২০১৯ সালের ১৫ মার্চ নিউজিল্যান্ড হত্যাকাণ্ড ঘটনার খবর একটি দৈনিকের প্রতিবেদক এভাবে শুরু করেছিলেন, ‘দিনের শুরুটা ছিল আর পাঁচটা দিনের মতোই। সপ্তাহান্তের ছুটির দিনের আগে ক্রাইস্টচার্চের বাসিন্দারা নিচ্ছিল ছুটি কাটানোর প্রস্তুতি। কিন্তু দিনের শেষটা হলো রক্তের সোঁদা গন্ধে।’ শান্তির সূচকে বিশ্ব জুড়ে সুনাম নিউজিল্যান্ডের। ২০১৮ সালে শান্তিপূর্ণ দেশের তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে দেশটি। এমন একটি দেশেই শুক্রবার দুপুরে মসজিদে হলো নারকীয় সন্ত্রাসী হামলা। নিহতের সংখ্যা ৫০, আহত ৪৮।
নিহতের মধ্যে পাঁচ জন বাংলাদেশি। তাদের মধ্যে ক্রাইস্টচার্চের লিংকন বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি বিভাগের শিক্ষক কৃষিবিদ ডক্টর আব্দুস সামাদ ও তার স্ত্রী রয়েছেন। হামলা থেকে অল্পের জন্য প্রাণে রক্ষা পান নিউজিল্যান্ড সফররত বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের সদস্যরা। ঘটনার সময় তারা মসজিদের খুব কাছেই ছিলেন। শনিবার রাত সাড়ে ১০টার পর তারা দেশে ফেরেন।

অকস্মাৎ এমন হামলার ঘটনায় নিউজিল্যান্ডের অধিবাসীরা হতভম্ব হয়ে পড়েন। নিউজিল্যান্ডে এ ধরনের হত্যাকাণ্ডের উদাহরণ খুঁজতে গেলে ইতিহাসের অনেক পাতা ওলটাতে হবে, যেতে হবে অনেক পেছনে। ১৯৪৩ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের কারণে এ ধরনের ব্যাপক প্রাণহানি প্রত্যক্ষ করেছিল দেশটি। এরপর থেকে আর ঘটেনি কখনো।
২০১৯ সালের ১৫ মার্চ নতুন উদাহরণ সৃষ্টি হয় দেশটিতে। আল নূর মসজিদে গুলি চালানোর পর বন্দুকধারী ব্রেন্টন ট্যারান্ট নিকটবর্তী লিনউড মসজিদে যান। সেখানে তাকে বাধা দেন আবদুল আজিজ নামের এক আফগান অভিবাসী। রাস্তায় পড়ে থাকা একটি বন্দুক তুলে গুলি চালানোর চেষ্টা করেন আজিজ। কিন্তু ঐ বন্দুকে গুলি ছিল না। আবদুলের হাতে বন্দুক দেখে নিজের বন্দুক ফেলে পালানোর চেষ্টা করেন ব্রেন্টন। বিবিসির খবরে বলা হয়, দুই জন স্থানীয় পুলিশ কর্মকর্তা এরপর ব্রেন্টনের পিছু নিয়ে গাড়ি আটকে দেন, গ্রেফতার হন ব্রেন্টন।
মসজিদে হামলা চালিয়ে শত মানুষকে হতাহতের পরও বিকার ছিল না তার মধ্যে। ছবি তোলার সময় ব্রেন্টন হাতকড়া পরা অবস্থায় ডান হাতের আঙুল দিয়ে বিশেষ ইঙ্গিত করেন। ব্রিটিশ সংবাদপত্র মেট্রো এই ইঙ্গিতের ব্যাখ্যা করে বলে, এর মাধ্যমে ব্রেন্টন শ্বেতাঙ্গদের শ্রেষ্ঠত্বের কথা বুঝিয়েছিলেন। গণমাধ্যেমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, তিনি ২৮ বছর বয়সি অস্ট্রেলীয় শ্বেতাঙ্গ। ২০২০ সালের মার্চে অপ্রত্যাশিতভাবেই দোষ স্বীকার করে জবানবন্দি দেন ব্রেন্টন । দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশ নিউজিল্যান্ডে মৃত্যুদণ্ডের বিধান না থাকায় তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
