বাংলাদেশের রাজনীতি এখন অস্থিরতা, অনিশ্চয়তা ও অবিশ্বাসের ঘূর্ণিতে বন্দি। দীর্ঘদিন ধরে চলমান দলীয় প্রতিহিংসা, প্রশাসনের দলীয়করণ, বিচারহীনতার সংস্কৃতি এবং সর্বোপরি গণতন্ত্রের অনুপস্থিতি—সব মিলিয়ে দেশে এক ধরনের রাজনৈতিক আস্থা ও নৈতিক শূন্যতা তৈরি হয়েছে। রাজনীতি এখন আর সাধারণ মানুষের প্রতিনিধিত্ব করে না; এটি ক্ষমতাকেন্দ্রিক ষড়যন্ত্র ও প্রভাব বিস্তারের কৌশলে পরিণত হয়েছে।
এই সংকট এক দিনে তৈরি হয়নি বটে। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অবসানে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি রাষ্ট্রের জন্ম হয়। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ শুরু থেকেই শোষণ ও বঞ্চনার শিকার ছিল। ভাষা, সংস্কৃতি, অর্থনীতি ও প্রশাসনের প্রতিটি ক্ষেত্রে বৈষম্য প্রকট হয়ে ওঠে। এই বঞ্চনার প্রেক্ষাপটেই জন্ম নেয় ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন; যার ধারাবাহিকতায় আসে ১৯৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬-এর ছয় দফা, ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান এবং শেষ পর্যন্ত ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধ—যার মাধ্যমে জন্ম নেয় স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ।

স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশকে সাম্য, মানবিক মর্যাদা, ন্যায়বিচার ও গণতন্ত্রের ভিত্তিতে একটি স্বনির্ভর রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার স্বপ্ন খুব দ্রুতই ভেঙে পড়ে। শোষণহীন সমাজের স্বপ্নের পরিবর্তে দেখা দেয় একদলীয় মনোভাব, প্রশাসনিক ব্যর্থতা এবং দুর্নীতির বিস্তার। ১৯৭৫ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ সামরিক ও ছায়া সামরিক শাসনের পর অবশ্য ৯০-এর গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে গণতন্ত্রের সম্ভাবনা ফিরে আসে, কিন্তু তা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিতে পারেনি।
এরই ধারাবাহিকতায় ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ যে রাজনীতির ধারা চালু করে, তাতে করে গণতন্ত্র নয়, বরং একধরনের ক্ষমতাকেন্দ্রিক ফ্যাসিবাদ কায়েম হয়। সংবিধান পরিবর্তন, একতরফা নির্বাচন, বিরোধী দল দমন, বিচার বিভাগ ও নির্বাচন কমিশনের দলীয়করণ এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর রাজনৈতিক ব্যবহার—সবই রাষ্ট্র কাঠামোকে দুর্বল করে তোলে। এই প্রেক্ষাপটে ২০২৪ সালের জুলাইয়ে দেশব্যাপী শুরু হওয়া ছাত্র-জনতার জাগরণ দেখায় নতুন এক আশার আলো।
ইতিহাস আমাদের শেখায়, যেখানে জাতি ঐক্যবদ্ধ থাকে, সেখানে কোনো অপশক্তি টিকতে পারে না। অন্যদিকে, যেখানে ‘ব্যক্তি’ বড় হয়ে ওঠে, সেখানে রাষ্ট্র ক্রমশ ক্ষয়িষ্ণু হয়ে পড়ে। এ রকম একটি পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক দলগুলোর ব্যর্থতার ইতিহাসে যেন আর নতুন কিছু যোগ না হয়, সে জন্য একটি স্বনির্ভর বাংলাদেশ গঠনের পথে কাজ করে যেতে হবে।
তবে দুঃখজনকভাবে আন্দোলনের পরপরই নেতৃত্ব ও কৃতিত্বের প্রতিযোগিতা আবার বিভাজন তৈরি করছে—কে নেতৃত্ব দিলেন, কে মাস্টারমাইন্ড ছিলেন, কে সামনে থাকবেন—এই ‘ক্রেডিটের রাজনীতি’ গণতন্ত্রকে আবার ঠেলে দিচ্ছে ঘোর অনিশ্চয়তার দিকে! আর ছায়া রাষ্ট্রের প্রভাব, আন্তর্জাতিক স্বার্থের জটিল হিসাব এবং অভ্যন্তরীণ সুবিধাবাদীরা সেই বিভাজনের সুযোগ লুফে নিচ্ছে। এমতাবস্থায় সব গণতান্ত্রিক শক্তিকে—তা সে যত ছোট বা বড় হোক না কেন—এক ছাতার নিচে ঐক্যবদ্ধ করাটা জরুরি হয়ে পড়েছে।
মনে রাখতে হবে, গণতান্ত্রিক এই দেশ কারও ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়। এখানে ভোটের মালিক জনগণ, রাষ্ট্রের মালিকও তারাই। তাই রাজনীতি নয়, সবার আগে দেশ; ক্ষমতা নয়, প্রাধান্য পাবে ন্যায্যতা। ইতিহাস আমাদের শেখায়, যেখানে জাতি ঐক্যবদ্ধ থাকে, সেখানে কোনো অপশক্তি টিকতে পারে না। অন্যদিকে, যেখানে ‘ব্যক্তি’ বড় হয়ে ওঠে, সেখানে রাষ্ট্র ক্রমশ ক্ষয়িষ্ণু হয়ে পড়ে। এ রকম একটি পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক দলগুলোর ব্যর্থতার ইতিহাসে যেন আর নতুন কিছু যোগ না হয়, সে জন্য একটি স্বনির্ভর বাংলাদেশ গঠনের পথে কাজ করে যেতে হবে। আর সেক্ষেত্রে মাথায় রাখতে হবে মোটাদাগে দুইটি বিষয়—এক. যদি আমরা দুঃশাসনের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ না হই, তাহলে সামনে অপেক্ষা করছে আরও ভয়াবহ ফ্যাসিবাদ, নিপীড়ন ও পরাধীনতা; দুই. যদি আমরা বাংলাদেশের পক্ষে, জনগণের পক্ষে অবস্থান নিতে পারি—তবে এখনো পরিবর্তনের সুযোগ রয়েছে।
নতুন বাস্তবতায় আমরা স্বপ্ন দেখতে পারি এমন একটি বাংলাদেশের, যেখানে রাজনৈতিক ক্ষমতা নয়, জনগণের আকাঙ্ক্ষাই হবে চালিকাশক্তি। যেখানে রাজনীতি হবে জনবান্ধব, কোনোভাবেই ক্ষমতালিপ্সা ও ব্যক্তিগত প্রতিহিংসার অস্ত্র নয়। আমাদের শিক্ষা, সংস্কৃতি, সমাজনীতি, অর্থনীতি ও গণমাধ্যম—সবকিছুই হয়ে উঠুক বাংলাদেশপন্থি, যেখানে রাজনীতি নয়, প্রাধান্য পাক রাষ্ট্রনীতি।
লেখক : শিক্ষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
(এই লেখা লেখকের একান্ত ব্যক্তিগত অভিমত; এ সংক্রান্ত কোনো দায় দৈনিক মূলধারা বহন করবে না)