তুমি অধম, তাই বলিয়া আমি উত্তম হইব না কেন?—এই শাশ্বত প্রবাদটি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কপালকুণ্ডলা উপন্যাসের নবকুমারের উক্তি। এই প্রবাদটি মানুষের জীবনব্যবস্থার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নীতি বলে মনে করি। এই প্রবাদটি মানুষকে আত্মমর্যাদা, নীতি, নৈতিকতা ও আদর্শ পথে চলার অনুপ্রেরণা জোগায়।
প্রকৃত মানুষের সাধনা হওয়া উচিত সত্য, ন্যায় ও মানবিকতার আদর্শে জীবন গঠন। উত্তম ব্যক্তিদের চিন্তাভাবনায় রয়েছে আদর্শ ও অন্যের কল্যাণ সাধন করা। পক্ষান্তরে যারা অধম; তাদের ঈর্ষা, হিংসা, জিঘাংসা—এইগুলিই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। অধমদের অন্যায়, অমানবিক ও অশুভ আচরণ কখনো মানুষের অনুকরণীয় ও অনুসরণীয় আদর্শ হতে পারে না। অন্যায়কারীর মতো অন্যায় করি, তাহলে সেই অন্যায়কারীর সঙ্গে কোনো পার্থক্য থাকবে না। কেউ যদি খারাপ আচরণ করে, তাহলে উলটো তার সঙ্গে খারাপ আচরণ করা কি শোভা পায়?
যারা জ্ঞানী ও গুণিজনদের অপমান করে, তাদের মনুষ্যত্ব নিশ্চয়ই নেই। আমরা এখনো অধমের চক্রে আটকে আছি। উত্তম হওয়ার ব্রত থেকে আমরা দিনদিন পথভ্রষ্ট হয়ে যাচ্ছি। আমরা প্রতিশোধপরায়ণ রাজনীতিতে বিশ্বাসী। আমাদের একটি রেওয়াজ রয়েছে—তারা যেভাবে অনেক অন্যায় করেছে, আমাদেরকেও তার অধিক অন্যায় করতে হবে। নাকের বদলে নরুন নিতে হবে আমাদের। অন্যায় করে আমরা বীরত্ব প্রকাশ করি। আমরা কখনো ইতিহাস বা সভ্য দেশ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করি না। উত্তম কিছু করে নজির স্থাপন করতে পারি আমরা। কিন্তু তা আমরা করি না।
ক্ষমতার জোরে সমাজে হয়তো সাময়িক দাপটে রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করলেও তারা জনতার বিচারে চিরনিন্দিত হন। ইতিহাস এদের কখনো মনে রাখে না। ক্ষমতার পট পরিবর্তনের পর আমজনতা আশা করেছিল একটি দুর্নীতিমুক্ত, সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ। কিন্তু সে আশায় গুড়েবালি—দেশ এখন নৈরাজ্য ও মবের মৃগয়াক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। বিচারকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে কিছু উচ্ছৃঙ্খল জনতা।
সর্বত্র চলছে মবের দৌরাত্ম্য। পরিকল্পিতভাবে প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও মব জাস্টিস চলছে। বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখা যায়, উলটো করে ঝুলিয়ে নৃশংসভাবে মানুষ মারছে আর একদল লোক নৃত্য-উল্লাস করছে। সারা দেশে নৃশংস হত্যাকাণ্ড, ডাকাতি, চাঁদাবাজি, ধর্ষণসহ বিভিন্ন অপরাধের ঘটনায় মানুষ এখন ভীতসন্ত্রস্ত। বাড়িঘর, কলকারখানায় ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, লুণ্ঠনসহ ভয়াবহ সব অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। এসব ঘটনায় সাধারণ মানুষ উৎকণ্ঠিত ও শঙ্কিত।
ব্যক্তিগত বা রাজনৈতিক আক্রোশ থেকে পরিকল্পিতভাবে সংঘবদ্ধভাবে যে কোনো ব্যক্তির প্রতিষ্ঠান ও বাড়ির অর্থসম্পদ লুট, মবের মাধ্যমে পিটিয়ে হত্যার ঘটনা ঘটছে। পরিকল্পিতভাবে মব জাস্টিসের নামে জোটবদ্ধ হয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রধান বা কর্মকর্তাকে লাঞ্ছিত করে জোরপূর্বক পদত্যাগে বাধ্য করা হচ্ছে।
মানবাধিকার সংগঠনগুলোর তথ্যমতে, দেশে ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ১০ মাসে ২৫৩টি মব সন্ত্রাস ঘটেছে। এতে ১৭৪ জন নিহত ও ৩১২ জন আহত হয়েছে। পুলিশের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে দিনে গড়ে ১০টি হত্যাকাণ্ড ঘটছে। ৩ জুলাই কুমিল্লার মুরাদনগরে মব সন্ত্রাসে নৃশংসভাবে প্রাণ হারায় একই পরিবারের তিন জন।
এছাড়া পুলিশ থেকে আসামি ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। বেআইনি দাবিতে মব সৃষ্টি করে থানা ঘেরাও এবং হামলার ঘটনা ঘটছে। এমনকি এজাহারভুক্ত আসামিকে ছেড়ে দেওয়ার দাবি জানিয়ে থানা ঘেরাও করা হয়েছে। পুলিশ খুব কম ঘটনাতেই আইনগত ব্যবস্থা নিতে পেরেছে। বরং ঘেরাওকারীদের দাবি মানতে বাধ্য হয়েছে।
প্রাপ্ত তথ্যমতে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত সারা দেশে অন্তত ৪৪ বার থানা ঘেরাও হয়েছে। ১ জুলাই মব সৃষ্টির মাধ্যমে চট্টগ্রামের পটিয়া থানার ওসিকে প্রত্যাহার করতে সরকার বাধ্য হয়েছে। যৌথ বাহিনীর ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা থাকার পরও মব ট্রায়াল হচ্ছে। মব ভায়োলেন্স আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বা যৌথ বাহিনীর সম্মুখে হলেও তারা নির্বিকার থাকেন।
