১ অক্টোবর পালিত হয়েছে ৩৫তম আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস-২০২৫। এ বছরের প্রতিপাদ্য ছিল— ‘একদিন তুমি পৃথিবী গড়েছ, আজ আমি স্বপ্ন গড়ব, সযত্নে তোমায় রাখব আগলে।’ জাতিসংঘ ঘোষিত এই দিবস প্রতি বছর আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, প্রবীণরা সমাজের বোঝা নন— তারা আমাদের অভিজ্ঞতার ভান্ডার, পথপ্রদর্শক এবং একদিন তাদের হাতেই এই পৃথিবীর সভ্যতা গড়ে উঠেছিল। সময় বদলায়, মানুষ বদলায়; কিন্তু প্রবীণদের অবদান চিরকালই অনস্বীকার্য। তাদের ছাড়া কোনো সভ্যতা বা সমাজ টিকে থাকতে পারে না।
সময়ের পরিবর্তনে প্রবীণদের অবস্থান
সময় বদলে গেছে, বদলে গেছে সমাজের কাঠামো। একসময় প্রতিটি পরিবারেই এমন একজন থাকতেন, যিনি শিশুদের শাসন করতেন, তরুণদের উপদেশ দিতেন এবং পরিবারের শৃঙ্খলা বজায় রাখতেন। আজান হলে বলতেন, ‘নামাজ পড়ো’। সন্ধ্যা নামলে মনে করিয়ে দিতেন, ‘বাড়ি ফিরো’। রাতে দেরি করলে চোখ রাঙিয়ে জিগ্যেস করতেন, ‘এখনো জেগে আছ কেন?’ এমন একজন মানুষের উপস্থিতিই ছিল পারিবারিক জীবনের শৃঙ্খলার প্রতীক। কিন্তু আজ সেই শ্রদ্ধাভাজন প্রবীণরা হারিয়ে যাচ্ছেন। পরিবারগুলো ছোট হচ্ছে, ব্যস্ততা বাড়ছে, আর প্রবীণদের ভূমিকা সীমিত হয়ে যাচ্ছে।
বিশ্বব্যাপী প্রবীণদের বাস্তবতা
জাতিসংঘের তথ্যানুসারে বিশ্বে প্রবীণ জনগোষ্ঠী দ্রুত বাড়ছে। ২০৫০ সালে প্রতি ছয় জন মানুষের এক জন হবে ৬৫ বছরের ঊর্ধ্বে। উন্নত দেশে প্রবীণরা স্বাস্থ্যসেবা ও সামাজিক নিরাপত্তা পেয়েছেন, কিন্তু উন্নয়নশীল দেশে তারা প্রায়ই নিঃসঙ্গ। দক্ষিণ এশিয়ায় পরিবার ছিল প্রধান ভরসা, এখন আধুনিক জীবন ও শহরমুখিতা প্রবীণদের একাকিত্ব বাড়িয়েছে। জাপানে জনসংখ্যার প্রায় ৩০ শতাংশ ৬৫ বছরের ঊর্ধ্বে। সরকার লং-টার্ম কেয়ার ইন্স্যুরেন্স, স্বাস্থ্যসেবা এবং রোবটিক কেয়ার ব্যবহারের মাধ্যমে প্রবীণদের সেবা নিশ্চিত করছে। অনেক প্রবীণ সামাজিক ক্লাব ও কমিউনিটি কার্যক্রমে যুক্ত থেকে সমাজে অবদান রাখছেন। এটি দেখায়— সঠিক নীতি ও সম্মানের মাধ্যমে প্রবীণরা বোঝা নয়, বরং সমাজের সম্পদ।
বাংলাদেশের প্রবীণ সমাজ
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যানুসারে বর্তমানে দেশে প্রবীণ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা প্রায় দেড় কোটিরও বেশি। ২০৫০ সালের মধ্যে এই সংখ্যা দ্বিগুণ হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কিন্তু এই বিপুল জনগোষ্ঠীর জন্য পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসেবা, সামাজিক নিরাপত্তা, আর্থিক সহায়তা ও মানসিক সাপোর্ট নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। গ্রামে প্রবীণরা এখনো কিছুটা সম্মান পান, কিন্তু শহরে অনেকেই নিঃসঙ্গ জীবন যাপন করছেন। অনেক ক্ষেত্রে সন্তানরাই অভিভাবকদের বোঝা মনে করেন। এটি কেবল পারিবারিক সংকট নয়, বরং একটি সামাজিক বিপর্যয়।
প্রবীণদের হারানোর বেদনা
আজ আমরা সহজেই বুঝতে পারি, এমন মানুষ খুব কম রয়ে গেছেন, যাদের সামনে দাঁড়ালে হূদয় নত হয়ে আসে। যারা কেবল বয়োজ্যেষ্ঠ নন; অভিজ্ঞতা, সততা ও মানবিকতার জন্যও শ্রদ্ধেয় ছিলেন। জাতীয় সংকটে তাদের কণ্ঠস্বর শোনার জন্য মানুষ অপেক্ষা করত। আজ সেই সংখ্যাটা দিন দিন কমছে। অনেক মেধাবী মানুষ দেশ ছেড়ে যাচ্ছেন, মধ্যবয়স্করা বিদেশে স্থায়ী হচ্ছেন, আর প্রবীণরা অবহেলিত হচ্ছেন। এই ধারা চলতে থাকলে জাতি তার মেরুদণ্ড হারাবে। কারণ যে সমাজ গুণীর সম্মান করে না, সেখানে গুণী জন্মায় না, আর জন্মালেও টেকে না।
প্রবীণদের প্রতি করণীয়
পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র— সবারই প্রবীণদের প্রতি দায়িত্ব রয়েছে। পরিবারে প্রবীণদের মর্যাদা দিতে হবে, তাদের সিদ্ধান্ত ও মতামতকে মূল্যায়ন করতে হবে। সমাজে প্রবীণবান্ধব পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে, যেখানে তারা সক্রিয় থাকতে পারবেন। সরকারকে প্রবীণদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী আরো শক্তিশালী করতে হবে, স্বাস্থ্যসেবাকে সাশ্রয়ী ও সহজলভ্য করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়, অফিস, প্রতিষ্ঠান— সবখানেই প্রবীণদের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগানোর সুযোগ তৈরি করতে হবে।
তরুণ প্রজন্মের প্রতি আহ্বান
আজকের তরুণরা আগামী দিনের নেতৃত্ব দেবে। কিন্তু তাদের ভুলে গেলে চলবে না— একদিন এই প্রবীণরাই তাদের জন্য পৃথিবী গড়েছেন। তাদের অভিজ্ঞতা ও পরিশ্রমের ফসলেই আজ আমরা আধুনিক সমাজে বাস করছি। তাই প্রবীণদের অবহেলা নয়, সম্মান দিতে হবে; নিঃসঙ্গতা নয়, পাশে থাকতে হবে; অবজ্ঞা নয়, স্নেহ দিতে হবে। প্রতিটি তরুণের উচিত প্রবীণদের জীবনে আনন্দের আলো ছড়িয়ে দেওয়া। তবেই প্রজন্মের মধ্যে সেতুবন্ধ শক্তিশালী হবে।
আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস কেবল আনুষ্ঠানিকতা নয়, এটি আমাদের জন্য আত্মসমালোচনার দিন। আমরা কি আমাদের প্রবীণদের যথাযথ সম্মান দিচ্ছি? আমরা কি তাদের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাচ্ছি? আজ সময় এসেছে, প্রবীণদের মর্যাদার ভিত্তিতে নতুন সমাজ গড়ার। যেখানে প্রবীণরা গর্ব করে বলবেন— তাদের অবদানকে শ্রদ্ধা করা হয়েছে, ভালোবাসা দেওয়া হয়েছে। আর তরুণরা বলবে— আমরা তাদের স্বপ্ন আগলে রেখে নতুন ভবিষ্যৎ গড়েছি। এই হোক অঙ্গীকার।
লেখক : চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও অ্যানিমেল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক।