বাংলাদেশে শিশুশ্রম আজও একটি করুণ বাস্তবতা। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (ILO) হিসেবে, বিশ্ব জুড়ে প্রায় ১৬ কোটি শিশু শ্রমে নিযুক্ত, যার মধ্যে বাংলাদেশে রয়েছে প্রায় ৩৫ লাখ শিশু (ILO, ২০২১)। এদের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ কাজের সঙ্গে জড়িত আছে প্রায় ১০ লাখ শিশু। এদের একটি বড় অংশ কাজ করছে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে—কারখানা, গ্যারেজ, চায়ের দোকান, হোটেল, বাসাবাড়ি, এমনকি ইটভাটায়। শিশুদের এই শোষণ আমাদের রাষ্ট্রীয় দায়বদ্ধতা ও মানবিক মূল্যবোধকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।
শিশুশ্রম শুধুমাত্র একটি অর্থনৈতিক সমস্যা নয়, এটি এক ভয়াবহ মানবিক সংকট। আমাদের উন্নয়ন, শিক্ষা ও ন্যায়ের প্রতিটি অগ্রযাত্রায় এটি এক মূর্ত প্রতিবন্ধকতা। আইনের চোখে এটি অপরাধ হলেও বাস্তবে যেন অভ্যস্ত চিত্রে পরিণত হয়েছে। রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপ, সামাজিক সচেতনতা ও রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবে এই সমস্যার সমাধান আজও অধরা।

বাংলাদেশে শিশুশ্রম নিরোধে রয়েছে বেশ কয়েকটি আইন। বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬ (সংশোধিত ২০১৩) অনুযায়ী, ১৪ বছরের কম বয়সি শিশুকে কোনো ধরনের কাজে নিয়োগ দেওয়া বেআইনি। গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতিমালা, ২০১৫: এই নীতিমালায় ১৪ বছরের কম বয়সি শিশুদের গৃহকর্মে নিয়োগ করা যাবে না বলা হয়েছে।
জাতীয় শিশুশ্রম নিরসন নীতিমালা-২০১০ এবং জাতীয় কর্মপরিকল্পনা ২০২১-২০২৫-এ ঝুঁকিপূর্ণ শ্রম বন্ধের কথা বলা হয়েছে। UN Convention on the Rights of the Child (CRC)-এর স্বাক্ষরকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ শিশুর শিক্ষা, সুরক্ষা ও বিকাশের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তবে বাস্তবতা বলছে ভিন্ন কথা। আইন থাকলেও তার প্রয়োগ ঢিলেঢালা। অনেক সময় দুর্বল নজরদারি, রাজনৈতিক প্রভাব বা স্থানীয় প্রশাসনের উদাসীনতায় শিশুশ্রম বন্ধের পদক্ষেপ কার্যকর হয় না।
শিশুশ্রমের পেছনে রয়েছে নানা কারণ। যেমন :দারিদ্র্য, পরিবারিক দারিদ্র্য শিশুদের কাজে পাঠাতে বাধ্য করে। সংসারের হাল ধরতে শিশুদের পাঠানো হয় নানা কাজে। বাস্তবতার নিষ্ঠুর গ্রাসে ভেঙে যায় হাজারো স্বপ্ন। শিক্ষার অনুপলব্ধতা ও ব্যয় : সরকারি স্কুল থাকলেও অনেক জায়গায় মানসম্পন্ন শিক্ষা নেই। বই, ইউনিফর্ম, যাতায়াত খরচও অনেকের পক্ষে বহন করা সম্ভব হয় না। সচেতনতার অভাব :অনেক পরিবার জানেই না শিশুশ্রম একটি অপরাধ। যথাযথ প্রচার-প্রচারণার অভাবে শিশুশ্রম বেড়েই চলেছে দিনের পর দিন। নিয়োগদাতার লাভের চিন্তা :শিশুদের সহজে নিয়ন্ত্রণ করা যায়, কম পারিশ্রমিকে দীর্ঘ সময় কাজ করানো যায়। এজন্য অনেক মালিক শিশুদেরকেই পছন্দ করেন।
অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে শিশুশ্রম সবচেয়ে বেশি। যেমন :চায়ের দোকান ও হোটেল, বাসাবাড়ির গৃহকর্মী, ইটভাটা ও কৃষিখাত।
রাষ্ট্রের দায় অনস্বীকার্য। পর্যাপ্ত মনিটরিং ব্যবস্থা নেই, শ্রম মন্ত্রণালয়ের অধীন শিশু নিরীক্ষা বা পরিদর্শন কার্যক্রম অত্যন্ত সীমিত। লোকবলের ঘাটতি, শ্রম পরিদর্শক কম এবং তাদের অনেকেই গ্রামাঞ্চলে পৌঁছাতে পারেন না।
সমাধানের পথ অবশ্যই শিক্ষা। স্কুলে শিশুদের ধরে রাখা গেলে শিশুশ্রম অনেকাংশে কমবে। পাশাপাশি সরকারি নজরদারি ও আইন প্রয়োগ বাড়াতে হবে।
আসুন, শিশুশ্রম বন্ধে শুধু আইন নয়—আমরা যেন বিবেক, ভালোবাসা ও দায়িত্ববোধ দিয়ে প্রতিটি শিশুকে ফিরিয়ে দেই তার হারানো শৈশব। যেন তারা কাজের নয়, কল্পনার রাজ্যে ডুবে থাকতে পারে। বই, খেলা আর ভালোবাসার মধ্য দিয়ে গড়ে উঠুক তাদের আগামী।
লেখক : শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।
(এই লেখা লেখকের একান্ত ব্যক্তিগত অভিমত; এ সংক্রান্ত কোনো দায় দৈনিক মূলধারা বহন করবে না)