শুক্রবার স্থানীয় সময় বেলা দেড়টার দিকে ক্রাইস্টচার্চের আল নূর মসজিদে জুমার নামাজ আদায়রত মুসলমানদের ওপর প্রথম হামলা চালান সন্ত্রাসী ব্রেন্টন। একজন প্রত্যক্ষদর্শী রমজান ছিলেন আল নূর মসজিদে। তিনি বলেছেন, ‘পুরো মসজিদে ছিল পিনপতন নিস্তব্ধতা। হঠাত্ করেই শুরু হলো গুলির শব্দ। চোখের সামনে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ল জ্যান্ত মানুষগুলো।’ এ হামলার আগেই সে টুইটারে ৭৩ পাতার ইশতেহার আপলোড করে হামলার ঘোষণা দেন। হামলার মাধ্যমে তিনি অনুপ্রবেশকারীদের (অভিবাসীদের) দেখাতে চান যে, ‘আমাদের ভূমি কখনো তাদের ভূমি হবে না, যতক্ষণ শেতাঙ্গরা জীবিত থাকবে।’
নিউজিল্যান্ড হামলার ঘটনায় কোনো খ্রিষ্ট সন্ত্রাসী গ্রুপ জড়িত কি না, তা জানা যায়নি। ১৫০৬ খ্রিষ্টাব্দে ৫ নভেম্বর ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ভবন গান পাউডার বিস্ফোরণের সাহায্যে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্র যে কোনো ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদের ইতিহাসে অন্যতম আদি উদাহরণ। ১৯৮৮ সালে ডানপন্থি ক্যাথলিক সন্ত্রাসবাদী দল প্যারিসের একটি সিনেমা হলে আক্রমণ চালিয়েছিল ‘দ্য লাস্ট টেম্পটেশন অব ক্রাইস্ট’ চলচ্চিত্র প্রদর্শনে বাধা দিতে। তবে খ্রিষ্টান জঙ্গি সংগঠনের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে ইসলামি জঙ্গি সংগঠন।
বিশ্বের ভয়ংকর জঙ্গি সংগঠনগুলোর তালিকার শীর্ষে রয়েছে নাইজেরিয়ার বোকোহারাম। ২০১৫ সালে আবুবকর শেকাউয়ের নেতৃত্বে এ জঙ্গি গোষ্ঠীটি ৬ হাজার ৬৪৪ জন মানুষকে হত্যা করেছে। যদিও বোকোহারাম বেশি মানুষকে হত্যা করেছে, কিন্তু আতঙ্ক সৃষ্টির দিক থেকে সবচেয়ে ওপরে আছে আইএস। ২০১৫ সালে তাদের হাতে প্রাণ হারিয়েছে ৬ হাজার ৭৩ জন মানুষ এবং আহত হয় ৫ হাজার ৭৯৯ জন। ১ হাজার ৭১টি হামলা চালিয়েছে তারা বিশ্ব জুড়ে। বোকোহারামকে যদি আইএসের সঙ্গে তুলনা করা হয়, তবে আলশাবাবকে তুলনা করা যায় আল-কায়েদার সঙ্গে। পূর্ব আফ্রিকায় এদের আধিপত্য অনেক বেশি।
লস্কর-ই-তাইবা পাকিস্তানের কট্টরপন্থি ইসলামিক সংগঠন। এই জঙ্গি সংগঠন আজও উপমহাদেশে নিজেদের দাপট ও আতঙ্ক টিকিয়ে রেখেছে। বিশ্বের কুখ্যাত জঙ্গি সংগঠনের তালিকায় জ্বলজ্বল করে আল-কায়েদার নাম। ইসলামের প্রতি পশ্চিমি দুনিয়ার দৃষ্টিভঙ্গিই পালটে দিয়েছে এই কট্টরপন্থি মুসলিম সন্ত্রাসবাদী সংগঠন। তাদের লক্ষ্য ভিন্ন মতাবলম্বীদের বিরুদ্ধে বিশ্বজোড়া ‘জিহাদ’। পাশাপাশি ধর্মনিরপেক্ষতার বিরুদ্ধে একটি ঐক্যবদ্ধ ফ্রন্টগঠন। তালিবান :রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে প্রথম গঠিত এই জঙ্গি সংগঠনটি আফগানিস্তানে ১৯৯৬ থেকে ২০০১ পর্যন্ত শাসন চালায়।
২০০১ সালের ডিসেম্বরে আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে আক্রমণের পর ক্ষমতাচ্যুত না হওয়া পর্যন্ত দেশের বেশির ভাগ অংশ তালিবানের নিয়ন্ত্রণে ছিল। আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি ২০২১ সালের ১৫ আগস্ট দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। এদিন দ্বিতীয় বারের মতো কাবুলের ক্ষমতায় বসে তালিবান।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট