পরিবেশদূষণের অন্যতম কারণ বায়ুদূষণ। বায়ুদূষণ আমাদের প্রভূত ক্ষতি করছে। বায়ুদূষণের যত উপাদান আছে, তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে পার্টিকুলেট মেটার ২.৫ (PM2.5)। এছাড়াও রয়েছে পার্টিকুলেট মেটার ১০ (PM10), ওজোন (০৩), সালফার ডাই-অক্সাইড, নাইট্রোজেন অক্সাইড, কার্বন ডাইঅক্সাইড, কার্বন মনোঅক্সাইড প্রভৃতি ক্ষতিকারক গ্যাস। ওজোন লেয়ার আমাদেরকে অতিবেগুনি রশ্মি থেকে রক্ষা করলেও ওজোন গ্যাস বায়ু দূষণ করে মানুষের বিবিধ রোগ তৈরি করে।
বায়ুদূষণের মাত্রা পরিমাপ করা হয় ইয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স বা এ কিউ আই দিয়ে। ঢাকা শহরে গত ৬ জুলাই ২০২৫-এ কিউ আই-এর মান ছিল ৮৬। এতেই বোঝা যাচ্ছে ঢাকার বাতাস কতটা দূষিত। যার প্রধানতম দূষণকারী বস্তু পিএম ২.৫। ঢাকা শহরে এই পার্টিকুলেট মেটার ২.৫-এর মান ২৮ মাইক্রোগ্রাম প্রতি ঘন মিটার। যেখানে বিশ্ব-স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক প্রদত্ত সূচক মান ৫ মাইক্রোগ্রাম প্রতি ঘন সিটার। পিএম ২.৫ হলো এমন পার্টিকল, যার ব্যাস ২.৫ মাইক্রোন। যেখানে আমাদের চুলের ব্যাস ৫০-৭০ মাইক্রোন। সে সেই হিসাব অনুযায়ী পিএম ২.৫ চুলের তুলনায় কত গুণ ক্ষুদ্র হতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়।
এই ক্ষুদ্র পার্টিকল অতি সহজেই মানুষের নিশ্বাসের মাধ্যমে ফুসফুসে, এমনকি রক্তের সঙ্গেও মিশে যেতে পারে। এই পার্টিকলের তুলনায় রোগ সৃষ্টিকারী প্যাথোজেন (ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস ও ফানগাসসহ অন্যান্য জীবাণু) আরো অনেক ক্ষুদ্র। বাতাসের মধ্যে সাসপেনডেড প্যাথোজেনগুলোর ব্যাস ০.৫ মাইক্রোন থেকে ১ মাইক্রোন। উদাহরণ হিসেবে বলা স্টেফাইলোকক্কাস ব্যাকটেরিয়া, ল্যাকটোব্যাসিলাস ব্যাক-টেরিয়া, একটিনো ব্যাকটেরিয়া, প্রোটিও ব্যাকটেরিয়া, অ্যাসকোমাইকোটা ফানগাসসহ অসংখ্য ভাইরাস, আরকিয়া এবং প্রোটিস্টা পিএম ২.৫ দ্বারা পরিবাহিত হয়।
দুঃখজনক বিষয় হলো, আমাদের দেশে রাজধানীসহ বিভিন্ন শহরে ময়লা-আবর্জনা পরিবহনকারী গাড়িগুলো বেশির ভাগ সময় ময়লা ফেলতে ফেলতে রাস্তা অতিক্রম করে। এটা কতটা যে ভয়াবহ, তা আমরা কল্পনাও করতে পাারি না। কেননা এই গাড়িগুলো জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর পিএম ২.৫ বিতরণ করতে থাকে আমাদের মধ্যে! নামকা ওস্তে ত্রিপল দিয়ে ঢেকে রাখলেও এই রোগ জীবাণু সৃষ্টিকারী জীবাণুযুক্ত ময়লা-আবর্জনা এমনভাবে পরিবহন করা কি চলতেই থাকবে? তারা শুধু গন্ধ ছড়িয়েই নগরবাসীকে তীব্র কষ্ট প্রদান করছে না। বরং উচ্চ পিএম ২.৫ যুক্ত এই ময়লা-আবর্জনা থেকে উত্পন্ন জীবাণু অতি সহজেই আমাদের ফুসফুসসহ রক্ত সঞ্চালনে মিশে মারাত্মক রোগ সৃষ্টি করে চলছে। যে জীবাণুগুলো ছিল শহরের নির্দিষ্ট জায়গায়, সেই জীবাণুগুলোকে অপরিকল্পিতভাবে সংগ্রহ ও পরিবহনের ফলে প্রতিটি মানুষের শরীরে পৌঁছে যাচ্ছে। নগরীতে তৈরি করছে একটি অসহনীয় পরিবেশ। পরিবেশে রোগ-সৃষ্টিকারী প্যাথোজেন ও বাহকের সংখ্যাও বৃদ্ধি করছে। ফলে অনেক সংক্রামক রোগের ইমার্জিং ও রি-ইমার্জিং হচ্ছে অতি সহজেই।
প্রশ্ন হচ্ছে, এই নাজুক পরিস্থিতি হতে উত্তরণের উপায় কী? এজন্য সবার আগে প্রয়োজন দেশপ্রেম ও মানবতা। এজন্য প্রথমেই ঝুঁকিপূর্ণ ও ঝুঁকিহীন বর্জ্যকে আলাদা করতে হবে। ঝুঁকিপূর্ণ বর্জ্য যেমন :রাসায়নিক দ্রব্য, ব্যাটারি, মেডিক্যাল বর্জ্য ইত্যাদি। ঝুঁকিহীন বর্জ্য; যেমন—প্লাষ্টিক, দৈনন্দিন ব্যবহূত কাজে উত্পাদিত বর্জ্য, বায়োডিগ্রেডেবল বর্জ্য ইত্যাদি। আলাদা করার পর বর্জ্য পরিবহনের জন্য প্রস্তুত করতে হবে। নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে ঝুঁকিপূর্ণ বর্জ্যের প্রতি সজাগ দৃষ্টি রেখে প্রতিটি কনটেইনার সিল করে নিতে হবে। অত্যন্ত সতর্ক থাকতে হবে কোনোভাবেই যেন কনটেইনার ফুটো হয়ে বর্জ্য বেরিয়ে আসতে না পারে। রাস্তার পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে কনটেইনারগুলি সাজাতে হবে। এসব কাজ করতে হবে যথাযথভাবে পিপিই ব্যবহার করে।
এরপর সঠিক পরিবহন পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে। এক্ষেত্রে ব্যবস্থাপনার গাইড লাইন অনুসরণ করে, পরিবহনের রুট, পরিবহনের লোড ও ভেহিকল নির্দিষ্ট করে পরিবহন শুরু করা আবশ্যক। যদি কোনো বর্জ্য লিক হয়ে পরিবেশে পড়ে যায়, তবে অবশ্যই পরিবহন বন্ধ করতে হবে এবং কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে প্রয়োজনীয় পরিচ্ছন্নতা শেষে আবার পরিবহন শুরু করতে হবে। বিষয়টি জরুরি বিধায় আমরা এ ব্যাপারে নগরবিদ ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের আশুদৃষ্টি আকর্ষণ করি।
লেখক : অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, কীটতত্ত্ব বিভাগ, জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিত্সাপ্রতিষ্ঠান, নিপসম, মহাখালী, ঢাকা
(এই লেখা লেখকের একান্ত ব্যক্তিগত অভিমত; এ সংক্রান্ত কোনো দায় দৈনিক মূলধারা বহন করবে না)