বর্তমানে দেশ চালাচ্ছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। দায়িত্ব নেওয়ার পর এই সরকারকে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছে। এই অবস্থায় সামনে জাতীয় বাজেট। বাজেট ঘোষণা এবং তা বাস্তবায়ন এই সরকারেরর চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি চ্যালেঞ্জ। এই সরকার অঞ্চলভিত্তিক বাজেট প্রণয়ন করলে দেশের বিভিন্ন স্থানের আঞ্চলিক বৈষম্য দূর করতে সক্ষম হবে। অঞ্চলভিত্তিক বাজেট প্রণয়ন করতে পারলে এ সরকার যুগান্তকারী একটি সাফল্য লাভ করবে বলে সুধিজনরা মনে করছেন। কারণ আমাদের দেশের জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা, প্রত্যাশা ও সময়ের বাস্তব চাহিদা মোকাবিলায় প্রতি বছর বাজেট প্রণীত হলেও বাজেটের সুষ্ঠু ও পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন কখনোই দেখা যায় না। ঘোষিত বাজেটে লক্ষ করা যায় আমলাতান্ত্রিক, সচিবালয়ভিত্তিক ও রাজধানী কেন্দ্রিক। বাজেট প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় বরাবরই আঞ্চলিক বৈষম্যের শিকার হচ্ছে দেশের অনুন্নত এলাকাগুলো। বাজেটে কৃষক, শ্রমিক, দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কথা উল্লেখ থাকলেও তা থেকে বরাবরই উত্তরাঞ্চলের মানুষকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। বাজেট প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় উত্তরাঞ্চলের তৃণমূল জনগণের অংশগ্রহণ এবং তাদের অধিকারের কথা কখনোই প্রতিফলিত হয়নি। অঞ্চলভিত্তিক বাজেট প্রণয়ন না করার ফলে বাজেট ঘোষণা শুধু আনুষ্ঠানিকতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে ।
বাজেট বলতে এ দেশের মানুষের ধারণা, নির্দিষ্ট কিছু পণ্যের দাম কমল আবার কিছু কিছু পণ্যের দাম বাড়ল। কিছু দ্রব্যের ওপর শুল্ক বৃদ্ধি আবার কিছু দ্রব্যের ওপর শুল্ক কম—এর বাইরে কোনো ভাবনা নেই। আসলেই কি বাজেট কিছু পণ্যের দাম বৃদ্ধি-হ্রাস মূলকথা? অঞ্চলভিত্তিক তৃণমূল পর্যায়ের মানুষের চাহিদা ও পরামর্শের আলোকে বাজেট প্রণীত হলেই এ দেশের জনগণের ভাগ্যের উন্নয়ন সম্ভব। মাঠপর্যায়ে মতামত গ্রহণ না করে চেয়ার-টেবিলে বসে বাজেট প্রণয়ন করায় তার ফলাফল লাভ ও মূল্যায়ন থেকে তৃণমূল পর্যায়ে জনগণ বঞ্চিত এবং আঞ্চলিক বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলের বৃহত্তর রংপুর ও দিনাজপুর। এ অঞ্চলে কৃষিতে ব্যাপক সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও সুষ্ঠু বাজেট প্রণয়ন না হওয়ার কারণে রংপুর অঞ্চলের মানুষের কর্মসংস্থান ও জীবনযাত্রার মান পিছিয়ে পড়ছে দেশের অন্যান্য স্থানের চেয়ে। রংপুর, গাইবান্ধা, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, নীলফামারী, ঠাকুরগাঁও বঞ্চিত হয় কাঙ্ক্ষিত আকাঙ্ক্ষা থেকে। জিনিসপত্রের দাম বেশি এবং আয়-উপার্জনের কোনো পথ না থাকায় এ সময়টি নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত গোষ্ঠীর জীবনে অনিশ্চয়তা এখনো প্রকট। উত্তরাঞ্চলের প্রায় সাড়ে ৩ কোটি মানুষের মধ্যে প্রায় ২ কোটি মানুষই দারিদ্র্যের মধ্যে বাস করে।
পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী উত্তরাঞ্চলের রংপুর বিভাগের প্রায় ৯০ লাখ মানুষ নদীভাঙন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও অভাবের কারণে ভূমিহীন। এ অঞ্চলের ৯৫ শতাংশ মানুষ গ্রামে বাস করে। এর মধ্যে ৫৫ শতাংশ খেতমজুর, ২৭ শতাংশ শ্রমিক, ১০ শতাংশ প্রান্তিক কৃষক, ৬ শতাংশ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও ২ শতাংশ অন্যান্য পেশার সঙ্গে যুক্ত।
লোকসানের বোঝা মাথায় নিয়ে কয়েকটি চিনিকল চালু থাকলে বিগত সরকার তা বন্ধ করে দিয়েছে। নীলফামারীতে উত্তরা ইপিজেড ছাড়া এ অঞ্চলে শিল্প বলতে তেমন কিছু নেই বলেই চলে। ফলে কৃষির ওপর নির্ভর করে গড়ে উঠেছে এখানকার অর্থনীতি। নদীভাঙন, প্রাকৃতিক দুর্যোগে কৃষিতে লোকসান ইত্যাদি কারণে অনেক কৃষক তাদের জমিজমা হারিয়ে দিনমজুরে পরিণত হয়েছেন। প্রতি বছরই এ সংখ্যা বাড়ছে। এ থেকে পরিত্রাণের কোনো কার্যকরী পদক্ষেপ দেখা যায় না জাতীয় বাজেটে। ১৯৯৮ সালের ২৩ জুন আমাদের দেশে যোগাযোগের ক্ষেত্রে যুগান্তকারী পরিবর্তন এনে দেয় যমুনা সেতু। এ সেতুটি উদ্বোধনের পর উত্পাদিত কৃষিপণ্য ঢাকায় এনে বিক্রি করা এবং মানুষের যাতায়াতসুবিধা তৈরি হয়। কিন্তু এর বাইরে যমুনা সেতু এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নয়নে যে অবদান রাখতে পারত, তা হচ্ছে না। যোগাযোগের অগ্রগতি হলেও রংপুর অঞ্চলে বিনিয়োগে আগ্রহ বাড়েনি উদ্যোক্তাদের। বাইরে থেকে কোনো শিল্পউদ্যোক্তাই এই অঞ্চলে শিল্প স্থাপনে আগ্রহী হচ্ছেন না। অন্যদিকে আশানুরূপ বাড়ছে না কর্মসংস্থান। প্রতি বছরই বেকারত্বের সংখ্যা বাড়ছে। সারা দেশে ৫ হাজারের ওপর গার্মেন্টস শিল্প রয়েছে কিন্তু এ শিল্পে রংপুরের কোনো ভূমিকা নেই। দেশের প্রায় ১ হাজার ২০০ টেক্সটাইল মিলের মধ্যে দুটির অবস্থান এ অঞ্চলে। একটি দিনাজপুরে অন্যটি কুড়িগ্রামে। এগুলো এখন বন্ধ। অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা ও গ্যাস না থাকার কারণে এই অঞ্চলে বিনিয়োগে উত্সাহ পাচ্ছেন না উদ্যোক্তারা। বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আগ্রহ সৃষ্টি করতে হলে অঞ্চলভিত্তিক ও গণতান্ত্রিক বাজেট প্রণয়ন ও কৃষিভিত্তিক শিল্প গড়ে তোলার বিকল্প নেই।
কৃষি সেক্টর রংপুর বিভাগের উন্নয়নবঞ্চিত মানুষের ভাগ্যের উন্নয়নে জাতীয় বাজেট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। যেহেতু এটা কৃষিনির্ভর এলাকা। কৃষি সেক্টরকেই প্রাধান্য দিতে হলে কৃষিনির্ভর শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা অপরিহার্য। গত কয়েক বছর থেকে এ অঞ্চলের কৃষকরা আলু উত্পাদন করে দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন। কিন্তু সুষ্ঠু নীতিমালা ও সংরক্ষণের অভাবে অনেক সময ধান, আলুসহ অন্যান্য ফসলের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হতে হয় চাষিদের। আলুর বহুবিধ ব্যবহারে এ অঞ্চলে আলুভিত্তিক বিভিন্ন শিল্পকারখানা গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবি। শিল্পপতিরা আলুর চিপস্সহ অন্যান্য পণ্য উত্পাদন করে এ অঞ্চলে স্থায়ী কর্মসংস্থানে সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারেন। তবে জাতীয় বাজেট প্রণয়নের মাধ্যমে শিল্পউদ্যোক্তাদের এ বিষয়ে এগিয়ে আসার উদ্যোগটি নিতে হবে বাজেট প্রণেতাদের। এছাড়াও এ অঞ্চলের উত্পাদিত শাকসবজি, তরিতরকারি স্থানীয় পর্যায়ে চাহিদা মিটিয়েও দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করা হয়। দেখা গেছে শাকসবজির ভরা মৌসুমে একটি সিন্ডিকেট স্বল্পমূল্যে এসব শাকসবজি ক্রয় করে অন্য স্থানে নিয়ে গিয়ে বেশি দামে বিক্রি করছে। অথচ যারা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে এসব উত্পাদন করছেন, সেই কৃষকরা ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। অথচ এ অঞ্চলে শাকসবজি প্রক্রিয়াজাত ও সংরক্ষণের জন্য কোনো সংরক্ষণাগার নেই। অথচ এ দাবির প্রতি কোনো সরকারই গুরুত্ব দেয় না। এসব পণ্যের সংরক্ষণের জন্য সংরক্ষণাগার স্থাপন করতে পারলে কৃষকরা যেমন তাদের উত্পাদিত পণ্যের সঠিক মূল্য পেতেন, তেমনি আঞ্চলিক অর্থনীতির চাকাও সচল থাকত। তবে এ অঞ্চলে শিল্পায়নের প্রধান অন্তরায় গ্যাস সরবরাহ। আঞ্চলিক বৈষম্যের কারণে বগুড়া পর্যন্ত গ্যাস এসে থেমে গেছে। রংপুর পর্যন্ত দ্রুত গ্যাসের সরবরাহ দেওয়া হলে শিল্পপতিরা এ অঞ্চলে শিল্পকারখানা গড়ে তুলতে আগ্রহী হয়ে উঠবেন, এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়।
দেখা গেছে, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) জাতীয় বাজেটের গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ। এডিপির বণ্টনের ক্ষেত্রে জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি। অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে এই অঞ্চলকে বরাদ্দ প্রদানের ক্ষেত্রে চরম বৈষম্যের শিকার হতে হয়েছে। এছাড়া প্রকল্পের অর্থ ছাড়ে বিলম্ব, স্থানীয় সরকারের অন্তর্ভুক্ত না করা। সঠিক মনিটরিং ব্যবস্থা ইত্যাদি না থাকার কারণে এসব প্রকল্প সঠিক ও সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়িত হয়নি। এসব প্রকল্প মাঠপর্যায়ে আঞ্চলিক ভিত্তিতে প্রণয়ন করা হলে যেমন এলাকার উন্নয়ন হতো, তেমনি দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ভাগ্যের বদলে সহায়ক হতো।
লক্ষ করা গেছে, এই অঞ্চলে উল্লেখযোগ্য অংশ মা চরম পুষ্টিহীনতার মধ্যেই তাদের সন্তান জন্ম দেন। রংপুর বিভাগের মানুষকে দেশের উন্নয়নের মূলধারায় সংযুক্ত করতে হলে চলতি বাজেটে আঞ্চলিক বৈষম্য দূর করতে হবে এবং অঞ্চলভিক্তিক বাজেট প্রণয়ন করতে হবে। এ লক্ষ্যে রংপুরে কৃষিভিত্তিক ইন্ডাস্ট্রি, আলু সংরক্ষণের সরকারি হিমাগার স্থাপন, দ্রুত পাইপ লাইনের মাধ্যমে গ্যাস সরবরাহ, নীলফামারীর সৈয়দপুরে উত্তরা ইপিজেডসহ অন্যান্য শিল্পনগরীকে আধুনিকায়ন করা জরুরি হয়ে পড়েছে। এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করতে হলে আঞ্চলিক বাজেট প্রণয়নের বিকল্প নেই।
লেখক : কবি ও সাংবাদিক