তখনো শেখ হাসিনার পতনের আন্দোলন চলছিল এবং পুলিশ আন্দোলনকারীদের পরাস্ত করতে মরিয়া হয়ে চেষ্টা করছিল। দুইটি মিছিল জড়ো হয়েছিল এনায়েতপুর থানার সামনে। থানায় ছিল তখন ৪০ জন পুলিশকর্মী। দুই পক্ষের প্রচণ্ড শক্তি প্রদর্শনের এক পর্যায়ে পুলিশ প্রাণ বাঁচাতে আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। কিন্তু আন্দোলনকারীরা তাদের আবেদন প্রত্যাখ্যান করে থানার ভেতরে তাণ্ডবলীলা চালায়। পুলিশ সদস্যরা তখন যে যেভাবে পারে, পালিয়ে যেতে থাকে। কিন্তু ১৪ জন পুলিশ সদস্য ধরা পড়ে যায় আন্দোলনকারীদের হাতে। এই ১৪ জন পুলিশস দস্যকেই আন্দোলনকারীরা গণপিটুনিতে অর্থাৎ মব ভায়োলেন্সে হত্যা করে নির্মমভাবে। সেই শুরু ভায়োলেন্স।
ততক্ষণে স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেন ভারতের পথে। দেশ জুড়ে তখন আক্রান্ত সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়ি-ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। আক্রান্ত আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বাড়ি-ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান; আক্রান্ত আহমদিয়াদের উপাসনালয়ও। আক্রান্ত ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১-এ পাকিস্তানের আত্মসমর্পণের ভাস্কর্য; রাজধানী ঢাকার গুলশানে হলি আর্টিজান-সংক্রান্ত ‘দীপ্ত শপথ’ স্মারক; বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ম্যুরালসহ বেশ কিছু মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিস্মারক। এসব শুনে ভয়ে পালাতে গেলেন চাঁদপুরের সেলিম খান ও তার ছেলে চিত্রনায়ক শান্ত খান। সেলিম খানের পরিচালনায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আত্মজীবনীমূলক চলচ্চিত্র ‘টুঙ্গিপাড়ার মিয়া ভাই’-এ বঙ্গবন্ধুর চরিত্রে অভিনয় করেছিল শান্ত। কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না তাদের। পার্শ্ববর্তী বাগাড়া বাজারে মারমুখী মব ভায়োলেন্সে প্রাণ হারায় বাবা-ছেলে দুই জনই।
খবর রটে গেল—বিচারব্যবস্থায় ক্যু হতে পারে। আন্দোলনকারী ছাত্ররা রাস্তায় নেমে এলো; সুপ্রিম কোর্ট ঘেরাও হয়ে গেল। চাপের মুখে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানসহ আপিল বিভাগের বিচারপতিদের পদত্যাগ হয়ে গেল। তারপর আর মব ভায়োলেন্সের গতি থামানো যায়নি। মব ভায়োলেন্সে সম্পন্ন হয়েছে বড় বড় বদলি, পদত্যাগ; তৈরি হয়েছে নতুন নতুন আইন; বদলে গেছে রাষ্ট্রীয় নীতি-নিয়ম। জোর করে পদত্যাগে বাধ্য করা থেকে বাদ পড়েনি কলেজ-স্কুল-বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ব্যক্তি ও শিক্ষক-শিক্ষিকা; বাদ পড়েনি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ও ডেপুটি গভর্নররাও। মব ভায়োলেন্সের শিকার হতে বাদ পড়েনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চোর সন্দেহের ভারসাম্যহীন তফাজ্জল হোসেন এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ করার অপরাধে শামীম আহমেদ। মব ভায়োলেন্স ঠিক করে দিয়েছে—নারী কেমন পোশাক পরবে, কীভাবে পরবে। মব ভায়োলেন্সে আদালতপাড়ায় নিগৃহীত