অবশেষে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধবিরতি চুক্তি ছাড়াই গত ২৯ এপ্রিল স্বাক্ষরিত হলো যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইউক্রেনের বিরল খনিজ সম্পদের উত্তোলন এবং বিক্রয়সংক্রান্ত চুক্তি, যার অধীনে ‘রিকনসট্রাকশন ফর মিনারেল ডেভেলপমেন্ট’ নামে একটি তহবিল গঠিত হয়েছে, যেখানে প্রথম ধাপে কয়েক শ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবে যুক্তরাষ্ট্র। এর আগে দুই সপ্তাহ ধরে আলোচ্য চুক্তিটির বিষয়ে দুই পক্ষই ঐকমত্যে পৌঁছেছিল। দুই দেশের শীর্ষ নেতৃত্বের মধ্যে গত ২৭ এপ্রিল পোপ ফ্রান্সিসের শেষ কৃত্যানুষ্ঠানের ফাঁকে ভ্যাটিকানের সেন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকায় সংক্ষিপ্ত আলোচনাটি ফলপ্রসূ ছিল, যার সূত্র ধরেই পরবর্তী দুদিনের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরের প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হয়। এই চুক্তিকে রাশিয়ার জন্য ইউক্রেনের সঙ্গে যুদ্ধবিরতির নতুন একটি চাপ হিসেবে দেখা যাচ্ছে। চুক্তিটি সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে দুই পক্ষ থেকে জানানো না হলেও দুই দেশের সরকারের পক্ষ থেকেই দেওয়া বক্তব্যে ধারণা পাওয়া যায়, ইউক্রেনের পুনর্গঠনকে মূল ধরে এটি স্বাক্ষরিত হয়েছে। এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থমন্ত্রী স্কট বেসেন্ট বলেছেন, ‘এই চুক্তির মধ্য দিয়ে একটি শক্তিশালী ও সমৃদ্ধ ইউক্রেন গঠনের ক্ষেত্রে দুই দেশের প্রতিশ্রুতি প্রতিফলিত হবে।’ এর মধ্য দিয়ে ইউরোপের দেশগুলো, যারা যুদ্ধের শুরু থেকেই ইউক্রেনের সঙ্গে ছিল, তাদের সঙ্গে এর ফলে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউক্রেনের দূরত্ব আরো বাড়ল কি না, সে বিষয়টি নিয়ে ভাবতে গেলে বেসেন্টের আরেকটি উক্তির প্রতি বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে। তিনি স্পষ্ট করে বলেন, ‘রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে সহায়তাকারী অন্য কোনো রাষ্ট্রকে ইউক্রেনের এই পুনর্গঠন প্রক্রিয়া থেকে উপকৃত হওয়ার সুযোগ দেওয়া হবে না।’ অর্থাত্, বিষয়টি নিয়ে স্পষ্টতই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইউরোপের এক আনুষ্ঠানিক দূরত্ব সৃষ্টি হলো।
এ নিয়ে আমরা জার্মানির পক্ষ থেকে ইতিপূর্বে যে প্রতিক্রিয়া দেখেছি, সেটা হলো, ইউক্রেনের কোনো অঞ্চল ছেড়ে দেওয়ার বিনিময়ে রাশিয়ার সঙ্গে যে কোনো ধরনের যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষর ইউক্রেনের জন্য আত্মঘাতী হবে বলে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইউক্রেনের এই বিরল খনিজ সম্পদের ভাগাভাগি নিয়ে চুক্তি স্বাক্ষরের আগের দিন ভ্যাটিকান থেকে ফিরে সাংবাদিকদের ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০১৪ সালে রাশিয়া কর্তৃক ইউক্রেনের ভূমি ক্রিমিয়া অধিগ্রহণ নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে জানিয়েছেন, তিনি মনে করেন ক্রিমিয়াকে রাশিয়ার ভূখণ্ড হিসেবে স্বীকৃতি দিতে ইউক্রেনের আপত্তি থাকার কথা নয়। এর মধ্য দিয়ে আরো কয়েকটি প্রশ্নের সমাধানও জরুরি, আর সেগুলো হচ্ছে ইতিমধ্যে ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলীয় দনভাসে ইউক্রেনের মোট ভূখণ্ডের প্রায় এক-পঞ্চমাংশ রাশিয়ার অধিগ্রহণ এবং ইউক্রেনের ন্যাটোতে যোগদানের বিষয়টি। যেহেতু যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনের সঙ্গে একটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করে ফেলেছে এবং এখানে তাদের কৌশলগত এবং অর্থনৈতিক স্বার্থ সম্পৃক্ত হয়ে গেছে, এক্ষেত্রে রাশিয়ার সঙ্গে ইউক্রেনের যুদ্ধবিরতি যতটা না ইউক্রেনের জন্য জরুরি, একইরকমভাবে প্রয়োজন যুক্তরাষ্ট্রের জন্যও, নয়ত পুরো বিষয়টি নিয়েই তারা বড় ধরনের হোঁচট খাবে।
ইউক্রেনের অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে দেওয়া এক ঘোষণায় এই চুক্তিটি কেন তদের স্বার্থের জন্য সহায়ক, সেই ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, এর মধ্য দিয়ে যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউক্রেনের পুনর্গঠন প্রক্রিয়টি সহজ হবে। এর ফলে আগামী দশ বছর বিরল খনিজ সম্পদ থেকে প্রাপ্ত অর্থের সম্পূর্ণ অংশ ব্যয় করা হবে দেশটির পুনর্গঠন ও উন্নয়নের পেছনে এবং এর পর থেকে মোট অর্থের ৫০ শতাংশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গ্রহণ করবে তাদের লভ্যাংশ হিসেবে। তাদের পক্ষ থেকে আরো জানানো হয়েছে যে, এই চুক্তি কেবল ভবিষ্যতে দেশটিতে মার্কিন সামরিক সহায়তার দিকে নজর দেবে, অতীতের বিষয়গুলো এর অন্তর্ভুক্ত হবে না; অর্থাত্, ইতিপূর্বে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এতদিন ধরে ইউক্রেনকে যুদ্ধের জন্য দেওয়া অর্থ সহায়তা ফেরত চেয়ে যে চাপ প্রয়োগ করেছেন, তা কার্যত বাতিলযোগ্য বলে বিবেচিত হবে। এদিক দিয়ে ইউক্রেনের পক্ষ থেকে এই চুক্তি তাদের ভবিষ্যতের জন্য একটি রক্ষাকবচ হিসেবে বিবেচনা করে এটিকে একটি কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি বলে মনে করছে।
ইউক্রেনের ওপরিউক্ত দাবি বিবেচনায় নিলে তারা একতরফাভাবে কেবল নিজেরাই লাভবান হয়ে যাবে, এটি হাস্যকর মনে হওয়া স্বাভাবিক। এখানে মনে রাখতে হবে যে, এর মধ্য দিয়ে তারা রশিয়ার সঙ্গে একটি সম্ভাব্য যুদ্ধবিরতির পর নিজেদের প্রতিরক্ষায় যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে পূর্ণাঙ্গ সহায়ত পাবে। সেদিক দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য রাশিয়ার মতো একটি শক্তির সঙ্গে মোকাবিলা করতে গেলে রাশিয়ার দিক থেকে এতদিন ধরে করে আসা দাবিসমূহকে পরিপূর্ণভাবে অগ্রাহ্য করার কোনো উপায় নেই। সেক্ষেত্রে ট্রাম্প ইতিপূর্বেই এমন ধারণা দিয়ে রেখেছিলেন যে, একটি সফল যুদ্ধবিরতিতে পৌঁছোতে হলে রাশিয়ার কাছে নিজেদের কিছু ভূমি বিসর্জন দিতে হবে ইউক্রেনকে। সেই সঙ্গে ন্যাটোতে যোগদানের বিষয়ে তো আগেই মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট ধারণা দিয়ে রেখেছিলেন, যে যুদ্ধবিরতির স্বার্থে রাশিয়ার এই দাবিটিও হয়তো মেনে নিতে হবে। ইউক্রেনের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষরের পর হোয়াইট হাউজ থেকে জানানো হয়েছে যে, আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে রাশিয়ার সঙ্গে ইউক্রেনের একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি হতে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে ট্রাম্পের হয়ে কাজ করছেন তার বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ, যিনি সাম্প্রতিক এই চুক্তিটি স্বাক্ষরের পেছনে ভূমিকা রেখেছেন এবং ইরানের সঙ্গেও যুক্তরাষ্ট্রের একটি সম্ভাব্য চুক্তির জন্য কাজ করে যাচ্ছেন।
রাশিয়া-ইউক্রেনের মধ্যকার একটি চুক্তি স্বাক্ষরের বিষয়ে রাশিয়ার তরফ থেকেও একধরনের তাগিদ আছে। এ বিষয়ে মধ্যস্থতাকারী উইটকফের সঙ্গে ক্রেমলিনে কয়েক দফায় পুতিনের সাক্ষাতের পর যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এমনটাই জানানো হয়েছিল। এছাড়াও ইতিপূর্বে ট্রাম্প-পুতিনের মধ্যকার ফোনালাপেও পুতিনের পক্ষ থেকে চুক্তি স্বাক্ষরের দিকটিতে ইতিবাচক সাড়া দেওয়া হয়েছিল। তবে এখানে মূল বিষয় হচ্ছে রাশিয়ার দাবি কতটুকু পূরণ করা হবে। সাম্প্রতিক সময়ে গত ২৩ এপ্রিল কিয়েভকে লক্ষ্য করে রাশিয়ার ২১৫টি ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়াকে যুক্তরাষ্ট্র নতুন করে উত্তেজনা সৃষ্টি হিসেবে দেখছে এবং প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প পুতিনকে একটি চুক্তির স্বার্থে এখনই থামতে বলেছেন। এখন পুতিনকে একটি যুদ্ধবিরতিতে সম্মত করাতে ট্রাম্প তার দাবি পূরণে ইউক্রেনকে কতটা সম্মত করাতে পারবেন, এটাও একটা বড় প্রশ্ন। এদিকে বিশেষ দূত উইটকফ ইরানের সঙ্গেও যুক্তরাষ্ট্রের একটি সম্ভাব্য চুক্তি নিয়ে এখন পর্যন্ত যতটুকু কাজ করেছেন, তাতে সন্তোষ প্রকাশ করলেও এখানেও রাশিয়া বিষয়টিকে কীভাবে দেখছে, সেটার ওপর নির্ভর করছে অনেক কিছু। মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইলের ভবিষ্যত্ হামলা থকে ইরান সম্পূর্ণ সুরক্ষা না পেলে সেখানে রাশিয়ার যত্সামান্য প্রভাব ভীষণ হুমকির মধ্যে পড়বে। এক্ষেত্রে ইউক্রেন ও ইরান—এই দুইয়ের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করে মার্কিন জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় ট্রাম্প কতটা সফল হবেন, সেটাও ভেবে দেখার অবকাশ রয়েছে।
চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন করে শুরু হওয়া বাণিজ্য যুদ্ধের আলোকে ইউক্রেনের সঙ্গে স্বাক্ষরিত চুক্তির বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। চীন হচ্ছে বিশ্বের বিরল খনিজ সম্পদের সবচেয়ে বড় উত্পাদক দেশ এবং এর সবচেয়ে বড় রপ্তানি গন্তব্য ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। চীনের ওপর মার্কিন নতুন শুল্কারোপের পর দেশটি যুক্তরাষ্ট্রে তাদের খনিজ সম্পদ রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞার ঘোষণা দিয়েছে। মহাকাশ প্রযুক্তি থেকে শুরু করে সব ধরনের প্রযুক্তির উত্কর্ষের কাজে লাগে এই বিরল খনিজ সম্পদ। ধারণা করা যায়, এই মেয়াদে দায়িত্ব নেওয়ার আগে থেকেই ট্রাম্প চীনের সঙ্গে নতুন করে বাণিজ্য যুদ্ধ শুরু হলে এর বিকল্প হিসেবে ইউক্রেনকে চিন্তা করে রেখেছিলেন। এক্ষেত্রে তিনি বিশ্বরাজনীতির মারপ্যাঁচ কতটা উপলব্ধি করে তার বর্তমান এই সিদ্ধান্তে এসেছেন, এটাও ভাবনার দাবি রাখে। যুক্তরাষ্ট্র একতরফাভাবে ইউক্রেন থেকে সুবিধা নেবে, ভবিষ্যতে রাশিয়ার নিরাপত্তা হুমকি থেকে দেশটিকে রক্ষা করবে, ইউরোপের সঙ্গে দীর্ঘদিনের সম্পর্ককে চুকিয়ে একতরফাভাবে নিজেদের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করবে, রাজনৈতিক অর্থনীতির এমন সহজীকরণ ট্রাম্পীয় নীতি রাজনীতির গতিপথকে কোথায় নিয়ে দাঁড় করাবে, এটা নিয়ে চলছে বিস্তর বিশ্লেষণ।
বাস্তবে পরিস্থিতির বিশ্লেষণ করলে বিষয়টি এমন দাঁড়ায় যে, ইউক্রেনের সঙ্গে এই চুক্তির মধ্য দিয়ে তিনি রাশিয়ার জন্য নতুন করে দরকষাকষির নতুন একটি ক্ষেত্র সৃষ্টি করে দিয়েছেন। বিশ্ব রাজনীতির ধূর্ত খেলোয়াড় ভ্লাদিমির পুতিন এই সহজ সুযোগটিকে সহজে ছাড়তে চাইবেন না। ইউক্রেনের নিরাপত্তার জন্য কেবল ইউরোপের সহায়তা যথেষ্ট নয়, এমন বিবেচনা থেকে জেলেনস্কির জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি সমঝোতা যাওয়ার বিকল্প ছিল না। তবে এখন এর পরও যদি রাশিয়ার দিক থেকে ইউক্রেনের ওপর হামলার মাত্রা না কমে কিংবা একটি কার্যকর যুদ্ধবিরতি চুক্তি সম্পাদিত না হয়, সেক্ষেত্রে রাশিয়ার হুমকিটি কিন্তু কেবল ইউক্রেনের ওপরই সীমাবদ্ধ থাকবে না, এটি হবে মার্কিনিদের জন্য আরো বড় হুমকি।
লেখক : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়