রাষ্ট্রচিন্তক ও বিশ্লেষকরা বলে থাকেন, ‘মানুষের জীবনের নিরাপত্তা রক্ষার চেয়ে বড় কোনো কিছুই নেই।’ এটা প্রতিটি সাধারণ নাগরিকের মনের কথাও বটে। মূলত এ কারণেই রাষ্ট্রীয় বা সমাজজীবনের পরতে পরতে নিশ্চিদ্র নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিষয়কে এক নম্বার প্রায়োরিটি হিসেবে দেখে থাকে প্রতিটি রাষ্ট্র বা সরকার। কিন্তু এর পরও অনেক ভূখণ্ড পুরোপুরি ‘নিরাপদ’ হয়ে ওঠে না। এশিয়া থেকে শুরু করে পূর্ব ইউরোপ বা রাশিয়া কিংবা আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার বিভিন্ন প্রান্তে নিরাপত্তার প্রশ্নে যেন একই চিত্র পরিলক্ষিত হয়। এই সকল দেশের মানুষজন যে নির্বিঘ্নে ঘুমাতে পারে, এমন কথা কেউ জোর দিয়ে বলতে পারবে না। বর্তমানে চারিদিকে যেভাবে সংঘাত-হানাহানি আর যুদ্ধের ডঙ্কা বাজছে, তাতে বিশ্বের প্রতিটি সমাজের জন্যই পরম কাঙ্ক্ষিত বস্তু হয়ে উঠেছে ‘নিরাপত্তার গ্যারান্টি’।
প্রশ্ন হলো, সমাজগুলো এভাবে নিরাপত্তাহীনতার লীলাক্ষেত্র হয়ে উঠছে কেন? কেনই-বা উন্নয়নশীল বিশ্বের অনেক দেশ নিরপাত্তার প্রশ্নে একই বৃত্তের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে? লক্ষণীয়, এই সকল ভূখণ্ডে ‘নিরাপত্তা সংকট’ প্রকটতর হয়ে ওঠার অন্যতম কারণ হলো, সেখানকার ‘অস্থিতিশীল পরিবেশ’। এই সকল ভূখণ্ডে যেন বছরের বার মাসই আগুন জ্বলতে থাকে। রাজনৈতিক স্থবিরতাই এর জন্য বেশি দায়ি। উন্নত বিশ্বে যেখানে দেখা যায়, নিজের দেশের মানুষের প্রতি তাহারা খুবই আন্তরিক, সেখানে উন্নয়নশীল বিশ্বে দেখা যায়, তারা নিজেদের মধ্যেই মারামারি-কাটাকাটি করছে। নিজের লোককে মারছে নিজেই। গোত্র বা দলগত অস্থিরতাই এখানকার এক নম্বর সমস্যা। এর অভিঘাতে স্বভাবতই বিঘ্নিত হচ্ছে নাগরিকের স্বাভাবিক চলাচলের পরিবেশ। নিরাপত্তার সহজ অর্থ হলো, ‘ভয়-ভীতিহীন পরিবেশ’, যেখানে সবাই স্বাধীন ও মুক্তভাবে চলাচল করতে পারবে, ব্যবসায়-বাণিজ্যের সুষ্ঠু পরিবেশ থাকবে। কিন্তু অনেক উন্নয়নশীল সমাজে কি সেই পরিবেশ আছে?
