বিগত কয়েক বছর আগে থেকেই বিজ্ঞানীরা শরীরের সঙ্গে মুখের রোগের সম্পর্ক নিয়ে অনেক গবেষণা করেছেন। এর মধ্যে হূদেরাগ, ডায়াবেটিস, গর্ভাবস্থা, অস্টিয়ওপোরোসিসের সঙ্গে সম্পর্ক নিশ্চিত হয়েছে। তাই, এই সব গবেষণার কাজ মাড়ির রোগের আধুনিক চিকিত্সার প্রয়োজনীয়তা ও মুখের যত্নের ব্যাপারে জনগণকে সচেতনতা বৃদ্ধির কথা বলা হচ্ছে।
মাড়ির রোগের কারণ ও জীবাণুসমূহ
মাড়ির চারপাশে খাদ্যকণা জমা হয়ে ডেন্টাল প্লাক তৈরি করে, তাতে অসংখ্য জীবাণু বা ব্যাকটেরিয়া বসবাস করে এবং সেখান থেকেই মাড়িতে প্রদাহ বা ইনফেকশন হয়। মাড়ির এই প্রদাহ ধীরে ধীরে মাড়ির টিস্যুকে ও পরবর্তী সময়ে হাড়কেও সংক্রমণ করে, সেটাকে বলা হয় পেরিওডন্টাইটিজ। এগুলো সংক্রমণ আরো বৃদ্ধি পায়, যারা ধূমপান করেন, তামাক জর্দা ব্যবহার করেন, বিভিন্ন ড্রাগ ব্যবহার করেন বা ডায়াবেটিস আছে, গর্ভাবস্থা অথবা যারা স্টোরওয়েড বা ক্যানসার রোগের ওষুধ গ্রহণ করে থাকেন। যাদের শরীরে রোগপ্রতিরোধ শক্তি কম, তাদের মাড়ির রোগ তাড়াতাড়ি বৃদ্ধি পায়। সাধারণত শতকরা ৭৫ শতাংশ লোকই কোনো না কোনো মাড়ির রোগে আক্রান্ত। এদের বৈশিষ্ট্য হলো, মাড়ি থেকে রক্তপড়া, মাড়ি ফুলে যাওয়া, দাঁত থেকে মাড়ি আলগা হয়ে যাওয়া বা দাঁত নড়ে যাওয়া। এই রোগের পরিমাপ নির্ধারণ করা হয় পেরিওডোন্টাল প্রোভ দিয়ে বা এক্সরের মাধ্যমে এবং মাড়ির ক্ষয়ক্ষতির গভীরতা পেরিওডোন্টাল পকেট পরীক্ষার মাধ্যমে। এই পকেটে চার থেকে ১৫ মিটার পর্যন্ত গভীর হতে পারে। ২ মিমি পর্যন্ত স্বাভাবিক ধরা হয়। অনেকেই এই অবস্থাতে চিকিত্সায় আসেন না, ফলে ক্ষতির পরিমান বাড়তেই থাকে।
মাড়ির রোগ থেকে হার্টের সমস্যা ও ক্যানসার হওয়ার আশঙ্কা
সম্প্রতি এক সমীক্ষায় উল্লেখ করা হয়েছে—মাড়ির রোগ থাকলে মুখের ক্যানসার হওয়ার আশঙ্কা অন্যান্য সুস্থ মাড়ির রোগীদের চেয়ে অনেক বেশি। তীব্র মাড়ির রোগ যাদের রয়েছে, তাদের মধ্যে ক্যানসারের পূর্বাবস্থা (Pre-cancerous) হওয়ার আশঙ্কা দ্বিগুণ এবং মুখের ভেতরে যে কোনো ধরনের টিউমার হওয়ার আশঙ্কা অন্যান্য সুস্থ মাড়ির ব্যক্তিদের তুলনায় চার গুণ বেশি। গবেষকরা বলেন, এই প্রথম বারের মতো মুখের ক্যানসারের সঙ্গে মুখের ইনফেকশনের বা প্রদাহের একটা মিল পাওয়া গেল। গবেষকরা আরো উল্লেখ করেন, এ ধরনের প্রদাহের সঙ্গে অন্যান্য ক্যানসারেরও সম্পর্ক পাওয়া গেছে, যেমন—হেলিকো পাইলোরির সঙ্গে পেটের ক্যানসার ও সারভাইক্যাল ক্যানসার এবং কাপোসি সারকোমার যোগ আছে।
প্রতিরোধ ব্যবস্থা
মুখের ক্যানসার প্রতিরোধে যেসব বিষয়কে গবেষকরা অধিক গুরুত্ব দিয়েছেন, সেগুলো হলো—তামাক ও ধূমপান, বয়স, লিঙ্গ, ধর্ম, শিক্ষা, পেশা, খাদ্যাভ্যাস এবং দন্তরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে মুখ পরীক্ষা। সুতরাং মুখের ক্যানসার প্রতিরোধে সব সময়েই মুখের যত্নের প্রয়োজন অর্থাত্ প্রতি বছর অন্তত একবার মাড়ির স্কেলিং করা এবং সেই সঙ্গে ডেন্টাল প্লাক প্রতিরোধে দুই বেলা—সকাল এবং রাতে দাঁত ব্রাশ করা। তবে প্রতিদিন কিছু তাজা ফলমূল ও শাকসবজি বিশেষত হলুদ রঙের যে কোনো ফল বা তরকারি এবং মূল খাবারের সঙ্গে বেশি পরিমাণে সালাদ খাওয়া খুব প্রয়োজন। সালাদের মধ্যে গাজর, টম্যাটো, লেটুসপাতা ও লেবুর রস দিলে রোগ-প্রতিরোধ শক্তি অনেক গুণ বেড়ে যায়। ফলের মধ্যে আমলকী, পেয়ারা জাম্বুরা, কমলা, আপেল, কামরাঙা, কলা, পেঁপে ও আনারস প্রধান। সুতরাং মুখের নিয়মিত পরিচর্যা ও যত্নের সঙ্গে সঙ্গে খাদ্যাভ্যাসও পরিবর্তন করতে হবে।
লেখক : অধ্যাপক, দন্ত বিভাগ, বারডেম হাসপাতাল