আমাদের দৈনন্দিন জীবনে এমন কিছু তুচ্ছাতিতুচ্ছ অনুষঙ্গ থাকে, যা আপাতদৃষ্টিতে গুরুত্বহীন মনে হলেও গভীর তাৎপর্য বহন করে। মাছি তেমনই এক ক্ষুদ্র প্রাণী, যা কেবল বিরক্তিকর এক পতঙ্গ নয়, বরং আমাদের জীবন, সমাজ ও সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। বাঙালি ঘরে মাছি মানে যেন এক অদৃশ্য সঙ্গী—না চাইলেও যে সর্বদা বিদ্যমান, দুধে-ভাতে, এমনকি লোককথায়ও যার অবাধ বিচরণ।
মাছি শুধু আমাদের রান্নাঘরের খাবারেই নয়, প্রবাদ-প্রবচনেও তার প্রভাব অনস্বীকার্য। ‘মাছি মারা’, ‘মাছি গলায় পড়া’, ‘মাছি গেলা’—এমন নানা বাক্যবন্ধে মাছি বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে। এই প্রাণীটি এতটাই প্রাত্যহিক যে, একে বাদ দিয়ে আমাদের ভাষার সাবলীলতা কল্পনা করাও কঠিন। কর্মজীবনে ‘মাছি মারা কেরানি’ বলে যে চিত্রটি ফুটে ওঠে, তা অলসতা ও সময়ের অপচয়ের প্রতীক। যিনি কর্মক্ষেত্রে চা পান করে আর ঘড়ি দেখে দিনের বেশির ভাগ সময় পার করেন, তার কাজকে ব্যঙ্গার্থে ‘মাছি মারা’ বলা হয়। অথচ মজার বিষয় হলো, সেই কেরানি হয়তো জীবনে একটি মাছিও মারেন না, কিন্তু তার কেরানিজীবন এই শব্দবন্ধের মাধ্যমেই পূর্ণতা পায়। এর থেকেই বোঝা যায়, মাছি আমাদের জীবনের এক বিচিত্র প্রতীক হয়ে উঠেছে।

মাছির মতো নাছোড়বান্দা প্রাণী সম্ভবত আর দ্বিতীয়টি নেই। আপনি বারান্দায় বসে আরাম করে চা পান করতে চাইলেও মাছি নিমন্ত্রণ ছাড়াই এসে হাজির হবে। অনেকে মনে করেন মাছি শালীনতা বোঝে। সে যেন সোজাসাপটা ঘোষণা করে :‘তোমার হাইজিনের যতই বড়াই করো, আমি খাবারে যাবই।’ এই চরিত্রটি যেন আমাদের জীবনে আসা সেই সব তুচ্ছ অথচ বিশ্রী বিপদের প্রতীক, যা ঠিক বিষাক্ত না হলেও অস্বস্তিকর। ধরুন, বাড়িতে হঠাত্ অতিথি এসেছেন, আর ফ্রিজের মাছটা ঠিক তখনই খারাপ হয়ে গেল। ঠিক সেই মুহূর্তে যদি রান্নাঘরে একদল মাছি নেচে বেড়ায়, তা যেন সমাজে আপনার ‘দূষিত’ অবস্থানকে অতি দ্রুত স্পষ্ট করে দেয়। মাছি যেন এক অদৃশ্য মাপকাঠি, যা দিয়ে সমাজের পরিচ্ছন্নতা ও আপনার ব্যক্তিগত হাইজিনের দর্প চূর্ণ হয়।
মাছি ক্ষুদ্রকায় হলেও এটি পৃথিবীর অন্যতম ‘অতিথিপরায়ণ’ জীব। আপনি যতই দরজা-জানালা বন্ধ করে থাকুন না কেন, মাছি ঠিকই আপনাকে খুঁজে বের করবে। শহর বা গ্রাম, প্রাসাদ বা কুঁড়েঘর—মাছি কারও সঙ্গে বৈষম্য করে না। তার কাছে সবাই সমান। এই বৈশিষ্ট্যের মাধ্যমে মাছি যেন সামাজিক সমতার এক নীরব বার্তাবাহক।
মাছির গুণের তালিকা করতে বসলে একটি গোটা বই লেখা সম্ভব। খাবার খাওয়ার সময় আপনি যতই ‘স্যানিটাইজড’ থাকুন, মাছি এসে আপনার তরকারিতে ‘টেস্ট’ দেবেই। এতে অবশ্য খাবারের স্বাদে খুব একটা পার্থক্য না পড়লেও মানসিক শান্তিতে আঁচড় লাগে। তবে মাছিকে তো আর ‘অফিস অর্ডার’, ‘সেনা ট্যাংক’ দিয়ে তাড়ানো যায় না! এইখানেই মাছির অদম্যতার প্রকাশ।
