বাংলাদেশ গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলের অত্যন্ত ঘনবসতি একটি দেশ। যেখানে প্রতি বর্গমাইলে ৩ হাজার ৪৯৬ জন লোকের বাস। আর ঢাকা শহরে এর ঘনত্ব বর্গমাইলে ৫০ হাজার ১ জন। এই বিশাল ঘনবসতি এলাকার মানুষ যদি যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে না চলে তবে কখনোই সংক্রামক রোগ প্রতিরোধ সম্ভব নয়। এক দিকে যেমন অধিক সংখ্যক মানুষ তাদের চলাচল ও খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করার কাজে নিয়োজিত।
অন্যদিকে পরিবেশ তৈরি হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের বাহক ও জীবাণুর আঁতুড়ঘরে। কী শহর, কী গ্রাম—সব স্থানেই আজ ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশার দৌরাত্ম্য লাগামহীন হয়ে পড়েছে। মশার মধ্যে স্বাচ্ছন্দ্যে বেড়ে ওঠা ডেঙ্গু ভাইরাস তার ভয়াল থাবায় কেড়ে নিচ্ছে অতিমূল্যবান প্রাণ। এর মধ্যে আরেক ভয়ানক এক ভাইরাস করোনাও বেশ ভালোভাবেই উঁকিঝুঁকি মারছে। দেশে কাঙ্ক্ষিত খাদ্য উৎপাদনের জন্য দিশেহারা কৃষককুল যেমন যথেচ্ছা কীটনাশক ও রাসায়নিক সার প্রয়োগের মাধ্যমে সমগ্র পরিবেশকে করে তুলেছে মশা ও অন্যান্যবাহক ও জীবাণুর অভয়ারণ্য।
তেমনিভাবে প্রতিনিয়ত উৎপাদিত বর্জ্য ও বৈশ্বিক তাপমাত্রা জীবাণু ও মশার শত্রু বৃদ্ধিতে দিয়েছে ঘি ঢেলে। এমনি এক পরিস্থিতিতে যোগ হয়েছে খাদ্যে পুষ্টির পরিবর্তে বিষাক্ত পদার্থের উপস্থিতি। তাই তো যথাযথই এখন আওয়াজ উঠেছে ‘খাদ্যের নিরাপত্তা নয়, চাই বিশুদ্ধ খাদ্যের নিরাপত্তা’। এই নানামুখী সমস্যার প্রতিফলন পড়েছে জনস্বাস্থ্যের ওপর। আজ ঘরে ডায়বেটিস, ক্যানসার, স্ট্রোক, হার্ট ফেইলর প্রভৃতি নন-কমিউনিক্যাবল রোগ সমূহের সঙ্গে ডেঙ্গু, করোনা প্রভৃতিতে নিদারুণভাবে জর্জরিত জাতি।
তাই তো একজন মাননীয় উপদেষ্টা যথার্থই বলেছেন, সারা দেশটাকেও যদি একটি হসপিটালে রূপান্তর করা হয় তারপরও সমস্যার সমাধান হবে না। তাহলে সমাধান কী? সমাধান একটাই তা হলো—জনস্বাস্থ্য শিক্ষা ও এর যথাযথ বাস্তবায়ন। মানুষ নিজে যদি বুঝতে পারে। গরুকে যে গ্রোথ রেগুলেটরি হরমোন খাওয়ানো হচ্ছে মোটাতাজা করণের জন্য তা স্বাস্থ্যসম্মত নয়। তার বিকল্প কী হতে পারে এখন। তা বিজ্ঞানীরাই ঠিক করবেন। সাধারণ মানুষ যদি বুঝতে পারে যথেচ্ছা কীটনাশক প্রয়োগ ক্যানসারসহ অন্যান্য জটিল রোগের কারণ। একইভাবে পরিবেশদূষণই ভেক্টরবাহিত রোগের অন্যতম কারণ। অনিয়ন্ত্রিত জাংক ফুডই অবিসিটি বা স্থূলকায়নের মূলকারণ। যা ডায়াবেটিসসহ অন্যান্য জটিল রোগের উৎস।
মহান স্বাধীনতার সময় দেশের জনসংখ্যা ছিল মাত্র সাড়ে ৭ কোটি। চাষযোগ্য জমির পরিমাণও এখনকার তুলনায় প্রায় তিন গুণ ছিল। অথচ তারপরও খাদ্য ঘাটতি ছিল। আর এখন লোকসংখ্যা বেড়েছে প্রায় তিন গুণ। আবার চাষযোগ্য জমি কমে গেছে একই হারে। তারপরও আমরা বলতে পারি খাদ্যে মোটামুটি স্বয়ংসম্পূর্ণ। আমরা আর এখন বুক চেতিয়ে বলতে পারি—মাছ উত্পাদনে আমরা বিশ্বে চতুর্থ। চাল উৎপাদনে আমাদের অবস্থান রয়েছে। রয়েছে কৃষির অন্যান্য উৎপাদনেও। এর পেছনে যে শক্তি কাজ করেছে তা ১৯৬১ সালে প্রতিষ্ঠত বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। সারা বছর ধরে সবজি, মাছ, মাংস, দুধ, ডিমসহ সব পুষ্টি সরবরাহের সুফল বয়ে এনেছে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের তৈরি বিজ্ঞানীদের কর্মতৎপরতা। দেশের মানুষের মুখে হাসি ফুটেছে। তাই কৃষিপ্রধান দেশে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন সত্যিই ছিল যুগান্তরকারী একটি পদক্ষেপ। এই পদক্ষেপ গৃহীত না হলে আজকেও হয়তো-বা এই বিশালজনগোষ্ঠীকে খাদ্যের জন্য অন্যের দরবারে ভিক্ষুকের মতো হাত পাততে হতো। বিলিয়ে দিতে হতো আমাদের জাতি সত্তাকে। যেমন করে চিকিৎসার জন্য, একটি টেস্টের রিপোর্টের জন্য ভিক্ষারির মতো চেয়ে থাকতে হয় পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের লাল প্যাথ, এস আর এল বা অন্য কোনো ল্যাবের দিকে।