হয়েছে একের পর এক আসামি। জুতা মারা, ডিম নিক্ষেপ এসব থেকে মুক্ত থেকেছে—এমন আসামি খুঁজে পাওয়া কঠিন জুলাই-আগস্টের পরের আদালতপাড়ায়। সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর মামলার রায়ে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করায় হাইকোর্টের বিচারপতি মো. আশরাফুল কামালকে লক্ষ্য করে ডিম ছোড়েন একদল আইনজীবী। ঘটনার তীব্রতায় বেঞ্চের দুই বিচারকই দ্রুত এজলাস ত্যাগে বাধ্য হন।
মব ভায়োলেন্সের সবশেষ শিকার হলেন :সাবেক সিইসি কে এম নুরুল হুদা। ২০১৪ সালের নির্বাচনে তত্কালীন সিইসি কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ, ২০১৮ সালের নির্বাচনে তত্কালীন সিইসি কে এম নুরুল হুদা এবং ২০২৪ সালের নির্বাচনের তত্কালীন সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়ালকে আসামি করে মামলা হয়। তার পরই সাবেক সিইসি নুরুল হুদার বাসায় মব তৈরি করে একদল লোক। তারা নুরুল হুদাকে একটি জুতার মালা পরিয়ে দেয়। এক ব্যক্তি তার গালে জুতা দিয়ে মারতে থাকে। কেউ কেউ নুরুল হুদাকে ডিম ছুড়ে মারে। ভিডিও করে তা সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হয় এবং সারা দেশের মানুষ এই মব ভায়োলেন্সের দৃশ্য দেখতে পায়। হেনস্তার এক পর্যায়ে লোকগুলো তাকে পুলিশের হাতে তুলে দেয়। পুলিশের উপস্থিতিতেও তাকে নানাভাবে অপদস্থ করার দৃশ্য দেখা যায়।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা ‘হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির’ (এইচআরএসএস) হিসাব অনুযায়ী, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম সাত মাসে মব ভায়োলেন্সের ১১৪টি ঘটনা ঘটেছে। এতে ১১৯ জন নিহত এবং ৭৪ জন আহত হয়েছে। বাংলাদেশের মানবাধিকার সংস্থা ‘আইন ও সালিশ কেন্দ্র’ (আসক)-এর এক পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, এপ্রিল পর্যন্ত মব ভায়োলেন্সে নিহত হয়েছে ১৬১ জন। আসকের তথ্যমতে, ছাত্র আন্দোলনের মাস আগস্টেই মব ভায়োলেন্সে নিহত হয় ২১ জন; এছাড়াও সেপ্টেম্বরে ২৮, অক্টোবরে ১৯, নভেম্বরে ১৪, ডিসেম্বরে ১৪, জানুয়ারিতে ১৫, ফেব্রুয়ারিতে ১১, মার্চে ১০ এবং এপ্রিলে ১৮ জন মব ভায়োলেন্সে নিহত হয়।
এই ভায়োলেন্সের দৌরাত্ম্য আর কতদূর—এ প্রশ্ন এখন বাংলাদেশের মানুষের মনে ঘুরছে। ভয়ে আছে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদে আসীন ব্যক্তি থেকে শুরু করে অফিসের পিয়ন পর্যন্ত—কে কখন পড়ে যায় মব ভায়োলেন্সের হাতে! একজন সাবেক সাংবিধানিক সর্বোচ্চ কর্মকর্তা নুরুল হুদার ওপর ভায়োলেন্স দেখে স্তম্ভিত হয়েছে পুরো জাতি। ৭৭ বছর বয়সি একজন সাবেক সচিব, একজন মুক্তিযোদ্ধা, একজন সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার নুরুল হুদাকে মাত্র কয়েক জন ব্যক্তি জোর করে জুতার মালা পরিয়ে দিয়ে, জুতার আঘাত করে, ডিম ছুড়ে অপমান করে এবং ভিডিও করে তা প্রচার করলে প্রশ্ন জাগে মনে—এই মানুষটি কোথায় বসবাস করছেন? একটি দেশে, না কোনো জঙ্গলে? দেশে থাকলে তো সেই দেশে একটি সরকার, একজন সরকারপ্রধান, একজন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পুলিশ, সেনাবাহিনী