প্রায় সময় বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে মব তৈরি করে কোনো না কোনো অনুষ্ঠান-উত্সব বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। বিচারপ্রার্থী জনগণের জন্য বিচারাঙ্গন নিরাপদ হলেও এখন সেই বিচারাঙ্গনও নিরাপদ নয়। সেখানে মব সৃষ্টি করে আসামিদের ওপর হামলা হচ্ছে। এটি আইনশৃঙ্খলা ও বিচারব্যবস্থার প্রতি চরম আঘাত।
মবের নির্মম বর্বরতার শিকার হয়েছেন সাবেক সিইসি, বিচারপতি, উপাচার্য, আমলা, সরকারি কর্মকর্তা, সাংবাদিক, পুলিশ, র্যাব, শিক্ষক, ব্যবসায়ী, রাজনৈতিক নেতাকর্মী, নিরপরাধ ব্যক্তি ও বিদেশি নাগরিকসহ নানা শ্রেণির মানুষ। অনেকে মব সন্ত্রাসকে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদ বলছেন। অতীতে যারা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিরোধিতা করতেন, তারাও মব সন্ত্রাসে উসকানি বা নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস বলেছেন, শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য যে কোনো সহিংসতা ও বৈষম্য অগ্রহণযোগ্য। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেছেন, মব সন্ত্রাস অনুমোদনযোগ্য নয়। জড়িতদের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়ার পাশাপাশি পুলিশের যেসব সদস্য মব ঠেকাতে ব্যর্থ হবেন, তাদের বিরুদ্ধেও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেছেন, যেসব মব জাস্টিসের ঘটনা ঘটছে, মব সহিংসতায় সরকার মর্মাহত। এ ধরনের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধে সরকার কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। অন্যদিকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, মব জাস্টিস নামে এক হিংস্র উন্মাদনা মানবতার শত্রু হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটি গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি গড়ে তোলার পরিবেশকে বিপন্ন করবে। যে কোনো অপমানজনক ও সহিংস আচরণ সংবিধান, আইন ও মানবাধিকারবিরোধী।
ডিএমপি কমিশনার বলেছেন, কোনো ধরনের মবের ঘটনা প্রশ্রয় দেওয়া হবে না। মব সন্ত্রাস উদ্বেগজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ইতিপূর্বে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ফলকার টুর্ক বলেছেন, মব জাস্টিসের মাধ্যমে সংঘটিত হত্যাকাণ্ড কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। তাই প্রতিটি ঘটনার তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। সবাই মব সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে হলেও, তবুও থামছে না মব ভায়োলেন্স। সরকারের দায়িত্ব—সব নাগরিকের জানমাল নিশ্চিত করা। কিন্তু একের পর এক মবের ঘটনা ঘটলেও জড়িতদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেই।
আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার অধিকার কারো নেই। আইনের বিধানমতে, কোনো অপরাধের তথ্য বা কারো বিরুদ্ধে মামলা বা অভিযোগ থাকলে একজন নাগরিক হিসেবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে অবগত করা। বাংলাদেশ সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, সব নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী। সংবিধানের ৩৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, প্রত্যেক নাগরিকের আইনের আওতায় বিচার লাভ ও আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ রয়েছে। ৩৫ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, আইনের দৃষ্টিতে অপরাধী প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত কাউকে দোষী সাব্যস্ত করা যাবে না।
কারো বাড়িতে কোনো নাগরিকের তল্লাশি চালানো বা অভিযানের সময় দলবদ্ধ হয়ে বাসায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে থাকার আইনি অধিকার সাধারণ নাগরিককে দেওয়া হয়নি। কিন্তু এখন কেউ কোনো আইনের তোয়াক্কা করছে না। দেশে সংবিধান ও আইন থাকতে একটি সভ্য সমাজে মব জাস্টিস চলতে পারে না। আমজনতা চায়—সব অপরাধীর দেশের প্রচলিত আইনে উপযুক্ত বিচার হোক, মব ট্রায়ালে নয়। এর ব্যত্যয় ঘটলে সংবিধান অকার্যকর হবে এবং প্রচলিত বিচারব্যবস্থা ভেঙে পড়বে—যা কোনোভাবে কাম্য নয়।
আসুন, মব সন্ত্রাসের মতো গর্হিত কাজ পরিহার করে বলি—আমরাও উত্তম হব না কেন?
লেখক : আইনজীবী
(এই লেখা লেখকের একান্ত ব্যক্তিগত অভিমত; এ সংক্রান্ত কোনো দায় দৈনিক মূলধারা বহন করবে না)