মানুষের কল্যাণে নিজের অর্থ-সম্পদ ব্যয় বা প্রদানকে দান বলে। একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির ও মানবকল্যাণের জন্য দান-সদকা করা হয়, যা আখিরাতের জন্য বিনিয়োগ স্বরূপ। দান করা একটি অতি মহৎ কর্ম। দান, সদকা করলে মনে প্রশান্তি আনে। দানে অর্থ, সম্পদ ও রিজিক বৃদ্ধি পায়। দানের কারণে নানান বালা-মসিবত থেকে মহান রব আমদের হেফাজত করেন। দানশীলতা মানুষের পাপ মোচন করে দেয়। পার্থিব পৃথিবীতে আল্লাহ-তায়ালা তার প্রিয় বান্দাদের যেসব ভালো গুণ অবলম্বনের যোগ্যতা দিয়েছেন, তার মধ্যে দানশীলতা অন্যতম। দানশীলতা একটি মহত্ গুণ বলে লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে বা পার্থিব লাভের আশায় দানখয়রাত করা বাঞ্ছনীয় নয়। দান করতে অন্তর হতে হবে পরিশুদ্ধ ও পবিত্র। দানের একমাত্র উদ্দেশ্য হতে হবে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করা।
ইদানীং আমাদের সমাজে দানের নামে আত্মপ্রচার এবং ফটোসেশনের মাত্রা বেড়ে গেছে, যা প্রত্যাশিত নয়। দেশে বর্তমানে অধিকাংশ দানের ক্ষেত্রে দেখা যায় আত্মপ্রচারই তার মূল উদ্দেশ্য। দানের চেয়ে আত্মপ্রচার ও ফটোসেশনের প্রতিযোগিতা চলছে যেন। কতেক মানুষের দানের যে চিত্র দেখা যায়, তাতে আমরা বিস্মিত হওয়ার চেয়ে আতঙ্কিত হই বেশি। করোনার মতো ভয়াবহ মহামারির কালেও দানের নামে ফটোসেশনের ফ্যাশন থেকে কিছু মানুষ মুক্ত হতে পারেনি। ইতিপূর্বে আমরা নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগে এমন ফটোসেশন লক্ষ করেছি। বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, প্রাকৃতিক দুর্যোগে ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সব কিছুতে এমন প্রচারণার জাহাজে পাড়ি দিয়েছি। কতেক নব্য ধনী, কালো টাকার মালিক বা তথাকথিত নেতা, পাতি, সিকি নেতারা দান করেন আত্মপ্রচারের নিমিত্তে। তথাকথিত হাতেমতাই বা দানবীররা পঞ্চাশ-একশ জনকে দানের নামে জড়ো করেন হাজারো মানুষ। একশ্রেণির মানুষ নিজেকে তথাকথিত মানবতার ফেরিওয়ালা জাহির করতে দান করার নামে এভাবে মানুষ জমায়েত করেন। তাদের গণ ও সামাজিক মাধ্যমে এমন অসংখ্য ছবি ও ভিডিও চিত্র হরহামেশা দেখা যায়। এসব দান তো দান নয়, ফটোসেশনই তাদের মূল লক্ষ্য।
এভাবে দান করার ফলে যারা সাহায্যপ্রার্থী তাদের অসহায় মুখখানি ছড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন গণ ও সামাজিক মাধ্যমে। এসব কর্মকাণ্ড দেখে মনে কষ্ট পান দানগ্রহীতা এবং তারা সমাজে লজ্জিত হন। তথাকথিত গরিব দরদিরা হতদরিদ্রদের মধ্যে খাবার বিতরণের নামে খাবারের বিশ/পঞ্চাশ প্যাকেট দিতে দেখা যায়, আর গণমাধ্যমে প্রচার করেন ৫০০ প্যাকেট বিতরণ করেছেন। আবার বিভিন্ন পার্বণে এমনও চিত্র দেখা যায়—পাতি, আধুলি, সিকি নেতাদের ঢাউস সাইজের ডিজিটাল ব্যানার ও পোস্টার সাঁটিয়ে প্রতিযোগিতা করে ফটোসেশনের মাধ্যমে নিম্নবিত্তদের দু-একটা খাবারের পোটলা বিতরণ করে সেলফি তোলেন। তারপর দেখা যায়—ঈদ, পূজাতে বিভিন্ন ভাইয়ের পক্ষ থেকে ব্যানার ও পোস্টার সাঁটিয়ে বস্ত্র বিতরণ বা জাকাত বিতরণের নামে নাটক মঞ্চস্থ করেন। তারা আবার অধিকাংশ মূল দলের নয়। দেখা যাবে হঠাত্ উদ্ভব হওয়া এসব তথাকথিত স্বঘোষিত নেতাদের নিজ এলাকায় জনসম্পৃক্ততা নেই, অনেকে তাদেরকে চেনেন না। দেশের অনেক মসজিদে দেখা যায়, জুমার দিন তথাকথিত দানশীল ব্যক্তিদের নামের তালিকা মাইকে বলা হয়। আবার তাদের জন্য ইমাম সাহেবকে অনেক বেশি দোয়াও করতে দেখা যায়। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য দান হলেও, তা মাইকে, বিভিন্ন মিডিয়াতে তারা প্রচার করেন বান্দার সন্তুষ্টির জন্য। তাদের যদি দান করার সত্ মনোভাব থাকে, তবে দেশে অনেক দাতব্য প্রতিষ্ঠান ও অসহায় নিরন্ন মানুষ আছে, সেখানে দান করতে পারেন, কিন্তু তাদের আত্মপ্রচারের উদ্দেশ্য থাকায় তারা তা সহসা করেন না।
হাদিসে উল্লেখ আছে, সাত শ্রেণির মানুষকে হাসরের ময়দানে যখন আরশের ছায়া ছাড়া কোনো ছায়া থাকবে না, তখন তাদের আরশের সেই ছায়াতলে আশ্রয় প্রদান করা হবে। তার মধ্যে ছয় নম্বর ক্রমধারায় বলা হয়েছে, ‘তারা এমন লোক, যারা এমন গোপনে দান করেন যে তার ডান হাত যা খরচ করল, বাম হাত তা জানে না। লোক দেখানো দান সদকার বিষয়ে কুরআন-হাদিসে সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত আছে। যারা প্রশংসা নেওয়ার উদ্দেশ্যে দান করবে, তাদের দ্বারা জাহান্নামের আগুনকে প্রজ্বলিত করা হবে।
সদকা দুই প্রকার :সাধারণ সদকা ও সদকায়ে জারিয়া। দুস্থ মানুষকে অর্থ দান করা ও তাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করা সাধারণ সদকার অন্তর্ভুক্ত। সদকায়ে জারিয়া হলো যেসব সত্কর্মের কল্যাণকারিতা স্থায়ী হয়; যেমন—যিনি কুরআন সুন্নাহর এলেম অন্যদের শিক্ষা দেন। মসজিদ, এতিমখানা, দাতব্যালয়, মাদ্রাসা, রাস্তা, ঘাট, সেতু, পুকুর প্রভৃতি গণকল্যাণমূলক খাতে ব্যয় করা। সুরা বাকারার ২৭২ নম্বর আয়াতে উল্লেখ আছে যে, তোমরা যা কিছু দান করো তা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই করো, আর যা কিছু তোমরা দান করো, তার পুরস্কার পুরোপুরি প্রদান করা হবে।
দান প্রকাশ্যে বা গোপনে যা-ই হোক, তা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য হতে হবে। লোক দেখানোর জন্য দান করা যাবে না। লোক দেখানো দান আল্লাহ কবুল করেন না। এতে ইবাদতের মাহাত্ম্য নষ্ট হয়। সুরা বাকারার ২৬৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, ‘হে বিশ্বাসীগণ, তোমরা দানের কথা প্রচার করে এবং দানগ্রহীতাকে কষ্ট দিয়ে তোমাদের দানকে নষ্ট করো দিয়ো না, ঠিক ঐ লোকের মতো, যে শুধু লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে দান করে।’ মানুষকে দেখানোর জন্য দান করলে পরকালে কঠিন শাস্তি রয়েছে। অতএব আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় বা দান করার সওয়াব শুধু সেই ব্যক্তিই লাভ করবে, যে স্বীয় সম্পদ দান করে অনুগ্রহ প্রকাশ করবে না এবং মুখ দিয়ে এমন তুচ্ছ বাক্যও বের করবে না, যা গরিব-অভাবীর সম্মানে আঘাত হানে এবং সে তাতে ব্যথা অনুভব করে। এ প্রসঙ্গে নবি করিম (স.) বলেছেন, কেয়ামতের দিন মহান আল্লাহ তিন শ্রেণির মানুষের সঙ্গে কথা বলবেন না, তাদের মধ্যে অন্যতম হলো দান করে যে অনুগ্রহ প্রকাশ করে (মুসলিম ১০৬)।
অসহায়দের পাশে দাঁড়ানো একটি মহত্ কাজ। দুস্থদের প্রয়োজনে এগিয়ে আসা ও দান করা একটি গুরুত্বপূর্ণ আমল। দুস্থ ও অসহায় মানুষের সেবার মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করা যায়। তবে সে সহায়তা বা দান-সদকা হতে হবে নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সঙ্গে। কেননা মহান আল্লাহর দরবারে ইখলাসবিহীন দান-সদকার কোনো মূল্য নেই। ইসলামের বিধান অনুযায়য়ী সবকিছুতে নিয়ত খুবই তাত্পর্যপূর্ণ বিষয়। এজন্য দান-খয়রাতে লোক দেখানো প্রবণতা বন্ধ হওয়া উচিত। প্রাণঘাতী করোনা মহামারিতে লকডাউনের কারণে দেশের মানুষের জীবনযাত্রা, অর্থনীতি সবকিছু স্থবির হয়ে পড়েছিল। কর্মজীবী লোকেরা কর্মহীন হয়ে নিদারুণ কষ্টে দিনাতিপাত করতে দেখা গিয়েছিল। কিন্তু সেই মহামারিতে সেসব তথাকথিত দানবীরকে তাদের সাহায্যার্থে এগিয়ে আসতে দেখা যায়নি।
পবিত্র কুরআনের সুরা আল বাকারার ২৭৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, ‘তোমাদের দান সেই অভাবীরা পাবে, যারা আল্লাহর পথে এমনভাবে নিবেদিত যে, তারা জীবিকার খোঁজে বের হতে পারে না। তারা মানুষের কাছে হাত পাতেন না দেখে অজ্ঞরা মনে করে যে, তাদের কোনো অভাব নেই, কিন্তু তুমি তাদের লক্ষণগুলোর দিকে খেয়াল করলে বুঝতে পারবে। তারা কখনো নাছোড় বান্দার মতো চায় না। আর তোমরা ভালো যা কিছু দান করবে, আল্লাহ অবশ্য সে ব্যাপারে সব জানেন।’ তাই পবিত্র কুরআন ও হাদিসে দান-সদকার বিষয়ে বিশদভাবে জেনে দান করতে পারলে উত্তম। মোটকথা, আমরা লোকদেখানো দান, সদকা, জাকাত বা ইবাদত চাই না। আল্লাহ-তায়ালা এসব লোককে বোঝার তৌফিক দান করুন, হেদায়েত করুন।
লেখক : আইনজীবী, কলামিস্ট ও গবেষক