শ্রমেই সাজছে পৃথিবী। মানুষ ভিনগ্রহে বসবাসের স্বপ্নে বিভোর। সভ্যতার রূপায়ণ ঘটছে প্রতিক্ষণে। ভাঙা-গড়ার মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে মানব ইতিহাস। আর এই সৃষ্টির ইতিহাস গড়ার কারিগর হচ্ছেন শ্রমিকেরা। যে অধিকার প্রতিষ্ঠায় প্রায় ১৫০ বছর আগে শ্রমিকেরা বুকেরা তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছিলেন, তা আজও অধরা। আজও শ্রমিকের অধিকার নিয়ে আন্দোলন হয়, আলোচনা হয়, দিবস পালিত হয়। কিন্তু শ্রমিকের সে অধিকার যেন ‘দিবস’ পালনের মধ্যেই আটকে থাকে। সরকারি প্রতিষ্ঠানে শ্রমের সময়সূচি নিয়ে এখনো কোনো নিয়ম মানা হয় না। আজও শ্রমিক নির্যাতন হয়। মালিক-রাষ্ট্র মিলে আজও শ্রমিকের অধিকার হরণ করে।
হাজার বছরের বঞ্চনা আর শোষণ থেকে মুক্তি পেতে ১৮৮৬ সালের এদিন বুকের রক্ত ঝরিয়েছিলেন শ্রমিকেরা। শ্রমঘণ্টা কমিয়ে আনার দাবিতে এদিন শ্রমিকরা যুক্তরাষ্ট্রের সব শিল্পাঞ্চলে ধর্মঘটের ডাক দিয়েছিলেন। সে ডাকে শিকাগো শহরের তিন লক্ষাধিক শ্রমিক কাজ বন্ধ রাখেন। শ্রমিক সমাবেশ ঘিরে শিকাগো শহরের হে মার্কেট রূপ নেয় লাখো শ্রমিকের বিক্ষোভসমুদ্রে। ১ লাখ ৮৫ হাজার নির্মাণশ্রমিকের সঙ্গে আরো অসংখ্য বিক্ষুব্ধ শ্রমিক লাল ঝান্ডা হাতে সমবেত হন সেখানে। বিক্ষোভ চলাকালে একপর্যায়ে পুলিশ শ্রমিকদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালালে ১০ জন শ্রমিক প্রাণ হারান।
এদিকে হে মার্কেটের ঐ শ্রমিক অসন্তোষের আগুন জ্বলে ওঠে গোটা দুনিয়ায়। গড়ে ওঠে শ্রমিক-জনতার বৃহত্তর ঐক্য। অবশেষে তীব্র আন্দোলনের মুখে শ্রমিকদের দৈনিক আট ঘণ্টা কাজের দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয় তত্কালীন যুক্তরাষ্ট্র সরকার। পরে ১৮৮৯ সালের ১৪ জুলাই প্যারিসে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক শ্রমিক সম্মেলনে শিকাগোর রক্তঝরা অর্জনকে স্বীকৃতি দিয়ে ঐ ঘটনার স্মারক হিসেবে ১ মে ‘আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংহতি দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ১৮৯০ সাল থেকে প্রতি বছর দিবসটি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ‘মে দিবস’ হিসেবে পালন করতে শুরু করে।
রক্ত দিয়ে কেনা শ্রমিকের অধিকার প্রতিষ্ঠার এ দিনটিকে বাংলাদেশেও পালন করা হয়। ব্রিটিশ আমল তথা ১৯৩৮ সালে নারায়ণগঞ্জে প্রথম মে দিবস পালিত হয়। তারপর পাকিস্তান আমলেও মে দিবস যথাযথ উত্সাহ-উদ্দীপনা নিয়ে পালিত হয়েছে। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের শাসন থেকে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে বাংলাদেশে বিপুল উদ্দীপনা নিয়ে মে দিবস পালিত হয়। ঐ বছর সদ্য স্বাধীন দেশে ১ মে সরকারি ছুটি ঘোষিত হয়।
সামাজিক সুরক্ষা বিষয়ে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) মানদণ্ড নির্ধারণ করে। ১৯৪৪ সাল থেকে আইএলও এক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছে। ১৯৪৪ সালে ডিক্লারেশন অব ফিলাডেলফিয়া অভিযোজন করা হয়। এটা শ্রমিককে পণ্য নয়, মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এরপর থেকে শ্রমিকের সামাজিক সুরক্ষা তার অধিকার হিসেবে বিবেচিত হয়। এই ডিক্লারেশনের সাত বছরের মধ্যে আইএলও সামাজিক সুরক্ষার ক্ষেত্রে কনভেনশন ১০২ ও ২০২ গ্রহণ করে। এর ভিত্তিতে সামাজিক সুরক্ষার নয়টি দিক চিহ্নিত হয়, যা জীবনব্যাপী সুরক্ষা নিশ্চিত করে। এসব সুরক্ষার মধ্যে রয়েছে প্রসূতিকালীন সুরক্ষা, শিশুসুরক্ষা, বেকারকালীন সুরক্ষা, কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনাজনিত সুরক্ষা, অসুস্থতাজনিত সুরক্ষা, প্রতিবন্ধী সুরক্ষা, সারভাইভার, বৃদ্ধকালীন সুরক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা।
গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) এবং ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি প্রকল্প ম্যাপড ইন বাংলাদেশ (এমআইবি)-এর সমীক্ষায় দেখা গেছে, ২০১৯ সালের ডিসেম্বরের তুলনায় ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর ৫০ শতাংশ বেশি কারখানায় শ্রমিক কমেছে, প্রায় ৫৬ শতাংশ কারখানা বিভিন্ন স্তরে অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে এবং ১১ শতাংশ কারখানা অনিশ্চয়তার মধ্যে আছে। জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে প্রায় ২৫ লাখ ৬২ হাজার ৩৮৩ জন কর্মীর মধ্যে প্রায় ৩ লাখ ৫৭ হাজার ৪৫০ জন চাকরি হারিয়েছেন, যা মোট শ্রমিকের প্রায় ১৪ শতাংশ।
বাংলাদেশের শ্রমিকদের ওপর চলমান নির্যাতনের একটি বড় ও হূদয়বিদারক উদাহরণ রানা প্লাজার মর্মান্তিক ঘটনা। ঐ ভবনে উপস্থিত ১ হাজার ১৩৫ জন মারা যান। পঙ্গুত্ব বা মানসিক ট্রমা নিয়ে বেঁচে আছেন আরো প্রায় ১ হাজার মানুষ। ঐ ঘটনার পর পোশাককারখানার কর্মপরিবেশ উন্নয়নে নিয়োজিত বিদেশি ক্রেতাদের জোট অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্সের তত্ত্বাবধানে এখন অধিকাংশ গার্মেন্টসের কর্মপরিবেশ আগের চেয়ে অনেকটাই উন্নত। তবে তা-ও প্রয়োজনের তুলনায় কম।
কেবল গার্মেন্টস নয়, বাংলাদেশে আরো অনেক পেশাতেই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে হয় শ্রমিকদের। নির্মাণশিল্প, যানবাহন, জাহাজ ভাঙা শিল্প, ট্যানারিসহ অনেক পেশায় কোনো পরিবর্তনই আসেনি। ফলে সেসব জায়গায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছেন শ্রমিকরা। শ্রমিকদের জীবনের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি বলা হয় পরিবহনে। এর পরই নির্মাণশিল্প। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের তথ্য অনুযায়ী, ২০০২ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ১৫ বছরে নিহত হয়েছেন ১ হাজার ৬৭৭ নির্মাণশ্রমিক; অর্থাত্ বছরে ১০০ জনেরও বেশি। প্রতিষ্ঠানটির তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে ঝুঁকিপূর্ণ এই পেশায় কাজ করছেন প্রায় ৩৭ লাখ শ্রমিক।
শ্রমিকদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ আরেকটি পেশা হলো চামড়াশিল্প। সারা দেশে চামড়া নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠান আছে প্রায় ১ হাজার। ঝুঁকিপূর্ণ আরেকটি পেশা জাহাজ ভাঙা। পুরোনো জাহাজে থাকে নানা বিষাক্ত পদার্থ, যা কর্মীদের ফুসফুসে ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ায়। এখানে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটে, প্রাণ হারান বহু শ্রমিক। কিন্তু শ্রমিকরা প্রাপ্য ক্ষতিপূরণ পাচ্ছেন না।
বাংলাদেশের বেশি পোশাকশিল্প রয়েছে ঢাকা, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ ও চট্টগ্রামে। এসব জেলায় ৩ হাজার ২০০-এর বেশি কারখানায় কাজ করছেন ২৫ লাখের বেশি শ্রমিক। এর মধ্যে পুরুষ কর্মী রয়েছেন সাড়ে ১০ লাখ, নারী ১৫ লাখ। অথচ অনেক সময় তাদের বেতন-ভাতার দাবিতে রাস্তায় নামার দৃশ্য আমাদের দেখতে হয়!
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণাপ্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) ও সুইডেনের ওয়েজ ইন্ডিকেটর ফাউন্ডেশন (ডব্লিউআইএফ)-এর এক জরিপে দেখা গেছে—নারী শ্রমিকরা পুরুষের তুলনায় গড়ে ৭৭ ভাগ কম মজুরি পান। বাংলাদেশে স্বাধীনতার পর থেকেই মে দিবস সরকারি ছুটির দিন হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। মে দিবসের প্রধান দাবি আট ঘণ্টা কর্মদিবস ২২ লাখ সরকারি কর্মকর্তা, কর্মচারীদের ক্ষেত্রে বাস্তবায়িত হলেও কোটি কোটি বেসরকারি শ্রমিক-কর্মচারীরা এখনো আট ঘণ্টা কর্মদিবসের সুফল পান না। বরং শ্রম আইনে কৌশলে ১০ ঘণ্টা কাজের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
প্রতি বছর শ্রমবাজারে কাজপ্রত্যাশী ২০/২২ লাখ তরুণ-যুবক আসেন, যাদের মাত্র ২ লাখের মতো কর্মসংস্থান রাষ্ট্র করতে পারে। এরপর, ৭ থেকে ১০ লাখ মানুষ পাড়ি জমায় বিদেশে কাজ করতে; আর বাকিরা দেশে কোনোমতে কাজ খুঁজে নেওয়ার চেষ্টা করে। দেশের ৬ কোটি ৩৪ লাখ শ্রমজীবীর মধ্যে প্রায় ৩ কোটি কাজ করে কৃষি খাতে। যেখানে বছরে তিন মাসের বেশি কাজ থাকে না, ফলে বহু ধরনের অপ্রাতিষ্ঠানিক কাজের মাধ্যমে তারা টিকে থাকার চেষ্টা করে। মজুরি বোর্ডের মাধ্যমে ৪৩টি সেক্টরের শ্রমজীবীদের নিম্নতম মজুরি নির্ধারণের ব্যবস্থা থাকলেও বাকি কোটি কোটি শ্রমিকের ‘কাজ নেই তো মজুরি নেই’ নীতিতে কাজ করানো হয়ে থাকে। শ্রমিকদের সংগঠিত হওয়ার পথে আইনি ও আইনবহির্ভূত অসংখ্য বাধা। সে কারণে ২ লাখের মতো ছোট-বড় প্রতিষ্ঠান থাকলেও ট্রেড ইউনিয়নের সংখ্যা ৮ হাজারের কম। দেশের প্রধান রপ্তানি খাত গার্মেন্টসে ৫ হাজারের বেশি কারখানা থাকলেও ট্রেড ইউনিয়ন আছে, এমন কারখানা কাগজে কলমে ৬৬১টি। বাস্তবে সক্রিয় ট্রেড ইউনিয়নের সংখ্যা আরো কম। দেশের আটটি ইপিজেডে ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার নেই।
মুনাফা ও মজুরির যে বিরোধ, সেই বিরোধে শ্রমিক সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও দুর্বল। ফলে সারা দুনিয়াতে খাদ্যপণ্য ও ব্যাবহারিক পণ্য উত্পাদন সব রেকর্ড ভেঙে ফেললেও তা সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে থেকে যাচ্ছে। আয়ের বড় অংশ খাদ্য, বাড়িভাড়া, পোশাক, চিকিত্সায় ব্যয় হয়ে যাওয়ার ফলে সঞ্চয় যেমন থাকছে না, তেমনি দক্ষতা অর্জনের জন্য বাড়তি খরচ করাও শ্রমিকের জন্য সম্ভব হয়ে উঠছে না। তাহলে ডিজিটাল দক্ষতা শ্রমিকরা অর্জন করবে কীভাবে? চতুর্থ শিল্পবিপ্লব কি তাহলে বেকারত্বের ভয়াবহতা নিয়ে আবির্ভূত হবে? উত্পাদন, বণ্টন ও ভোগের ক্ষেত্রে ভারসাম্য আনা এবং আগ্রাসী পুঁজিবাদের হাত থেকে সমাজকে রক্ষা করতে হলে আট ঘণ্টা কর্মদিবস ও ন্যায্য মজুরির কোনো বিকল্প নেই। ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে অগাস্ট স্পাইস যে উক্তি করেছিলেন, The time will come when our silence will be more powerful than the voices you strangled today. বৈষম্যের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী আন্দোলনের পটভূমিতে মে দিবস বারবার সে কথাই মনে করিয়ে দিচ্ছে।
লেখক : ফিকামলি তত্ত্বের জনক, শিক্ষাবিদ