এসব থাকার কথা! ঘুমন্ত নয়, জেগেই থাকার কথা! দেশে না হয়ে তিনি যদি জঙ্গলে বাস করেন, তাহলে সেখানে নীতি থাকবার কথা নয়, নিয়ম থাকবার কথা নয়—বাঘ-ভালুক যে যার শক্তি দিয়ে যা কিছু করতে পারে। তিনি অভিযুক্ত ছিলেন—বিচার হতে পারে! দোষী হলে শাস্তিও পাবেন! কিন্তু শুধু অভিযোগ তুলেই শাস্তি, জুতার মালা? তা-ও আবার পুলিশ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে? জাতি চোখ বড় বড় করে দেখছে? আইন-আদালত, রাষ্ট্র সবাই দেখছে? সরকারপ্রধান শান্তিতে নোবেলজয়ী অধ্যাপক ইউনূস দেখছেন। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ভাবছেন, মব ভায়োলেন্স অনেকটাই কমে এসেছে।
মাত্র কয়েক মাস আগেও অন্য একটি সরকারের সময়ে বর্তমান প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুত্ফুজ্জামান বাবর, বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া, সাবেক স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী আলতাফ হোসেন চৌধুরী, বিএনপি নেতা ফালুসহ অনেকেই অভিযুক্ত ছিলেন, শাস্তিপ্রাপ্ত পলাতক আসামি ছিলেন। আজ তারা সবাই শুধু মুক্তই নন, সসম্মানে নির্দোষ প্রমাণিত আদালত থেকে। ১৯৯৪ সালের ২০ মার্চ মাগুরা-২ আসনের উপনির্বাচনে ধানের শীষের প্রার্থীকে অন্যায্যভাবে বিজয়ী ঘোষণা করে তত্কালীন নির্বাচন কমিশন। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারিতে আওয়ামী লীগ-জাতীয় পার্টিবিহীন একতরফা নির্বাচনে ২৭৮টি আসনে জয়ী করা হয় বিএনপিকে, যার মধ্যে ৪৯টি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়। সেই সংসদ মাত্র ১১ দিন টিকে ছিল। তত্কালীন নির্বাচন কমিশন সেই বিতর্কিত ভোটকেও বৈধতা দিয়েছিল। সেই সরকারের সময়ে যদি এমন করে একদল মব ভায়োলেন্সের কারিগর তাদের ওপর এভাবে আক্রমণ করত, সেদিনও আমরা আমজনতা শুধু তা দেখে কষ্ট পেতাম। কেননা, কষ্ট পাওয়া ছাড়া কিচ্ছুটি করার শক্তি আমাদের নেই। ঠিক একইভাবে আজও নুরুল হুদাদের প্রতি মব ভায়োলেন্স দেখে আমরা কষ্ট পাচ্ছি, বেদনায়-লজ্জায় বোবা হয়ে যাচ্ছি, স্তম্ভিত হয়ে যাচ্ছি।
দিন যাচ্ছে, রাত হচ্ছে—ক্ষমতায় থাকা সরকার দিব্যি আছে; প্রধান উপদেষ্টা অভিমান করে পদত্যাগের হুমকি দিলেও মব ভায়োলেন্স ঠেকাতে ব্যর্থ হয়ে কিংবা মব ভায়োলেন্সের কারিগরদের একজনের বিরুদ্ধেও কোনো আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে না পেরে পদত্যাগ করার কথা চিন্তা করা দূরে থাক, একটিবার মুখ ফুটে মব ভায়োলেন্সের নিন্দাও করছেন না। অন্যদিকে পুলিশ, সেনাবাহিনী, আদালত একটুও বিব্রত হচ্ছে না। সবার সামনেই চলছে মাত্র কয়েক ডজন লোকের মব ভায়োলেন্সের অপ্রতিরোধ্য রথের চাকা। সেই রথে কেউ ধাক্কা দিচ্ছে, কেউ রথের সারথিদের দেখেও না-দেখার ভান করছে। কিন্তু এতসব অনিয়ম, অবিচার আর বিচারহীনতার দাপাদাপিতে একমাত্র শক্তিশালী ভায়োলেন্স পুরো একটি দেশের ইতিহাস, সুনাম, ঐতিহ্য, মানবিকতা সবকিছু দুমড়ে-মুচড়ে খেয়ে ফেলছে। সভ্য সমাজে কিংবা সভ্য দেশে আছি কি না, এমন আর ভাবতে পারছে না যেন কেউই; বরং একটি দেশে সত্যিই বাস করছি তো—এ প্রশ্নই যেন তাড়া করছে সবাইকে।