ফুটবল বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলাগুলোর একটি। রাত জেগে স্প্যানিশ লা-লিগা, ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ অথবা আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, জার্মানি, পর্তুগালদের খেলা দেখার লোক এ দেশে কম নেই। কিন্তু গত কয়েক দশকে ক্রিকেটের উন্নতি আর ফুটবলে জাতীয় দলের আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পিছিয়ে পড়ার দরুন দেশের ফুটবল উন্মোদনায় কিছুটা ভাটা পড়েছিল। তবে আশার কথা হচ্ছে এক হামজার আসাতেই ফুটবলের প্রতি ব্যাপক আগ্রহ বেড়েছে দেশের ক্রীড়াপ্রেমীদের। সেই সঙ্গে কানাডা প্রবাসী সমিত সোম, ইংল্যান্ড প্রবাসী কিউবা মিচেল কিংবা ইতালি প্রবাসী ফাহমিদুলকে নিয়েও আগ্রহের কমতি নেই দেশের ফুটবল ভক্তদের। তাছাড়া পুরো জাতি অপেক্ষা করছে মার্কিন প্রবাসী সুলিভান ব্রাদার্সদের লাল-সবুজ জার্সিতে দেখার।
মাঝেমধ্যেই সোশ্যাল মিডিয়ায় গুঞ্জন শোনা যায় প্রবাসী ফুটবলার যারা দেশের বাইরের লিগে খেলে তাদের জাতীয় দলে রাখার ব্যাপারে নাকি আপত্তি আছে কারো কারোর। সে সংখ্যাটা হয়তো কোটি ফুটবলপ্রেমীর তুলনায় নগণ্য। কিন্তু সেই নগণ্য সংখ্যাটাই আবার দেশের ফুটবলে বড় প্রভাব রেখে ফেলে। গুঞ্জন সত্যি হলে দেশের বৃহত্তর স্বার্থে, দেশের ফুটবলের বৃহত্তর স্বার্থে ওদের থামা উচিত। আমাদের বুঝা উচিত এই দেশটা আমাদের। যে ছেলেটা বাংলার কাদা মাটিতে, ধুলোবালি মেখে ফুটবলার হয়েছে সে যেমন বাংলাদেশি তেমনি বিদেশের চাকচিক্যময় জীবন ছেড়ে বাংলাদেশের পাসপোর্ট নিয়ে যে বা যারা এই বাংলার হয়ে খেলতে আসেন বা আসতে চান তারাও বাংলাদেশি। আমাদের দেশের অর্থনীতিতে প্রবাসীদের একটা বড় অবদান আছে। তাদের পাঠানো রেমিট্যান্স বরাবরই আমাদের অর্থনীতিতে বড় একটা প্রভাব ফেলে। কিন্তু আমরা সব সময় সেই প্রবাসী ভাইদেরকে তাদের প্রাপ্য মর্যাদা দিতে পারি না। শেকড়ের টানে বাংলাদেশে আসা প্রতিভাবান ফুটবলারদেরও যদি একই দশা হয় তবে তা হবে আমাদের জন্য লজ্জার, হতাশার।
প্রবাসী ফুটবলাররা কিংবা বংশোদ্ভূত অথবা বিদেশি নাগরিককে নিজ দেশের জাতীয়তা দিয়ে জাতীয় দলের হয়ে খেলিয়েছে পৃথিবীর বহু দেশ। এমনকি ২০১৮ সালে ফ্রান্সের যে দলটা বিশ্বকাপ জিতেছিল সেই দলেও ছিল উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বিদেশের বংশোদ্ভূত বা অভিবাসী ফুটবলার। এ কথা সত্য যে ফ্রান্সের সঙ্গে বাংলাদেশের ফুটবলীয় অবকাঠামো, ধ্যান-ধারণার তুলনা চলে না কিছুতেই। তবু স্বপ্নটা দেখতে অসুবিধে কোথায়? ইউরো, কোপা আমেরিকা বা বিশ্বকাপের সময়টাতে পুরো বাংলাদেশেই দেখা যায় বিদেশি দলগুলোর প্রতি এ দেশের সমর্থকদের উন্মাদনা। অথচ আমাদের জাতীয় ফুটবল দল এখনো এশিয়ান কাপেই নিয়মিত হতে পারল না। ফিফা র্যাংকিয়েও তলানির দিকে আমাদের অবস্থান। তাই এই মুহূর্তে আমাদের ফুটবলে চাই কিছু আমূল-পরিবর্তন।
বিশেষ করে স্থায়ী ও টেকসই উন্নয়নের জন্য উন্নত করতে হবে দেশের ফুটবলের অবকাঠামো। আর এজন্য প্রথম দরকার ফুটবল একাডেমি ও প্র্যাকটিস গ্রাউন্ড। ইউরোপ-আমেরিকার বিখ্যাত ক্লাবগুলো হয়তো নিজের খরচেই একাডেমি তৈরি করে। কিন্তু বাংলাদেশের বাস্তবতা ভিন্ন। তাই বাফুফের পাশাপাশি সরকার ও করপোরেট হাউজগুলো এক্ষেত্রে সহায়তা করতে পারে। তাছাড়া প্রয়োজন বয়সভিত্তিক দলগুলোর মানোন্নয়ন। উন্নতমানের ট্রেনিং ও ভালো কোচদের অধীনে প্রশিক্ষণ। বয়সভিত্তিক পর্যায়ে আমরা অনেক ভালো ফুটবলার দেখতে পাই। কিন্তু কালের বিবর্তনে তারা হারিয়ে যায়। এ দেশে ফুটবল প্রতিভা নেহাত কম নয়। কিন্তু সে প্রতিভাগুলোকে এভাবে অঙ্কুরে বিনষ্ট হতে দেওয়া যাবে না। নিয়মিত জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে লিগ, বয়সভিত্তিক প্রিমিয়ার লিগ, দেশের আট বিভাগের আটটা ফুটবল ডেডিকেটেড স্টেডিয়াম নিয়ে সেখানে হোম অ্যান্ড অ্যাওয়ে ভিত্তিতে দেশি- বিদেশি মানসম্মত ফ্র্যাঞ্চাইজি টুর্নামেন্টে করা গেলে সেটিও হতে পারে দেশের ফুটবল উন্নয়নে একটা বড় মাইলফলক। তাছাড়া আমরা সব সময়ই শুনি আর্জেন্টিনা, ব্রাজিলের মতো দেশগুলো আমাদের ফুটবল উন্নয়নে কাজ করতে চায়। আমরা যদি তাদের থেকে কোচ, প্রশিক্ষণ এবং ইত্যাদি লজিস্টিক সহায়তা নিতে পারি তাহলে তা থেকেও দেশের ফুটবল উপকৃত হতে পারে অনেকাংশেই। আর সবশেষে, স্থানীয় ও প্রবাসী ফুটবলার নিয়ে বিভেদ নয়, আমরা চাই ২০২৭ এশিয়ান কাপে উড়ুক লাল সবুজের পতাকা।
লেখক : শিক্ষার্থী, ঢাকা কলেজ, ঢাকা