২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের ঘটনা। ১ হাজারেও বেশি হামাস যোদ্ধা নজিরবিহীনভাবে দক্ষিণ ইসরাইলে ঢুকে পড়ে নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালান। ঐ হামলায় নিহত হয় ১ হাজার ২০০ জন। ২৫০ জনকে জিম্মি করে নিয়ে যাওয়া হয় গাজা উপত্যকায়। হামাসের অকস্মাৎ এই হামলাকে হলোকাস্টের পর ইহুদিদের ওপর সংঘটিত সবচেয়ে ভয়াবহ গণহত্যার আখ্যা দেওয়া হয়েছে।
ঐ ঘটনার পর ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এক বক্তৃতায় হুংকার ছেড়ে বলেন, ‘ইসরাইল যুদ্ধে নেমেছে।’ বলা বাহুল্য, ইসরাইল সত্যি সত্যিই যুদ্ধে নেমে পড়ে! দেশটির প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) তাৎক্ষণিকভাবে জিম্মিদের মুক্তি এবং হামাসকে নির্মূল করার জন্য শুরু করে ‘সর্বাত্মক সামরিক অভিযান’। সেই থেকে এখন পর্যন্ত ইসরাইলি হামলায় ৫৫ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে, যাদের বেশির ভাগই নারী ও শিশু। অনুমান করা হয়, হতাহতের সংখ্যা আরো বেশি হবে।
শুরু থেকেই ইসরাইল দাবি করে আসছে, তাদের এই পদক্ষেপ আন্তর্জাতিক আইনের বাইরে নয়, বরং ‘ইন্টারন্যাশনাল ‘ল’ মেনে বৈধ উপায়েই সবকিছু করা হচ্ছে। তেল আবিবের দাবি, প্রতিটি জাতিরই সেলফ ডিফেন্স, তথা ‘নিজেকে রক্ষা করার সহজাত অধিকার’ রয়েছে। গাজায় হামলা চালানোর যুক্তি হিসেবে ২০২৪ সালের শুরুর দিকে ঠিক এই কথাটিই বলেছিলেন নেতানিয়াহু।
আন্তর্জাতিক আইনে এই ‘আত্মরক্ষার অধিকার’ স্বীকৃত বটে। জাতিসংঘ সনদের ৫১ অনুচ্ছেদে বলা আছে : ‘কোনো সদস্য রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সশস্ত্র আক্রমণের ঘটনা ঘটলে এই সনদের কোনো ধারাই স্বতন্ত্র বা সম্মিলিত আত্মরক্ষার সহজাত অধিকারকে ক্ষতিগ্রস্ত বা বাধাগ্রস্ত করবে না …।’ ফলে গাজা যুদ্ধের শুরুর দিকে অনেক দেশই ইসরাইলের আত্মরক্ষার অধিকারের দাবির সঙ্গে একমত পোষণ করেছিল।
তবে এটা কীভাবে সঙ্গায়িত করা হবে, তথা ইসরাইলের আত্মরক্ষার অধিকারের সীমারেখার বিষয়টি নিয়ে সেসময় কিছু জায়গা থেকে আপত্তি উঠেছিল। তাদের বক্তব্য ছিল, ঠিক কীভাবে এটা নিশ্চিত করা হবে যে, আত্মরক্ষার অজুহাত দেখিয়ে তারা (ইসরাইল) যে পদক্ষেপ গ্রহণ করবে, তা যে আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হবে, তার গ্যারান্টি কী?
সুতরাং, ৭ অক্টোবরের হামলার ২০ মাস পর আগের সেই প্রশ্নই নতুন করে সামনে আসছে। সোজাসাপটা জিজ্ঞাসা—ইসরাইলের এই ‘আত্মরক্ষার ন্যায্যতার দাবি’ কি এখনো প্রাসঙ্গিক বা গ্রহণযোগ্য? তারা যেভাবে গাজায় বিরতিহীনভাবে হামলা চালিয়ে যাচ্ছে, তাতে কি নেতানিয়াহু প্রশাসনের বিরুদ্ধে মৌলিক আইনি প্রশ্ন তোলা যায় না? এর চেয়ে বড় প্রশ্ন, ইসরাইল কি এভাবেই ‘অনির্দিষ্টকালের জন্য’ আত্মরক্ষা-কৌশল চালিয়ে যেতে পারে? সরাসরি বললে, নেতানিয়াহুর বাহিনী কি এখন ফিলিস্তিনি জনগণের বিরুদ্ধে গায়ের জোরে আগ্রাসনের যুদ্ধ চালাচ্ছে না? অথচ এসব নিয়ে বিশ্বসম্প্রদায়ের মুখে কোনো রা নেই!
আত্মরক্ষা আইনে কী বলা আছে?
আন্তর্জাতিক আইনে আত্মরক্ষার দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে বটে। ১৮৩৭ সালের এক ঘটনাকে কেন্দ্র করে কূটনৈতিক আদান-প্রদানের মাধ্যমে আত্মরক্ষার আধুনিক নীতিগুলোর অবতারণা ঘটেছিল। ব্রিটিশ বাহিনী কানাডায় ‘দ্য ক্যারোলিন’ নামক একটি মার্কিন জাহাজ ধ্বংস করে দিয়েছিল। ঐ ঘটনার পর উভয় পক্ষ একমত হয় যে, আগে ব্রিটিশদের প্রমাণ করতে হবে যে, কেন তারা আত্মরক্ষার প্রশ্নে আগে হামলা চালিয়েছিল। তাদের প্রমাণ করতে হবে যে, তাদের আচরণ বা কর্মকাণ্ড কেন ‘অযৌক্তিক বা অযাচিত’ হিসেবে গণ্য করা হবে না।
একইভাবে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মান ও জাপানের সম্মিলিত আগ্রাসনের প্রতিক্রিয়ায় মিত্র পক্ষ ‘আত্মরক্ষার ধারণা’র ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভর করে বসে! ‘আত্মরক্ষা’ এভাবে আইনি কাঠামোয় ‘একটি রাষ্ট্র-ভিত্তিক আক্রমণের প্রতিক্রিয়া জানানোর অধিকার’ হিসেবে স্বীকৃত হতে শুরু করে।
একটি বৈধ, স্বীকৃত রাষ্ট্র এবং জাতিসংঘের সদস্য হিসেবে ইসরাইলের আত্মরক্ষার অধিকার সর্বদা সুসংহত থাকবে, এটাই স্বাভাবিক; কিন্তু এক্ষেত্রে প্রশ্নের অবকাশ রয়েই যায়। কারণ, ইসরাইল যখন কোনো প্রতিবেশী কিংবা হামাস, হিজবুল্লাহ বা ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীদের মতো অ-রাষ্ট্রীয় শক্তির (আন্তর্জাতিক সম্পর্কে যা ‘অ্যাক্টর’ নামে অভিহিত) আক্রমণের মুখোমুখি হবে, কেবল তখনই আত্মরক্ষার অধিকার, তথা সেলফ ডিফেন্সের অধিকার কার্যকর করা যাবে এবং সেটা গ্রহণযোগ্যও হবে। তবে সেই অবস্থাতেও মনে রাখতে হবে, এই আত্মরক্ষার অধিকার ‘সীমাহীন নয়’, বরং এটি নেহাত জরুরত বা প্রয়োজন এবং আনুপাতিকতার নীতি দ্বারা সীমাবদ্ধ।
এই নীতির আলোকে হিসাব করলে দেখা যায়, ৭ অক্টোবর হামাসের সহিংস কর্মকাণ্ড এবং ইসরাইলি নাগরিকদের জিম্মি করে নিয়ে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে ইসরাইলি বাহিনীর ‘আত্মরক্ষার প্রয়োজনীয়তার শর্ত’ পূরণ হয়েছিল। সেসময় তেল আবিবের হাতে এর জুতসই বিকল্প ছিল না। ফলে ইসরাইলের আত্মরক্ষার কৌশল, তথা গাজা উপত্যকায় সামরিক অভিযান চালানোর যুক্তিকে উপেক্ষা করা যায়নি। আনুপাতিকতার শর্তও প্রাথমিকভাবে পূরণ হয়েছিল। তবে দিনকে দিন সেলফ ডিফেন্সের নায্যতা হারিয়েছে তেল আবিব। এখন যে কেউ অনায়াসে এই আইনি প্রশ্ন তুলতে পারে, আত্মরক্ষার অজুহাতে ইসরাইল যে সামরিক অভিযান চালাচ্ছে, তা কি এখনো বৈধ?
সম্প্রতি ইসরাইলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী এক মন্তব্যে বলেন, ‘প্রস্তাবিত যুদ্ধবিরতি চুক্তি গৃহীত না হলে হামাসকে নির্মূলে আরো বৃহত্তর আক্রমণ চালানো হবে। এ ধরনের কথা নেতানিয়াহুর মুখ থেকেও প্রায়ই শোনা যায়। এ ধরনের মন্তব্য এই প্রশ্নকে আরো জোরালো করে তোলে স্বভাবতই।
তাছাড়া সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আন্তর্জাতিক বিচার আদালত আত্মরক্ষায় আনুপাতিকতার গুরুত্বকে সমর্থন করে আসছে। আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে, ‘আনুপাতিকতা’ সংঘাত জুড়ে প্রাসঙ্গিক থাকতে হবে, কেবল আক্রমণের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় থাকলে চলবে না।
আনুপাতিকতার নীতি বেসামরিক নাগরিকদেরও সুরক্ষা প্রদান করে থাকে। এ নীতি অনুযায়ী, সামরিক পদক্ষেপগুলো সর্বদাই সেই সব বিদেশি বাহিনীর বিরুদ্ধে পরিচালিত হতে হবে, যারা প্রথমে আক্রমণ শুরু করেছে। তবে কোনোক্রমেই বেসামরিক নাগরিকদের লক্ষ্য করে অভিযান চালানো যাবে না। আইডিএফ কি এই শর্তের তোয়াক্কা করেছে, তারা কি এখনো এই নিয়ম মানছে?
