামড়া ছাড়িয়ে দ্রুত লবণ ছিটাতে হবে। প্রতি কেজিতে ২০০ গ্রাম লবণ। তারপর যত দ্রুত সম্ভব চামড়াটি বিক্রয় কেন্দ্রে পাঠাতে হবে।
বস্তুত কোরবানি কেবল একটি ধর্মীয় বিধান নয়, এটি একটি সামাজিক ও পরিবেশগত দায়িত্বও। পশু কেনা থেকে শুরু করে জবাই, সংরক্ষণ এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনা—সব ক্ষেত্রেই সচেতনতা দরকার।
লেখক :অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান (ডেইরি অ্যান্ড পোলট্রি সায়েন্স) এবং পরিচালক, পোলট্রি রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টার, চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও অ্যানিমেল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম।