আজ বিশ্ব খাদ্য দিবস। ১৯৮১ সাল থেকে প্রতি বছর ১৬ অক্টোবর দারিদ্র্য ও ক্ষুধা নিবৃত্তির লক্ষ্যে এ দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। এ বছর খাদ্য দিবসের প্রতিপাদ্য হচ্ছে ‘Hand in Hand for Better Foods and a Better Future’, উক্ত প্রতিপাদ্যটি খুবই যথার্থ। প্রকৃতপক্ষে সবার সম্মিলিত প্রয়াসের মাধ্যমেই নিরাপদ খাদ্য উত্পাদন ও সরবরাহ সম্ভব; যা সুস্থ, সবল জাতি গঠনের অন্যতম নিয়ামক। কিন্তু সেই খাদ্যটি হতে হবে নিরাপদ, যা বিভিন্ন প্রকার রাসায়নিক বালাইনাশক, যেমন : কীটনাশক, ছত্রাকনাশক ইত্যাদি এবং অন্যান্য দূষক, যেমন—ভারী ধাতু, মাইকোটক্সিন ইত্যাদি থেকে মুক্ত হবে অথবা এসব দূষকের উপস্থিতি ক্ষতিকর পর্যায়ের নিচে থাকবে। অন্যদিকে যদি খাদ্যদ্রব্যে এসব দূষকের উপস্থিতি ক্ষতিকর পর্যায়ের ওপরে থাকে, তাহলে সেটি হয়ে যায় দূষিত খাদ্য। আর এ দূষিত খাদ্যই তৈরি করছে মানবদেহে ক্যানসারসহ বিভিন্ন প্রকার রোগব্যাধি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, প্রতিদিন একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের অন্তত ৪০০ গ্রাম ফল-মূল ও শাকসবজি ভক্ষণ করা উচিত। কিন্তু উত্পাদনকারীরা এসব ফল-মূল ও শাকসবজি উত্পাদন করতে যেয়ে সবচেয়ে বড় যে সমস্যার সম্মুখীন হন, সেটি হলো রোগবালাই ও পোকামাকড়ের আক্রমণ। কাজেই কৃষকেরা রোগবালাই ও পোকামাকড় দমনের জন্য প্রতিনিয়তই বিভিন্ন প্রকার রাসায়নিক বালাইনাশক ব্যবহার করে থাকেন। এসব বালাইনাশকের ব্যবহার শুধু ফসলের উত্পাদনখরচই বৃদ্ধি করে না, বরং ফল-মূল ও শাকসবজিতে বালাইনাশকের অবশিষ্টাংশের উপস্থিতি পরিবেশ ও জনস্বাস্থের জন্য বিরাট হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
কীটতত্ত্ব বিভাগ, বাংলাদশে কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের বালাইনাশক বিশ্লেষণ গবেষণাগারের বিগত ১৮ বছরের ফলাফল থেকে প্রতিয়মান হয় যে, বাজার থেকে সংগৃহীত বিভিন্ন ধরনের সবজির নমুনার মধ্যে শতকরা ১০-১২ ভাগ নমুনাতে প্রাপ্ত বালাইনাশকের অবশিষ্টাংশের পরিমাণ সর্বোচ্চ সহনীয় মাত্রার ওপরে এবং বিশ্লেষণকৃত বিভিন্ন ধরনের ফলের নমুনার মধ্যে শতকরা তিন থেকে চার ভাগ নমুনাতে প্রাপ্ত বালাইনাশকের অবশিষ্টাংশের পরিমাণ সর্বোচ্চ সহনীয় মাত্রার ওপরে। সালাদ জাতীয় ফসল, যেমন : ক্যাপসিকাম, লেটুসপাতা, ধনিয়া পাতা, গাজর ইত্যাদির ক্ষেত্রে শতকরা ১০-১৫ ভাগ নমুনাতে এবং পান ফসলের ক্ষেত্রে শতকরা ১০ ভাগ নমুনাতে প্রাপ্ত বালাইনাশকের অবশিষ্টাংশের পরিমাণ সর্বোচ্চ সহনীয় মাত্রার ওপরে। ফসল উত্পাদনকারী তার ফসলকে পোকামাকড় ও রোগবালাইয়ের আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে উত্পাদন বৃদ্ধির জন্য অনুমোদিত রাসায়নিক বালাইনাশক ব্যবহার করবে, এটাই স্বাভাবিক।
