এক বৃদ্ধা মায়ের কথা বলি, যিনি একসময় ছেলের খাবার মুখে তুলে দিতেন, রাতে গা ঘেঁষে ঘুম পাড়াতেন। সেই মা আজ একটি বৃদ্ধাশ্রমে একটি জানালার পাশে বসে শুধু অপেক্ষা করেন—‘আজ বুঝি ছেলে আসবে…হয়তো নাতির মুখ দেখব।’ কিন্তু দিন গড়ায়, মাস পেরোয়, ছেলে আর আসে না। একজন মানুষ বৃদ্ধাশ্রমে কী নিয়ে বাঁচেন? ওষুধ, শয্যা, সময়ানুবর্তী পরিচর্যা? না, তিনি বাঁচেন প্রতীক্ষায়। প্রতীক্ষা সন্তানের মুখ দেখার, তার স্পর্শ পাওয়ার, একটা ফোনকলের শব্দ শুনে বুক কেঁপে ওঠে—‘এই বুঝি আমার ছেলে!’
আমরা উন্নত সভ্যতা গড়েছি, প্রযুক্তিতে দিগ্বিদিক জয় করেছি, কিন্তু হূদয়ের দরজা বন্ধ করে দিয়েছি সেই মানুষের মুখের ওপর—যাদের চোখের পাতা না ফেলে আমরা ঘুমাতে শিখেছিলাম। এখন সময় এসেছে প্রশ্ন করার—এই হূদয়হীনতা থেকে কী শিখছে আমাদের আগামী প্রজন্ম? পরিসংখ্যানের নির্মম চিত্র বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০২৫ সালের তথ্যমতে, দেশে প্রায় ১.৭ কোটি প্রবীণ (৬০+) মানুষ রয়েছেন। HelpAge International-এর গবেষণায় দেখা গেছে, বৃদ্ধাশ্রমে অবস্থানরত ৭৬ শতাংশ প্রবীণ জানিয়েছেন—তারা স্বেচ্ছায় আসেননি। এর মধ্যে ৫৮ শতাংশ নারী প্রবীণ পুত্রবধূর চাপে এবং ৩১ শতাংশ পুরুষ প্রবীণ সন্তানের অবহেলায় বৃদ্ধাশ্রমে ঠাঁই নিয়েছেন।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট বলছে, বৃদ্ধাশ্রমে থাকা প্রবীণদের ৬৫ শতাংশ বিষণ্নতায় ভোগেন, যাদের মধ্যে ১৯ শতাংশ আত্মহত্যাপ্রবণ। এই সংখ্যা শুধু পরিসংখ্যান নয়—এগুলো প্রতিটি একটি কান্নার গল্প।
আপনি আজ যেভাবে আপনার বাবা-মাকে দেখছেন, আগামীকাল আপনার সন্তানও সেভাবেই আপনাকে দেখবে। আপনি যদি আপনার বাবাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠান, আপনার ছেলেও একদিন আপনাকে সেখানে পাঠাবে। কারণ সে তা দেখেই শিখেছে। একটি শিশু যেভাবে মায়ের মুখ দেখে হাঁটতে শেখে, বাবার বুকে মাথা রেখে সাহস পায়—তেমনই সে ভালোবাসতে, শ্রদ্ধা করতে শেখে পরিবার দেখে। আপনি যদি পরিবারের প্রবীণদের অসম্মান করেন, শিশুরা শিখবে ভালোবাসাহীনতা।
একটি বৃদ্ধাশ্রমে একবার এক ছেলে গিয়েছিল তার বাবাকে দেখতে। বাবা তাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন, ‘বাবা, তুমি এসে গেছ? আমার কিছু লাগবে না…শুধু একটি বার বলো, তুমি আমাকে ভালোবাসো।’ এটুকু ভালোবাসার জন্য যদি একজন মানুষ জীবন পার করে দেয়, তবে আমরা কেমন সন্তান? আজ আপনার হাতে আছে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময়। আপনার সন্তান আপনাকে শেখে দেখে—not শুনে। আপনি কী শেখাচ্ছেন? সন্তানের চোখে হোক মা-বাবা শ্রদ্ধার মূর্তি। বৃদ্ধাশ্রম নয়, হোক হৃদয়ের আশ্রয়।
লেখক : শিক্ষার্থী, ফুলছড়ি সরকারি কলেজ, জুমারবাড়ী, সাঘাটা, গাইবান্ধা