অতএব, সামগ্রিকভাবে হামাসের বিরুদ্ধে চলমান ২০ মাসের সামরিক হামলা, বিপুলসংখ্যক বেসামরিক হতাহত, দুর্ভিক্ষের বিশ্বাসযোগ্য বিভিন্ন প্রতিবেদন এবং গাজা উপত্যকা শহর ও নগরগুলোর ধ্বংসাবশেষ এই সাক্ষ্য দেয় যে, ইসরাইলের আত্মরক্ষার অনুশীলন অসামঞ্জস্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে এসব নিয়ে তদন্ত হওয়া উচিত।
জিম্মিদের উদ্ধার কি ‘সেলফ ডিফেন্স’?
ইসরাইল আলাদাভাবে যুক্তি দিতে পারে যে, তারা হামাসের হাতে থাকা বাকি জিম্মিদের উদ্ধারের জন্য ‘বৈধ আত্মরক্ষা অনুশীলন’ করছে মাত্র। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করতে হয়, আত্মরক্ষার অনুশীলন হিসেবে ‘নাগরিকদের উদ্ধার’ আইনিভাবে একটি বিতর্কিত বিষয়।
১৯৭৬ সালে ইসরাইল একটি নজির স্থাপন করেছিল। একটি ইসরাইলি বিমান হাইজ্যাক হওয়ার পর উগান্ডার এন্টেব্বে থেকে ১০৩ জন ইহুদি জিম্মিকে উদ্ধার করেছিল ইসরাইলের সামরিক বাহিনী। সেই যুগে এটার আইনি গ্রহণযোগ্যতা ছিল। তবে বর্তমান আন্তর্জাতিক আইনে, আত্মরক্ষার এই ব্যাখ্যাটির তেমন একটা প্রয়োগ নেই। উপরন্তু, এই আইন ব্যবহারের বিষয়েও নেই কোনো আন্তর্জাতিক ঐকমত্য।
গাজায় ইসরাইলের যুদ্ধের আকার, মাত্রা এবং সময়কাল—এসব কিছু দেখে বেশ পরিষ্কার বোঝা যায় যে, এটা হামাসকে নির্মূল করার অভিযান ছাড়া আর কিছুই নয়। আর এই বিবেচনায় বলতে হয়, ইসরাইলের আত্মরক্ষার দাবি ন্যায্যতা হারিয়েছে অনেক আগেই।
অযাচিত আগ্রাসনের শাস্তি তাহলে কী?
প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, গাজায় সামরিক অভিযান চালানোর দাবিকে ইসরাইল যদি শেষ পর্যন্ত ন্যায্যতা দিতে না পারে, তাহলে আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে নেতানিয়াহুর এই পদক্ষেপকে কীভাবে দেখা হবে? ইসরাইল এক্ষেত্রে দাবি করতে পারে যে, তারা ‘একটি দখলকারী শক্তি’ হিসেবে নিরাপত্তা অভিযান চালাচ্ছে মাত্র। যদিও তাদের এই দাবি অপ্রাসঙ্গিক ও হাস্যকর হবে।
গাজায় ইসরাইলের অনমনীয় আচরণের অন্য কোনো বৈধ ভিত্তি না থাকায়, একে ‘সরাসরি আগ্রাসন’ বলে আখ্যায়িত করছেন বিশ্লেষকরা। জাতিসংঘ সনদ এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের রোম সংবিধিসহ সবধরনের আন্তর্জাতিক আইনে এটা ‘আগ্রাসন’ হিসেবেই প্রমাণিত হবে।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণকে আগ্রাসন হিসেবে চিহ্নিত করে ব্যাপক নিন্দা জানিয়ে আসছে। গাজায় ইসরাইলের আচরণের ক্ষেত্রেও তারা একইভাবে নিন্দা জানাবে কি না, এ নিয়ে মুখ খুলবে কি না, সেই প্রশ্নই এখন বড় করে সামনে আসছে।