তবে এই বিষাক্ত রাসায়নিক বালাইনাশক ব্যবহারের ক্ষেত্রে যেসব নিয়ম-কানুন রয়েছে, সেগুলো অবশ্যই তাকে মেনে চলতে হবে। বিশ্বের অনেক দেশের চেয়ে আমাদের দেশে রাসায়নিক বালাইনাশকের ব্যবহার দিন দিন কমে আসছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার তথ্যমতে, হংকং, তাইওয়ান, চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান ইত্যাদি দেশ বাংলাদেশের তুলনায় যথাক্রমে ৯.৪, ৭.৫, ৭.৪, ৭.০ এবং ৬.৭ গুণ বেশি রাসায়নিক বালাইনাশক ব্যবহার করে থাকে। রাসায়নিক বালাইনাশকের ব্যবহার কম হলেও আমাদের দেশের কৃষকেরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে উত্তম কৃষিচর্চা অনুসরণ করেন না; যেমন :ফসলের রোগবালাই ও পোকামাকড় দমনের জন্য মাত্রাতিরিক্ত বালাইনাশক ব্যবহার করে থাকেন। এছাড়া একই ফসলে বার বার বালাইনাশক ব্যবহার করে থাকেন। সবচেয়ে প্রধান যে সমস্যাটি আমাদের দেশের কৃষকগণ করে থাকেন, সেটি হলো বালাইনাশক প্রয়োগের পর অপেক্ষমাণ সময় (Pre-harvest interval, PHI) পর্যন্ত অপেক্ষা না করেই ফসল সংগ্রহ ও বাজারজাত করেন। ফলে প্রতিদিনই আমরা ভক্ষণ করছি বিষাক্ত খাবার।
এখন আসুন, জেনে নেওয়া যাক বালাইনাশকের ফসল সংগ্রহ পূর্ব অপেক্ষমাণ সময় (PHI) বলতে কী বোঝায়, এবং কী করণীয় :
ফসল সংগ্রহপূর্ব অপেক্ষমাণ সময় (PHI) বলতে বোঝায় কোন ফসলে সর্বশেষ রাসায়নিক বালাইনাশক প্রয়োগের পর থেকে ফসল সংগ্রহের পূর্বে ন্যূনতম কত দিন অপেক্ষা করলে বালাইনাশকের অবশিষ্টাংশের পরিমাণ সর্বোচ্চ সহনীয় মাত্রার (Maximum Residue Limit, MRL) নিচে চলে যাবে। এই অপেক্ষমাণ সময় ফসলভেদে ও বালাইনাশকের প্রকারভেদে বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে; যেমন :সিনথেটিক পাইরিথ্রয়েড কীটনাশকের ক্ষেত্রে চার থেকে ছয় দিন, অর্গানোফসফরাস কীটনাশকের ক্ষেত্রে ৭-২০ দিন, নিওনিকোটিনয়িড কীটনাশকের ক্ষেত্রে ৮-২২ দিন এবং কার্বামেট কীটনাশকের ক্ষেত্রে ২০-৪০ দিন অপেক্ষা করতে হয়। এই অপেক্ষমাণ সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করে যদি ফলমূল ও শাকসবজি সংগ্রহ করা হয়, তবে ফলমূল ও শাকসবজিতে ব্যবহূত বালাইনাশকসমূহের অবশিষ্টাংশের মাত্রা ক্ষতিকর পর্যায় বা সর্বোচ্চ সহনীয় মাত্রার নিচে চলে যাবে। উল্লিখিত নিয়ম-কানুনসমূহ মেনে উত্পাদনকারীগণ সহজেই বিষাক্ত বালাইনাশক ব্যবহার করেও নিরাপদ খাদ্য উত্পাদন করতে পারেন।
আমাদের দেশের কৃষকগণ সাধারণত রাসায়নিক বালাইনাশক প্রয়োগের এক থেকে দুই দিন পরই ফসল সংগ্রহ করে থাকেন, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত হুমকিস্বরূপ। কাজেই অপেক্ষাকৃত কম বিষাক্ত বালাইনাশক ব্যবহারের পাশাপাশি ফসল সংগ্রহের আগে বালাইনাশকের প্রকারভেদ ও ফসলের ধরনের ওপর ভিত্তি করে একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করা অত্যাবশ্যকীয়। বর্তমানে বিশ্বের অনেক দেশেই যেসব বালাইনাশকের বিষাক্ততার মাত্রা অনেক বেশি, সেসব বালাইনাশকের ব্যবহার দিন দিন কমিয়ে আনা হচ্ছে। এমনকি সেসব বালাইনাশকের ব্যবহার বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। আমাদের দেশে এখনো এমন অনেক বালাইনাশক ব্যবহূত হচ্ছে, যেগুলো উন্নত বিশ্বে আর ব্যবহূত হচ্ছে