শহরাঞ্চল বলতে আমরা বুঝি বড় বড় দালানকোঠা ও উন্নত নাগরিক সেবা গ্রহণের জায়গা। দ্রুত মানব বসতি গড়ে উঠায় কমে যাচ্ছে পাখির সংখ্যা। শহরাঞ্চলে প্রতিনিয়ত গাছপালা,পাহাড়-পর্বত, মাঠ ঘাট, নদী নালা ভরাট করে বড় বড় রাস্তা , উঁচু উঁচু দালান-কোটা, মিল-ফ্যাক্টরি তৈরি করা হচ্ছে। ফলস্বরূপ দিন দিন কমে যাচ্ছে পাখির সংখ্যা। সকাল বেলায় পাখির কুঞ্জন, মিষ্টি সুরের গান, কিচিরমিচির, পড়ন্ত বিকেলে আকাশে মেঘের ভেলায় পাখির নীড়ে ফেরার দৃশ্য আর চোখে পড়ে না এখন।
কয়েক বছর আগেও যেখানে পাখির সংখ্যা ঠিক ছিল, বর্তমানে এসে তা বহু গুণ কমে গেছে। শহরাঞ্চলের পরিবেশ পাখির বসবাসের অনুপযোগী হয়ে ওঠায় পাখির সংখ্যা দিন দিন হ্রাস পেতেই আছে।
শহরাঞ্চলে পাখির সংখ্যা হ্রাস পাওয়ার কারণগুলোর শীর্ষে রয়েছে ‘মানবসৃষ্ট কারণ’। মানুষের অপকর্মের ফলে দিন দিন পাখির জন্য অনুপযোগী হয়ে উঠছে শহরাঞ্চল। দেশ যত উন্নত হচ্ছে শহরাঞ্চলের পরিবর্তন ততো দ্রুত হচ্ছে যার ফলে পাখির বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠছে শহরাঞ্চল।
মানুষের কর্মকান্ডই দায়ী শহরাঞ্চলে পাখির সংখ্যা কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে। অতিরিক্ত জনসংখ্যার জন্য অতিরিক্ত বাসস্থান নির্মাণে বৃক্ষ নিধন, অতিরিক্ত যানবাহনের চাপ, অতিরিক্ত খাদ্য উৎপাদনের জন্য রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার, রাস্তার পাশে থাকা বড় বড় গাছ কেটে রাস্তা চওড়া করা, ঝোপঝাড় কেটে ফেলা, বেপরোয়া হারে পাখি শিকার করা ইত্যাদি কারণে দিন দিন শহরাঞ্চলে কমে যাচ্ছে পাখির সংখ্যা।
পাখি গবেষক ও বিশেষজ্ঞদের মতে শুধু শহরাঞ্চলে নয় পুরো দেশেই পাখির সংখ্যা কমে গেছে। গত ৩০ বছরে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি কমেছে পাখির সংখ্যা। দুই যুগের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশের পাখি জরিপ ও গবেষণায় নেতৃত্ব দিচ্ছেন ইনাম আল হক। তিনি বলেন, ৩০ বছর আগে একটি হাওর এলাকায় যেখানে আমরা ৬ লাখ পাখি পেয়েছিলাম , বর্তমানে সেখানে একই সময়ে সেখানে গুণে পেয়েছি মাত্র ১ লাখ পাখি। তিনি আরো বলেন, অনেক জলাশয়ে, যেখানে এক সময় লক্ষাধিক পাখি দেখা যেত, বর্তমানে সেখানে ৩০-৪০ টি পাখি পাওয়া যাচ্ছে।
আইইউসিএন সর্বশেষ পাখি নিয়ে জরিপ করেছে ২০১৫ সালে। ঐ সময়ের জরিপে বাংলাদেশে ৬৫০টি প্রজাতির পাখির অস্তিত্ব পায় সংস্থাটি এবং দেখা যায়, গত ১০০ বছরের মধ্যে ১৯ প্রজাতির পাখি চিরতরে হারিয়ে গেছে।
বাংলাদেশে গ্রামের তুলনায় শহরে দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে পাখির সংখ্যা। যানবাহনের শব্দ ও ধোঁয়ায় রাস্তার আসেপাশে বাসা বানাতে পারে না পাখিরা। বড় বড় দালান-কোটায় ও বাসা তৈরি করতে পারে না পাখিরা। শহরে অধিক হারে গাছ কেটে ফেলার জন্য পাখিরা পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পারে না। ফলে বহু পাখি অন্যত্র চলে যায় আবার অনেক পাখি তাদের অস্তিত্ব হারায়।কাক ও চিল পুরোনো বা বহু বছর আগের বড় বড় গাছে থাকে। কিন্তু শহরে তা পাওয়া দুষ্কর হয়ে উঠেছে। ফলে শহরে ব্যাপক হারে কমছে কাক ও চিলের সংখ্যা। মাঝে মাঝে চোখে পড়ে চড়ুই পাখির বিরল দৃশ্য। রাস্তার পাশে তারা অজোরে ছুটাছুটি করছে যানবাহনের শব্দে, মানুষের কোলাহলে । এভাবেই দিন দিন কমে যাচ্ছে পাখির সংখ্যা। শুধু শহরে নয় পুরো দেশেই কমছে পাখির সংখ্যা।
পাখি আমাদের পরিবেশের অংশ। জীববৈচিত্র্যের একটি অংশ। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করতে ও বজায় রাখতে পাখির ভূমিকা রয়েছে বিশাল। তবে অধিক হারে পাখির সংখ্যা হ্রাস পাওয়ায় সেই ভারসাম্য নষ্ট হতে চলেছে, যা আমাদের সকলের উপর বিশাল ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে। তাই পাখির সংখ্যা হ্রাস পাওয়া প্রতিরোধ করতে সবাইকে সচেতন হতে হবে। দেশকে উন্নত করতে যেয়ে জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করা যাবে না। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় পাখি বিলুপ্ত হওয়া রোধ করতে সকলকে সচেতন হতে হবে।
পাখি শিকার করা বন্ধ করতে হবে। শহরাঞ্চলের সকল ঝোপঝাড় কেটে ফেলা যাবে না। দেশকে উন্নত করতে হবে কিন্তু জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করে তা করা যাবে না। সর্বোপরি, জীববৈচিত্র্যের অংশ হিসেবে পাখির অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে সচেতন হতে হবে সবাইকে।
লেখক : শিক্ষার্থী, রাজশাহী কলেজ