বেশ কিছু দিন ধরেই ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধ করার চেষ্টা করে আসছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এরই ধারাবাহিকতায় এবার তিনি রাশিয়াকে নয়, বরং নিশানা দাগিয়েছেন রুশ তেলের ক্রেতাদের দিকে। আর এই তালিকার একেবারে ওপরে রয়েছে বর্তমান বিশ্বের দুই গুরুত্বপূর্ণ অর্থনীতি—চীন এবং ভারত।
ট্রাম্প সাফ জানিয়ে দিয়েছেন যে, রাশিয়া যদি আগামী ৫০ দিনের মধ্যে যুদ্ধ বন্ধ করে শান্তি স্থাপনে সম্মত না হয়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র এই দেশগুলোর ওপর অর্থনৈতিক কড়াকড়ি আরোপ করবে। এতে করে কেবল এশিয়ার দুই বৃহত্তম বাজারই নয়, বরং পরোক্ষভাবে হলেও প্রভাবিত হবে গোটা বিশ্বই। রীতিমতো অস্থির হয়ে উঠবে জ্বালানি তেলের বাজার। বিপুল মার্কিন শুল্ক কিংবা অন্যান্য নিষেধাজ্ঞা এড়াতে ভারত ও চীন তখন স্বাভাবিকভাবেই জ্বালানির বিকল্প উৎস খুঁজতে মরিয়া হয়ে উঠবে।
ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি এজেন্সির তথ্য অনুযায়ী, গত বছর তেল বিক্রি করে প্রায় ১৯২ বিলিয়ন ডলার ঘরে তুলেছে মস্কো। যুদ্ধরত পুতিনকে থামাতে এই তহবিল বন্ধ করাটা জরুরি বলে মনে করছে ওয়াশিংটন এবং সেজন্যই এই পথে হাঁটা। তবে মুশকিল হলো, এর অভিঘাত কেবল মস্কোর ওপরেই পড়বে না, বরং তা আছড়ে পড়বে বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তে। রাশিয়া দৈনিক ৭ বিলিয়ন ব্যারেলেরও বেশি তেল বিশ্ববাজারে রপ্তানি করে থাকে। ফলে হুট করে বাজার থেকে রাশিয়ান তেল উধাও হয়ে গেলে বিশ্বব্যাপী হু হু করে বেড়ে যাবে তেলের দাম।
ট্রাম্পের হুমকিকে অবশ্য এখনো সেভাবে কেউ গায়ে মাখেনি! বৈশ্বিক তেলের বাজারেও এখনও তেমন কোনো প্রভাব লক্ষ করা যায়নি। এমনটা কেন হচ্ছে? ‘ক্ষণে ক্ষণে রূপ পালটানো ট্রাম্প’ শেষ পর্যন্ত এটা কার্যকর করবেন কিনা কিংবা করলে কীভাবে করবেন, সেসব নিয়ে অনিশ্চয়তার যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে এখনো।
ট্রাম্পের হুংকারের পর বিশ্লেষকরা মন্তব্য করেন যে, রাশিয়ান তেল কেনা ঠেকাতে ‘উচ্চ শুল্ক’ আরোপ করাটা ‘নিছক ভোঁতা হাতিয়ার’ হিসেবে গণ্য হবে। এভাবে হয়তো রাশিয়ার যুদ্ধ তহবিলকে উল্লেখযোগ্যভাবে সংকুচিত করা যাবে, কিন্তু পাশাপাশি বিশ্বের বিভিন্ন অংশে যে বিশৃঙ্খলার আগুন জ্বলে উঠবে, তার কী হবে?
একটু পেছনে ফিরে তাকানো যাক। ২০২২ সালে পুতিনের ইউক্রেন আক্রমণের পর যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন রাশিয়ান তেলের ওপর আমদানি নিষেধাজ্ঞা ও মূল্যসীমা (প্রাইস ক্যাপস) আরোপ করে। রাশিয়ার রপ্তানিকারকরা খুব সহজেই সেই পরিস্থিতি সামলেও নেয়। ইউরোপসহ মার্কিন মিত্ররা রাশিয়া থেকে তেল কেনা বন্ধ করে দেয়। তবে এই সুযোগ লুফে নেয় এশিয়ার ক্রেতারা। বিশেষ করে চীন ও ভারত ‘ছাড়কৃত জ্বালানি ক্রয়’ উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়িয়ে দেয়। এভাবে কিছু দেশে আড়ালে আবডালে রাশিয়ান ক্রুড অয়েল ঢুকতে থাকে।
সাড়ে তিন বছরেরও বেশি হয়ে গেছে, ইউক্রেন যুদ্ধ চলছে। অন্যদিকে, ছয় মাস হলো, দ্বিতীয় মেয়াদে হোয়াইট হাউজে ফিরেছেন ট্রাম্প। প্রেসিডেন্টের চেয়ারে বসার আগে থেকেই তিনি সদম্ভে বলে আসছেন যে, মাত্র ‘৫ মিনিটে’ ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধ করে দেবেন তিনি। তবে তার সেই ‘শান্তির আহবান’ পুতিনের কর্ণকুহরে ঢুকেছে বলে মনে হয়না। বরং শান্তির প্রতি তার আপাত অনীহার বিষয়টিই বেশি করে লক্ষণীয়। সহজ করে বললে, সম্ভবত পুতিন ট্রাম্পের কথা শুনতে চাইছেন না! আর এতেই হতাশ ট্রাম্প ক্রমবর্ধমানভাবে ক্ষীপ্ত হয়ে ওঠেন এবং উদ্যত হন রাশিয়ার বিরুদ্ধে এহেন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণে।
সম্প্রতি নিজের পরিকল্পনার কথা জানিয়ে ট্রাম্প বলেন যে, যুক্তরাষ্ট্র ‘সেকেন্ডারি ট্যারিফ’ আরোপ করতে চলেছে। ট্রাম্পের কথার সঙ্গে সুর মিলিয়ে হোয়াইট হাউজের এক কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে স্পষ্ট করে বলেন যে, ট্রাম্প মূলত রাশিয়ান তেল ক্রয়কারী দেশগুলোর ওপর ‘সেকেন্ডারি স্যাংশন’ দেওয়া হবে—এ রকমটা বোঝাতে চেয়েছেন। তার ভাষায়, ‘এটা সেকেন্ডারি স্যাংশন, যা সেই সব দেশের ওপর আরোপ করা হবে, যারা রাশিয়া থেকে তেল কিনছে। অর্থাৎ, এটা রাশিয়ার ওপর স্যাংশন দেওয়ার বিষয়ে নয়।’ এই কথার সূত্র ধরে সেদিনই ন্যাটোয় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ম্যাট হুইটেকার হোয়াইট হাউজে বসে মন্তব্য করেন, ‘এটা ভারত ও চীনের মতো দেশগুলো—যারা তাদের তেল কিনছে, তাদের ওপর শুল্ক আরোপের বিষয়। এতে করে সত্যি সত্যিই রাশিয়ার অর্থনীতি নাটকীয়ভাবে প্রভাবিত হবে।’