প্রকৃত ডায়াগনসিসের অভাবে দেশের হাজার হাজার মানুষ ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে অকাল মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে। একইভাবে সর্বস্বান্ত হচ্ছে চিকিৎসা-ব্যয় মেটাতে। অকূলপাথারে নিমজ্জিত হচ্ছে হাজার হাজার পরিবার। তছনছ হয়ে যাচ্ছে এই মানবজনম। ১৯৬১ প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সোনালি ফসল বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার এগ্রিকালচার, বাংলাদেশ ফিশারিজ গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটসহ অসংখ্য প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানগুলো যেমন সফলতার সহিত গবেষণা কর্ম সম্পাদন করে দেশ ও বিদেশে সুনাম অর্জন করেছে, তেমনি মানুষের খাদ্য ও পুষ্টির চাহিদা পূরণে রেখেছে অভূতপূর্ব অবদান। নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে কৃষিতে বিশ্বের দরবারে সব মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে।
ঠিক এমনিভাবে দেশের এই ক্রান্তিকালে আশু প্রয়োজন হয়েছে জনস্বাস্থ্য শিক্ষা ও গবেষণার। তাই জনস্বাস্থ্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা অনস্বীকার্য হয়ে পড়েছে। জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান, নিপসম, মহাখালী ঢাকা প্রতিষ্ঠার পর থেকে আজ অবধি জনস্বাস্থ্য শিক্ষায় শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করে আসছে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে সুপরিচিত সুনামধন্য শীর্ষস্থানীয় এই প্রতিষ্ঠানের কাজের পরিধি বৃদ্ধির জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর সময়ের প্রচণ্ড দাবিতে পরিণত হয়েছে। দেশে সংক্রামক ও অসংক্রামক রোগের সঙ্গে সম্পৃক্ত সব রিস্ক ফ্যাকটরগুলোকে গুরুত্ব অনুসারে একটি ফ্রেম ওয়ার্কের মধ্যে নিয়ে সিস্টেমিক গবেষণার মাধ্যমে বাস্তবভিত্তিক প্রায়োগিক সমাধান বের করাই হবে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম প্রধান কাজ।
এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চতর ডিগ্রি পাওয়া জনস্বাস্থ্যবিদরা দেশ-বিদেশে জনস্বাস্থ্য সুরক্ষা বলয় হিসেবে কাজ করবে। ধরুন ২০১৭ সাল থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত ডেঙ্গুর যে ধারাবাহিক ভয়াবহতা দিনদিন দেশবাসীকে এত নাজুক পরিস্থিতিতে নিয়ে যাচ্ছে তার গতিরোধের জন্য যে মানের ওয়ার্কফোর্স প্রয়োজন, যে মানের গবেষণাগার প্রয়োজন, যে মানের জনবলের প্রয়োজন— তা শুধু অপ্রতুলই নয়, একেবারেই নগণ্য। তাই এই বিশাল জনগোষ্ঠীর প্রতিনিয়ত মৃত্যুর আশঙ্কা থেকে ফেরাতে চাই এমন মানের একটি জনস্বাস্থ্য বিশ্ববিদ্যালয় যেখানে প্রতিনিয়ত নিত্যনতুন গবেষণার মাধ্যমে আধুনিক ও গতিশীল কৌশল প্রযুক্তি ও প্যাটেন্ট উদ্ভাবন হবে। যার ফলাফল জনগোষ্ঠীকে স্বাস্থ্য সুরক্ষার বৈজ্ঞানিক বেষ্টনীতে সুদৃঢ়ভাবে ঘিরে রেখে সুরক্ষা প্রদান করে উন্নত জীবনের নিশ্চয়তা বিধান করবে। যে বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে গড়ে উঠবে বিশ্বমানের গবেষণাকেন্দ্র ও এক্রিডেটেড ল্যাবরেটরি যেখানে তৈরি হবে ইমার্জিং ও রি-ইমার্জিং টিকাসহ প্রতিরোধের সব রোগের টিকাসহ অন্যান্য ওষুধ ও বৈজ্ঞানিক কৌশল। নিশ্চিত হবে জনস্বাস্থ্য। সুরক্ষা পাবে অর্থনীতি। সমৃদ্ধ হবে দেশ।