না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বালাইনাশকের Hazard-এর ওপর ভিত্তি করে যে শ্রেণিবিভাগ করেছে (সারনি-১), সেখানে নতুন একটি শ্রেণি রয়েছে; যেটির নাম হলো Unlikely to present acute hazard। এই শ্রেণির বালাইনাশকসমূহের ক্ষেত্রে acute hazard-এর সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। কাজেই কৃষিবিজ্ঞানীগণ তাদের গবেষণাকর্মে এই গ্রুপের বালাইনাশকসমূহের ওপর গবেষণা জোরদার করার মাধ্যমে ফসলের বিভিন্ন প্রকার পোকামাকড় ও রোগবালাই দমনের জন্য কার্যকরী বালাইনাশকসমূহ এ গ্রুপ থেকে নির্বাচন করতে পারলে উপকৃত হবেন ভোক্তাগণ। কারণ এ গ্রুপের বালাইনাশকসমূহের বিষাক্ততা একবারেই কম। ইতিমধ্যেই কীটতত্ত্ব বিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, গাজীপুরের বিজ্ঞানীগণ উক্ত গ্রুপের বালাইনাশকসমূহ অন্তর্ভুক্ত করে নানা গবেষণা কর্মসূচি হাতে নিয়েছে।
বালাইনাশকের ফসল সংগ্রহপূর্ব অপেক্ষমাণ সময় বিভিন্ন উপাদান; যেমন :বালাইনাশকের ভৌতরাসায়নিক বৈশিষ্ট্য, বালাইনাশকের প্রকারভেদ, বালাইনাশকের প্রয়োগের পদ্ধতি, সংশিষ্ট ফসলের বৈশিষ্ট্য, বিভিন্ন ধরনের পরিবেশগত উপাদান; যেমন—তাপমাত্রা, আর্দ্রতা, বৃষ্টিপাত, বায়ুপ্রবাহ ইত্যাদি দ্বারা প্রভাবিত হয়। কাজেই প্রতিটি দেশের পরিবেশগত অবস্থার ওপর ভিত্তি করে বালাইনাশকসমূহের ফসল সংগ্রহপূর্ব অপেক্ষমাণ সময় নির্ধারণ করা দরকার। এ লক্ষ্যেই ২০০৯ সাল থেকে কীটতত্ত্ব বিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউটের বালাইনাশক বিশ্লেষণ গবেষণাগারে বিভিন্ন ধরনের বালাইনাশকের ফসল সংগ্রহপূর্ব অপেক্ষমাণ সময় নির্ধারণের জন্য কাজ করে আসছে।
আমাদের দেশে PHI-এর বাস্তব প্রয়োগ একটি বড় চ্যালেঞ্জ। PHI-এর যথাযথ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে প্রধান প্রতিবন্ধকসমূহ হলো :অপ্রশিক্ষিত উত্পাদনকারী, জনসচেতনতা এবং আইনের যথাযথ প্রয়োগের অভাব। উল্লিখিত প্রতিবন্ধকতাসমূহ দূর করার জন্য কৃষকগণকে প্রশিক্ষিত করতে হবে, যেন তারা কম বিষাক্ত বালাইনাশক ব্যবহার করেন এবং বালাইনাশক ব্যবহারের পর ফসল সংগ্রহপূর্ব অপেক্ষমাণ সময় অনুসরণ করেন। জনসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য গণমাধ্যমে এ সংক্রান্ত বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা যেতে পারে। জনগণ সচেতন হলে এর যথাযথ বাস্তবায়নের মাধ্যমে নিরাপদ ফলমূল ও শাকসবজি উত্পাদন করা সম্ভব। আইনের যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে কৃষকগণকে ফসল সংগ্রহপূর্ব অপেক্ষমাণ সময় অনুসরণে অভ্যস্ত করা যেতে পারে। পরিশেষে বলা যায়, আমাদের সবার সম্মিলিত প্রয়াসই হলো নিরাপদ খাদ্য উত্পাদনের অন্যতম হাতিয়ার।
লেখক : প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা কীটতত্ত্ব বিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, গাজীপুর।
(এই লেখা লেখকের একান্ত ব্যক্তিগত অভিমত; এ সংক্রান্ত কোনো দায় দৈনিক মূলধারা বহন করবে না)