আনুষ্ঠানিকভাবে ‘শতফুল ফুটতে দাও’ স্লোগানটি দেওয়া না হলেও জুলাই অভ্যুত্থানের পর মানুষের মনে কোটি ফুলের চিন্তা ফুল্ললিত হচ্ছে। মানুষের মনে জমে থাকা আকাঙ্ক্ষাগুলোর প্রকাশিত রূপ দিতে মোট ১৩টি কমিশন গঠিত হয়েছে। এর মধ্যে ১২টি বিষয়ভিত্তিক ও একটি ঐকমত্য কমিশন, যে কমিশনগুলো হয়েছে তার উপযোগিতা অবশ্যই রয়েছে। তার পরও জনমনে আকাঙ্ক্ষা ছিল বৈষম্য নিরসন উপায় অন্বেষণ কমিশন, শিক্ষা সংস্কার কমিশন হবে, রেলওয়ে সংস্কার কমিশন হবে, এমন আরো ডজন দু-ডজন সংস্কার কমিশন হবে। তেমনি একটি ‘হতে পারত’ কমিশন—প্রশাসনিক এলাকা পুনর্বিন্যাস বা সংস্কার কমিশন।
১৯৪৭ সালে ১৭টি জেলা নিয়ে পূর্ব বাংলা ব্রিটিশ শাসনের বেড়াজাল থেকে প্রথম বার স্বাধীন হয়েছিল। ১৯৭১ পর্যন্ত ২৪ বছর বয়সে জেলার সংখ্যা বেড়েছিল দুইটি—পটুয়াখালী ও টাঙ্গাইল। মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭৮ সালে জামালপুর আর ১৯৮১ সালে বান্দরবান পার্বত্য জেলা গঠনের মাধ্যমে দেশে জেলার সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল ২১টি। জেলা সদরগুলোর বাইরে সেই সময়ে মহকুমার সংখ্যা ছিল ৪৭টি। অবশ্য মাঝখানে ১৯৭৫ সালে মহকুমা বিলুপ্ত করে ৬১টি জেলা গঠিত হয়েছিল বাকশাল আমলে, যা কার্যকর হওয়ার কোনো সময়ই পায়নি। সেই জেলাব্যবস্থা অঙ্কুরে ধ্বংস হওয়ার ৯ বছর পরে ১৯৮৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পর্যায়ক্রমে দেশের ২১টি জেলার সঙ্গে আরো ৪৩টি মহকুমাকে জেলা ঘোষণা করায় দেশে মোট জেলার সংখ্যা দাঁড়ায় ৬৪টি। সেই ১৯৭৫ সালের বাকশালি জেলা পটিয়া বাদ পড়ে যায়।
বাদ পড়ার কারণ হিসাবে কথিত আছে যে, সামরিক শাসক লে. জেনারেল এইচ এম এরশাদ পটিয়াতে জনসভা করার সময় মাঠে পানি জমে থাকায় উপস্থিত শ্রোতৃবর্গ তাদের পাদুকা হাতে রেখেছিলেন বলে তিনি নাখোশ হয়েছিলেন। জেলা সৃজনের গণজোয়ার হতে বাদ পড়ে যায় পটিয়া ছাড়াও লামা, কাপ্তাই ও রামগড় মহকুমা। লামাকে কেন্দ্র করে জেলা গঠনের প্রজ্ঞাপন জারি ও জেলা প্রশাসক নিযুক্ত হয়ে তিন দিনের মাথায় তা বাতিল হয়ে যায়। ঢাকা মহানগরীও পৃথক জেলা হয়নি, মহানগরীর বাইরের এলাকাসমূহসহ সাবেক ঢাকা সদর মহকুমা ঢাকা জেলা হয়ে গেছে। ’৭৫-এ জেলা হয়নি, এমন প্রতিষ্ঠিত মহকুমা নারায়ণগঞ্জ ৮৪-তে জেলায় উন্নীত হয়। ’৭৫-এ মহকুমা ছিল না বা বাকশালি জেলাও হয়নি, ’৭৫-এর পরে মহকুমায় উন্নীত হয়ে ৮৪-তে জেলা হয়েছে পঞ্চগড়, লালমনিরহাট, গাজীপুর ও শরীয়তপুর।
বাংলাদেশে কি জেলা গঠনের পাট ১৯৮৪তেই চুকে গেছে? আর কি কোনো জেলা গঠনের প্রয়োজন নেই? সেই ১৯৮৪ সাল থেকেই সাবেক মহকুমার অধিক্ষেত্র নিয়ে জেলা হওয়ার জন্য হাপিত্যেশ করে প্রহর গুনছে দক্ষিণ চট্টগ্রাম নামে পটিয়া আর বান্দরবানের লামা। দিনাজপুরের ফুলবাড়ী নাকি বিরামপুর এই রশি টানাটানিতে নতুন আরেকটা জেলা গঠিত না হওয়ায় দিনাজপুরের আকার বেঢপ। একটা ফয়সালা হয়ে ফুলবাড়ী, বিরামপুর, হাকিমপুর, নবাবগঞ্জ ও ঘোড়াঘাট নিয়ে নতুন একটা জেলা হতেই পারে। পাইকগাছা, কয়রা, দাকোপ, সাতক্ষীরার আশাশুনি এবং তালাকে তালা পাটকেলঘাটা দুভাগ করে তালা অংশ নিয়ে পাইকগাছাকে কেন্দ্র করে সুন্দরবন জেলা অনেক পুরোনো দাবি। জিল্লুর রহমান রাষ্ট্রপতি থাকাকালে ভৈরব তো প্রায় জেলা হয়েই গিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত ভৈরব আর বাজিতপুরের দ্বৈরথে কোনোটাই জেলা না হলেও কিশোরগঞ্জ জেলার দক্ষিণ-পূর্ব এলাকায় নতুন একটা জেলা হতেই পারে।