ভয় এবং নিরপত্তা—এ দুইটি কী জিনিস এবং কীভাবে তা জয় করতে হয়, তা বুঝতে আমরা বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিনের কথা স্মরণ করতে পারি। একসময় মানুষ বজ্রপাতকে খুবই ভয় পেত। অর্থাৎ, এই বজ্রপাত সমাজের মানুষের মনে কাঁপুনি ধরিয়ে দিয়েছিল। ফলে সেই সমাজের সকলেই এটা থেকে পরিত্রাণের উপায় খুঁজতে থাকে। সেই যুগে ইলেকট্রিসিটি বা বিদ্যুতকে ভাবা হতো ‘স্বর্গের বিষয়’ হিসেবে। অর্থাৎ, বজ্রপাতের বিষয়ে মানুষ নিজেদের কতটা অনিরাপদ মনে করত, তা সহজেই অনুমেয়। ঠিক এমন একটি অবস্থায় এগিয়ে আসেন মহামতি বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন। স্বর্গ থেকে যে বিদ্যুৎ আসে, তথা বজ্রপাতের ওপর ‘মানুষের নিয়ন্ত্রণ’ প্রতিষ্ঠা করে দেখান! আবিষ্কার করেন বজ্রনিরোধক যন্ত্র। বর্তমানে আমরা যে বজ্রনিরোধোক যন্ত্র বা দণ্ড ব্যবহার করি ভবনগুলোতে, তা ফ্রাঙ্কলিনেরই আবিষ্কার। আনন্দের বিষয় হলো, ফ্রাঙ্কলিন কেবল বিশ্ববাসীকে প্রাকৃতিক দুর্যোগের হাত থেকে রক্ষা করার কৌশলই শিখিয়ে যান নি, উপরন্তু তিনি আমাদের নিরাপত্তার নিগূঢ় তত্ত্বটিও শিখিয়ে দিয়ে গেছেন। নিরাপত্তা সম্পর্কে তার উক্তিটি হলো, ‘যারা সামান্য সাময়িক নিরাপত্তা পেতে গিয়ে অপরিহার্য স্বাধীনতা ত্যাগ করতে পারে, তারা স্বাধীনতা কিংবা নিরাপত্তা—কোনোটিরই অধিকারী নন।’ বস্তুত, এই কথার মধ্যেই নিহিত রয়েছে সেই সকল অনিরাপদ সমাজকে ‘নিরাপদ’ করার সূত্র!
উন্নয়নশীল বিশ্বের যেই সকল দেশে চরম অনিরাপত্তা বিরাজ করছে, লক্ষ করলে দেখা যাবে—সেখানকার রাজনৈতিক বা সামাজিক স্তরবিন্যাসে যেন দীর্ঘস্থায়ী কোনো ‘সিস্টেম’ গড়ে ওঠেনি; সমাজব্যবস্থা এখনও নানা সমস্যায় জর্জরিত। ফলে গোত্র বা পক্ষগুলো সর্বদাই মুখোমুখী অবস্থানে চলে আসে। এরূপ একটি অবস্থায় ‘সাময়িক নিরাপত্তা’ই তাদের নিকট অগ্রাধিকার হয়ে ওঠে। এমনও লক্ষ করা যায়, এই ক্ষণস্থায়ী নিরাপত্তার জন্যই সরকারগুলো এমনকি নিজের ‘মূল্যবান নিরাপত্তার চাবি’ তুলে দেয় অন্যের হাতে! অথচ ফ্রাঙ্কলিন বিশ্বকে শিখিয়ে গেছেন যে, নিরাপত্তার ডিকশনারিতে ‘সাময়িক’ বলে কোনো শব্দ-ই নেই! সেই সমাজকে নিরাপদ বলা যায়, যেখানে দীর্ঘমেয়াদে, তথা টেকসই নিরাপত্তা বিরাজ করে। কিন্তু উন্নয়নশীল বিশ্বের সমাজব্যবস্থায় কি আমরা ‘সাময়িক নিরাপত্তা’ ব্যতিত আর কিছু দেখতে পাই?
এহেন অবস্থা থেকে কীভাবে উত্তরণ ঘটবে? সত্যি বলতে, আমার-আপনার নিরাপত্তা কারও হাতে নেই; বরং তা রয়েছে আমাদের নিজেদের হাতেই! উন্নয়নশীল সমাজগুলো যতদ্রুত নিজেদের মধ্যে হানাহানি বন্ধ করবে, সাময়িক নিরাপত্তার মতো ক্ষতিকর কনসেপ্ট থেকে বের হয়ে আসবে, ততদ্রুত সেখানকার মানুষ নিরাপদে বসবাস করতে পারবে। অন্যথায়, অনিরাপদ পরিবেশ সকলের জীবনকেই ঢেকে দেবে অনিশ্চিয়তার চাদরে।