আশ্চর্যজনকভাবে, মাছির চোখ একজন চৌকশ গোয়েন্দার চেয়েও বেশি চতুর। আপনি যদি ভাবেন, কেউ দেখছে না, তাহলে ভুল ভাবছেন। মাছি দেখছে। তার চোখে যেন ১ বিলিয়ন ফেস রিকগনিশন সেন্সর আছে। মাছি জানে, আপনি কখন বাথরুমে ঢুকলেন, কখন মোবাইলে হালকা নীল ছায়া খুললেন, এবং কখন ফ্রিজ খুলে মিষ্টি-জাতীয় দ্রব্য চুরি করে খেলেন। মাছির এই তীক্ষ্ন পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা যেন জীবনের গোপনীয়তা ভঙ্গের এক প্রতীক।
মাছির এই গুরুত্ব কেবল আমাদের দেশেই সীমাবদ্ধ নয়। বড় বড় দেশেও মাছির ভূমিকা একই রকম। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উদাহরণ দেওয়া যাক। সম্প্রতি সেখানে লাখ লাখ ডলার খরচ করে মাছি তৈরি করা হচ্ছে—তবে খাবার জন্য নয়, শত্রু দমনের জন্য! এই মাছিরা গরুর মাংস খায়, তাও জীবন্ত অবস্থায়! এদের নাম ‘নিউ ওয়ার্ল্ড স্ক্রুওয়ার্ম’। মার্কিন বিজ্ঞানীরা আকাশ থেকে ‘বাঁজা’ পুরুষ মাছি ফেলার পরিকল্পনা করছেন, যাতে স্ত্রী মাছির সঙ্গে প্রেম হলেও বংশবৃদ্ধি না হয়। হ্যাঁ, এটা একরকম ‘বিজ্ঞানসম্মত ব্রেকআপ’। যেখানে আমরা মাছি তাড়াতে কয়েল জ্বালাই, সেখানে আমেরিকায় কোটি কোটি টাকা খরচ করে মাছিকে ‘প্রেমে ছ্যাঁকা’ দেওয়া হচ্ছে! এই বৈপরীত্য আমাদের মাছিকে নিয়ে ভাবনাকে আরো হাস্যকর করে তোলে।
মাছিরও আত্মসম্মানবোধ আছে। আপনি যতই ওকে তাড়ান, সে ততই ফিরে আসে। মনোবিজ্ঞানীরা হয়তো একে ‘অ্যাটেনশন সেকিং বিহেভিয়ার’ বলবেন। একসময় যখন খাবারে মাছি পড়লে চুপি চুপি তা সরিয়ে ফেলা হতো, এখন হেলথ ইনফ্লুয়েন্সাররা সেই ঘটনার ভিডিও করে ফেসবুকে পোস্ট করেন’—দেখুন, এই হোটেলে মাছি! অথচ মাছির দিকটা নিয়েও তো ভাবা দরকার—তারও তো ফিলিংস আছে!
মাছি আমাদের এক মূল্যবান শিক্ষা দেয়—ক্ষুদ্র হলেও কাউকে অবহেলা করা উচিত নয়। আপনার অতি যত্নে বানানো বিরিয়ানি এক সেকেন্ডে সে ছুঁয়ে দিলে সেটি হয়ে যায় ‘মাছি পড়া খাবার’—এককথায় অবমাননার চূড়ান্ত। এর মানে হলো, ছোট কোনো ভুলও বড় ফল বয়ে আনতে পারে। মাছির মতো যারা, তারা জীবনে ছোট হয়েও বড় বিপদ ডেকে আনতে পারে। আবার মাছির মতো কেউ কেউ বারবার ফিরে এসে বুঝিয়ে দেয়, ‘আমি ক্ষুদ্র হলেও স্থায়ী।’
মাছি আসলে এক অদ্ভুত জীব। সে যেমন বিরক্তিকর, তেমনি সমাজ-রাজনীতি-প্রেম-পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা—সবকিছুর প্রতীক। মাছি শুধু পোকা নয়, সে আমাদের জীবনের এক অদৃশ্য গাইড—যে শিখিয়ে দেয়, ছোট বলেই অবহেলা কোরো না—কারণ প্রয়োজন পড়লে আমিও আকাশ থেকে পড়তে পারি!
অনেকেই বলেন, মাছি নাকি জ্ঞানের প্রতীক! কারণ সে সবচেয়ে গোপন জায়গাতেও ঢুকে পড়ে, যেন সবকিছু জানার আগ্রহ তার অস্থিমজ্জায়। অথচ, কারো ঘরে মাছি দেখা গেলে গৃহিণীরা লজ্জায় পড়ে যান’ লোকজন ভাববে বুঝি ঘর পরিষ্কার না!’ এই দ্বিধাদ্বন্দ্বই মাছির মহিমাকে আরো বাড়িয়ে তোলে।
মজার ব্যাপার হলো, মাছি মারার জন্য মানুষ যে পরিমাণ পদ্ধতি আবিষ্কার করেছে—হ্যান্ড ফ্যান, হাততালি, কয়েল, স্প্রে, ইলেকট্রিক ব্যাট, এমনকি মন থেকে অভিশাপ—তাতে যদি জীবনের সমস্যাও তাড়ানো যেত, তাহলে তো আমরা সবাই ‘সুখের হেলিকপটারে’ করে ঘুরে বেড়াতাম! অথচ মাছির মতো সমস্যা ঠিকই ফিরে আসে, বারবার, অন্য দরজা দিয়ে, কখনো জানালা ফাঁক দিয়ে, আর কখনো সরাসরি মাথার ওপর দিয়ে।
মাছির এই প্রত্যাবর্তনের জেদ একেক সময় প্রেমে প্রত্যাখ্যাত বেকার যুবকের জেদের মতো মনে হয়—সেই একই স্থানে বারবার ফিরে আসা, যেখানে তাকে কেউ দেখতে চায় না! আপনি অফিসে মনোযোগ দিয়ে কাজ করছেন? মাছি এসে মনোযোগ টেনে নেয়। আপনি খাবারে মনোযোগ দিলেন? ওর মনে হলো, ও-ও একটু ‘রিভিউ’ দিয়ে যাক। আপনি ঘুমাতে যাচ্ছেন? মাছি ঠিক বুঝে যায়, এখনই ব্রেন ওয়াশের সময়। সে তার মৃদু গুনগুনিয়ে গান শুরু করে—‘আমি তোমার চোখের পাপড়ি ছুঁয়ে যাব, ঘুমোতে দেব না!’
মাছিকে শুধু পোকা হিসেবে দেখা মানেই ভুল করা। সে এক জীবনদর্শন। এমন এক উপস্থিতি, যার কোনো রূপচর্চা নেই, অথচ ভিআইপি আচরণে ভরপুর। তার না আছে ডিগ্রি, না আছে চাকরি, তবুও প্রতিদিন সে আমাদের সময়, খাবার, এমনকি ঘুমের ওপরও ‘ডমিনেশন’ কায়েম করে চলে।
আসলে মাছি হলো সেই আত্মীয়, যাকে না বললেও সে দাওয়াত ছাড়াই আসে, খায়, বসে, শুয়ে, আবার পরদিনও ফিরে আসে। তার যাওয়া না যাওয়ার ওপর আমাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই।
তবে এর মধ্যেও শেখার আছে। মাছি আমাদের শেখায়—জীবনে টিকে থাকতে হলে লজ্জা নয়, সাহস লাগে। প্রতিদিন শত ঝামেলা আর মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়েও সে ফিরে আসে, আপন ঘরে, আপন থালায়, আপন মাথায়। কোনো আপত্তিকেই তোয়াক্কা না করে, সে আপন দৃষ্টিভঙ্গিতে এগিয়ে চলে। মাছি জানে, সে ‘পেস্ট’ হলেও, তার আছে ‘প্রেস্টিজ’।
তাই বলাই যায়—মাছি শুধুই একটি পোকা নয়, সে আমাদের জীবনের এক জ্যান্ত উপমা।
বিরক্তিরও যদি আত্মসম্মান থাকে, তাহলে তার নাম মাছি! আর যে জীবনে মাছি নেই, সে জীবন হয়তো পরিষ্কার—কিন্তু নিঃসন্দেহে নিস্তরঙ্গ!
লেখক : রম্যরচয়িতা।
(এই লেখা লেখকের একান্ত ব্যক্তিগত অভিমত; এ সংক্রান্ত কোনো দায় দৈনিক মূলধারা বহন করবে না)