বিশেষজ্ঞরা অবশ্য বলছেন ভিন্ন কথা! ব্রাসেলস থিঙ্ক ট্যাঙ্কের ফেলো বেন ম্যাকউইলিয়ামস বলেছেন, ‘নিছক জ্বালানি বা এনার্জির দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, এটা মানতে হবে যে, ইউক্রেনের মিত্ররা নতুন নতুন খেলা খেলতে ওস্তাদ; ট্রাম্পের কাজে তারা সন্তুষ্ট। তবে একটা প্রশ্ন রয়েই যায়; আর তা হলো, যুক্তরাষ্ট্র এটা বাস্তবায়নে ঠিক কতটা আন্তরিকতা দেখাবে?’ বিশ্লেষকরা এমন কথাও বলছেন যে, এতো শক্তিশালী পদক্ষেপ নিলে স্বভাবতই কিছু ‘পরিণতি ভোগ’ করতে হতে পারে এবং ট্রাম্প তা সামাল দিতে কতোটা প্রস্তুত, দেখতে হবে সেটাও।
প্রথমত, রাশিয়ার তেলের ক্রেতাদের ওপর অতিরিক্ত শুল্ক বোঝা চাপিয়ে দিলে বিশ্ব বাজারে তেল সরবরাহে যে পরিমাণ ঘাটতি পড়বে এবং বিকল্প উৎস খুঁজতে যতটা বেগ পেতে হবে, তা বয়ে আনবে এক মহা ঝামেলা। চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসের হিসাব অনুযায়ী, রাশিয়া থেকে ভারত যে পরিমাণ অপরিশোধিত তেল (ক্রুড অয়েল) কিনেছে, তা তাদের মোট আমদানির ৩৬ শতাংশ; অন্যদিকে, চীন তাদের প্রয়োজনের প্রায় এক-পঞ্চমাংশ মিটিয়েছে রাশিয়ান ক্রুড অয়েলের মাধ্যমে। অর্থাৎ, রাশিয়া থেকে ভারত ও চীনে প্রতিদিন কী পরিমাণ তেল সরবরাহ হচ্ছে, তা সহজেই অনুমেয়। ঠিক এই সাপ্লাই চেইনটাই ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে চাইছেন ট্রাম্প।
ট্রাম্পের এই কৌশল ‘একটি প্রতীকী হুমকি’ কিনা, থেমে নেই সেই আলোচনাও। মনে করা হচ্ছে—প্রথমত, এর মাধ্যমে রাশিয়াকে এটা বোঝানো যে, চাইলেই তাদের তেল বিক্রির মুনাফা বন্ধ করে দেওয়া যায় এবং দ্বিতীয়ত, মস্কোর ওপর চাপ বাড়ানো যায় তাদের বাণিজ্যিক অংশীদারদের ব্যবহার করেও।
যাহোক, ন্যাটো প্রধান মার্ক রুটে সম্প্রতি চীন, ভারত ও ব্রাজিলের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘দয়া করে ভøাদিমির পুতিনকে ফোন করুন এবং তাকে বলুন যে, তাকে শান্তি আলোচনার বিষয়ে সিরিয়াস হতে হবে। অন্যথায়, ট্রাম্পের পদক্ষেপ তাদের ওপর নতুন করে আঘাত হানবে।’ যদিও পর্যবেক্ষকরা দাবি করছেন, মস্কো এই হুমকি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করলেও বেইজিং কিংবা নয়াদিল্লি এখনো চুপ মেরে আছে! এর অর্থ দাঁড়াচ্ছে, তারা ততক্ষণ পর্যন্ত পুতিনকে চাপ দিতে বা নিজেদের নীতি পরিবর্তন করতে চাইবে না, যতক্ষণ না ট্রাম্পের হুমকি কতটা বাস্তবসম্মত, সে সম্পর্কে পুরোপুরি নিশ্চিত হতে পারে।
স্মরণে রাখা দরকার, উভয় দেশেরই রাশিয়ার সঙ্গে গভীর কৌশলগত সম্পর্ক রয়েছে। পাশাপাশি যুদ্ধের মধ্যে এসব দেশ নিজেদের ব্যবসাকে সুরক্ষিত রেখে চলেছে ট্রাম্পের রক্ষচক্ষু উপেক্ষা করেই। যদিও শুরু থেকেই ভারত ও চীন দাবি করে আসছে যে, এই সংঘাতে তারা নেই কোনো পক্ষেই।
লেখকদ্বয় : যথাক্রমে সিএনএন ইন্টারন্যাশনালের (চীন) সিনিয়র নিউজ ডেস্ক রিপোর্টার এবং সিএনএন ডিজিটাল প্ল্যাটফরমের সিনিয়র সম্পাদক ও অর্থনীতি বিশ্লেষক