১৭৮৭ সালে ভূমিকম্পের কারণে ব্রহ্মপুত্র নদের তলদেশ উত্থিত হওয়ার কারণে এর গতিপথ বদলে যায়। সেই থেকে কুড়িগ্রাম জেলার রৌমারী ও রাজীবপুর জেলার মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। কয়েক প্রজন্ম ধরে রৌমারী রাজীবপুরের মানুষকে জীবন বাজি রেখে প্রমত্ত ব্রহ্মপুত্র পেরিয়ে যোগাযোগ করতে হয় নিজ জেলা কুড়িগ্রামের সঙ্গে। জেলা বা বিভাগীয় শহরে যেতে যে সময় লাগে, তার চেয়ে অনেক কম সময়ে রাজধানী ঢাকায় কাজ সেরে বাড়ি ফিরতে পারে এই দুই উপজেলার মানুষ। এমনকি কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসনের কর্তারাও নদী পেরিয়ে রৌমারী রাজীবপুর যাওয়ার চেয়ে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে বিস্তর ঘুরে যমুনা সেতু পেরিয়ে এই দুই উপজেলায় আসতে। এই দুই উপজেলার মানুষের জীবনের দামকে মাথায় রেখে এই দুই উপজেলার সঙ্গে জামালপুর জেলার বকশীগঞ্জ উপজেলা ও দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার উত্তরাংশের সানন্দাবাড়ীকে জুড়ে সানন্দাবাড়ী নামে একটি নতুন জেলা হতেই পারে।
জামালপুরের জেলা প্রশাসনকে বকশীগঞ্জ বা সানন্দাবাড়ী যেতে হলে ডিঙাতে হয় শেরপুর জেলা। ২০০৫ সালে ড. সা’দত হুসাইন মন্ত্রিপরিষদ সচিব থাকাকালীন সানন্দাবাড়ীকে নতুন জেলা না করে প্রস্তাবিত এলাকাটি শেরপুর জেলার সঙ্গে যুক্ত করার জন্য জেলা প্রশাসক সম্মেলনে অভিমত দিয়েছিলেন। হাতিয়া, সন্দীপ আর মনপুরা দ্বীপ উপজেলাসমূহের দুর্ভোগ সহজে মেটানো সম্ভব না হলেও হাতিয়া আর মনপুরা মিলে একটি জেলা হলে দুর্ভোগ কিছুটা লাঘব হতে পারে। ফটিকছড়ির উত্তরে উত্তর ফটিকছড়ি উপজেলা করে ফটিকছড়ি, উত্তর ফটিকছড়ি, মিরসরাই, সীতাকুণ্ড আর সেই সঙ্গে সম্ভব হলে সন্দীপকে জুড়ে একটা জেলা করলে চট্টগ্রামের ওপর চাপ কমে, পক্ষান্তরে চট্টগ্রামের উত্তরে উন্নয়নের অধিকতর ছোঁয়া লাগার সম্ভাবনা বাড়ে।
অনেক উপজেলাও আছে বেখাপ্পা। যশোর জেলার মাঝারি আকারের অভয়নগর উপজেলা শিল্প এলাকা। শিল্প এলাকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য প্রশাসনকে থাকতে হয় তটস্থ। সেই উপজেলার দুই ইউনিয়ন শুভরাড়া ও সিদ্ধিপাশা যেতে ছুঁয়ে যেতে হয় খুলনার ফুলতলা উপজেলা সদর। সিদ্ধিপাশা তো আবার জাহানাবাদ সেনানিবাসের বিপরীতে। ফুলতলা উপজেলা সদর পেরিয়ে অভয়নগর যেতে এই দুই ইউনিয়নের মানুষের নিঃশ্বাস ভারী হয়ে ওঠে। নদীতে এখন সেতু হলেও ভৈরব নদের পূর্ব পাড়ের আরো দুই ইউনিয়ন শ্রীধরপুর ও বাঘুটিয়া থাকে নজরদারির শিথিলতায়। এই দুই ইউনিয়ন আর নড়াইল সদরের শেখহাটি, কলোড়া, বিছালি ও সিঙ্গাশোলপুর ইউনিয়ন নিয়ে অনেক আগের প্রস্তাব আছে নড়াইল জেলার আওতায় মধুরগাতী উপজেলা গড়ার। সারা দেশে রয়েছে এমন ভূরি ভূরি জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদ গড়ার আকাঙ্ক্ষা। জনগণ ও সরকারের আকাঙ্ক্ষার বৈপরীত্যের জন্য এই আকাঙ্ক্ষাগুলো আলোর মুখ দেখে না।
অন্তর্বর্তী সরকার সারা দেশের মানুষের এই আগ্রহগুলো অন্তত আমলে নিতে পারে। একটি প্রশাসনিক এলাকা পুনর্বিন্যাস বা সংস্কার কমিশন করে গণমানুষের এই চাওয়াগুলো পর্যালোচনা করা যেতেই পারে। ১৯৮৪ সালের পরে অতিক্রান্ত ৪১ বছরে একটাও নতুন জেলা না হওয়া একধরনের বন্ধ্যাত্ব। এবার এই বন্ধ্যাত্ব ঘুচুক।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব
(এই লেখার সম্পূর্ণ দায়ভার লেখকের একান্ত; এর সঙ্গে দৈনিক মূলধারার কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই)