বিশ্বে যে ধরনের নৈরাজ্যকর অবস্থা বিরাজ করছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়ে এমনটা আর কখনো দেখা যায়নি। এই সময়ের মধ্যে দুই পরাশক্তির মধ্যে পরমাণু অস্ত্র অর্জনের পর ঠান্ডা যুদ্ধকালে কয়েকটি বড় ঘটনাকে কেন্দ্র করে অস্থিরতা বাড়লেও পরমাণু অস্ত্রই দিন শেষে সব অস্থিরতার ক্ষেত্রে একধরনের নিবারকের ভূমিকা পালন করেছিল। সময় যত গড়িয়েছে, পরমাণু অস্ত্রের বিস্তার ঘটেছে, বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধরনের বৈশ্বিক বাস্তবতায় রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে মেরুকেন্দ্রিকতা, এর জের ধরে বিভিন্ন আঞ্চলিক শক্তির উদ্ভব, শক্তির প্রতিযোগিতা কেন্দ্র থেকে আঞ্চলিক তথা প্রত্যন্তে ছড়িয়ে পড়া, সেই সঙ্গে এমন কিছু দেশের পরমাণু অস্ত্রধারী হয়ে ওঠা—এ সবকিছুই বিশ্বকে একটা জায়গা থেকে; অর্থাৎ জাতিসংঘের সনদের অধীনে পরিচালনা করা বেশ কঠিন করে তোলে।
প্রথমে যুক্তরাষ্ট্র এবং তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যকার এ ধরনের শক্তির প্রতিযোগিতার লাগাম টানতে তাদের নিজেদের মধ্যকার কৌশলগত অস্ত্র হ্রাসকরণ চুক্তি, কৌশলগত অস্ত্র সীমিতকরণ চুক্তি, পরমাণু অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তিসহ নানা ধরনের আলোচনা বিদ্যমান থাকলেও বিভিন্ন অঞ্চলকেন্দ্রিক শক্তির উত্থান, বড় শক্তিধর দেশদ্বয়ের পক্ষ থেকে তাদের সহায়তায় নানা কৌশল অবলম্বন একপর্যায়ে একটা নিয়ন্ত্রণহীন পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। আর এর রেশ ধরে বিংশ শতাব্দীর শেষ সময়ে যুক্তরাষ্ট্র-সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যকার শক্তির প্রতিযোগিতায় প্রথমে কিউবার ক্ষেপণাস্ত্রসংকট, পরে ভিয়েতনাম যুদ্ধ এবং ইরাক-ইরান যুদ্ধের মতো বিষয়গুলোর সমাধান করা গেলেও, আরব-ইসরাইল যুদ্ধ এবং সোভিয়েত দখল থেকে আফগানিস্তানকে মুক্ত করতে গিয়ে পরবর্তীকালে একটি প্রলম্বিত সংকটে রূপ দেয়।

সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর রাশিয়ার নেতৃত্বের সংকট এবং ভঙ্গুর অর্থনীতির ফলে কার্যত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে একটি এককেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থা সৃষ্টি হয়। এই সময়ের মধ্যে বিশ্বরাজনীতিতে একচেটিয়া প্রভাবকের ভূমিকা পালন করতে থাকে। সারা দুনিয়াব্যাপী মার্কিন ঘাঁটিগুলো অপ্রতিরোধ্য থাকে এবং যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ, সেই সঙ্গে অস্ট্রেলিয়া, জাপানের মতো পুঁজিবাদী দেশগুলোর সঙ্গে স্বার্থের সুসম্পর্ক বিশ্বব্যবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের কর্তৃত্বকে আরো সুসংহত করে। তবে বিশ্ব ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, একটা নির্দিষ্ট সময় পর শক্তির জায়গায় পরিবর্তন আসে, যার ধারাবাহিকতায় প্রথম এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়ে আমরা আজকের বিশ্বকে দেখতে পাই।
আজকের এই বিশ্ব একটি সম্পূর্ণ অন্যরকম বিশ্ব; এটিকে এখন আর এককেন্দ্রিক, দ্বিকেন্দ্রিক বা ত্রিকেন্দ্রিক—স্পষ্ট করে এর কোনোটাই বলার সুযোগ নেই। মার্কিন সামরিক ঘাঁটিগুলো এখন আর অপ্রতিরোধ্য থেকে বিশ্বের যে কোনো জায়গায় তাদের সক্ষমতা দেখানোর ক্ষমতা রাখে না। মার্কিন সামরিক ব্যয় মেটাতে গিয়ে আজ তাদের অর্থনীতি হিমশিম খাচ্ছে।
অন্যদিকে অর্থনীতিতে চীনের ক্রম উত্থান এবং তথাকথিত সাম্যবাদের খোলস থেকে বের হয়ে চৈনিক পুঁজিবাদ এবং সেই সঙ্গে প্রযুক্তির বিকাশ বিশ্ব অর্থনীতির জন্য এক মূর্তিমান আতঙ্ক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এককথায় বলা যায়, এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের একক সিদ্ধান্ত এখন আর কার্যকর নয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের পূর্ব ইউরোপমুখী বিস্তার রোধ এবং সেই সঙ্গে ইউরোপের নিরাপত্তা নিশ্চিতের স্বার্থে ১৯৪৯ সালে ন্যাটোর মতো সামরিক জোটকে ১৯৫৫ সালে সোভিয়েত নেতৃত্বাধীন ওয়ারশ জোট চ্যালেঞ্জ করলেও সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর মার্কিন শক্তিমত্তার জায়গায় ন্যাটো এক বাড়তি মাত্রা যুক্ত করে। এই ন্যাটোকে সঙ্গী করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বব্যাপী তাদের সামরিক অপারেশনগুলো পরিচালনা করতে থাকে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তন আসতে থাকে অনেক ক্ষেত্রে।
ন্যাটোকে এখন আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের জন্য অপরিহার্য মনে করে না, যেমন করে না ইউরোপকে। সাম্প্রতিক সময়ে মার্কিন রাজনীতি পর্যালোচনা করলে যে দিকটি স্পষ্ট হয়, তা হলো—এই মুহূর্তে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একমাত্র নির্ভরযোগ্য সঙ্গী হচ্ছে ইসরাইল। আর তাই ন্যাটোর ইউক্রেনমুখী বিস্তার যখন রাশিয়ার জন্য দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল, সেই উদ্বেগ থেকেই ইউক্রেন যুদ্ধের সূচনায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ সমর্থনে এবং ইউরোপের সহায়তায় ইউক্রেনের পক্ষ থেকেও প্রতিরোধ গড়ে তোলা হলেও এখন এই যুদ্ধকে একটি অর্থহীন যুদ্ধ মনে করছে যুক্তরাষ্ট্র।
রাশিয়ার হাত থেকে ইউক্রেনকে রক্ষা করা ইউরোপের জন্য যতটা জরুরি, যুক্তরাষ্ট্র নিজেদের স্বার্থে এটাকে এতটা গুরুত্ব দিতে চাইছে না। উপরন্তু, ন্যাটোর পরিচালনায় ইউরোপীয় দেশগুলো আর্থিকভাবে অনেক বেশি যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীল—এটা মানতে পারছেন না ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি সাম্প্রতিক সময়ে ইউরোপীয় দেশগুলোকে তাদের জিডিপির কমপক্ষে ৫ শতাংশ ন্যাটোর পরিচালনা ব্যয় বাবদ দিতে বলেছেন, অন্যথায় যুক্তরাষ্ট্রকে ন্যাটো থেকে বের করে নেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন।
ন্যাটো ও ইউক্রেনকে কেন্দ্র করে ইউরোপের সঙ্গে যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এমন দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে, ইউরোপ এমন অবস্থায় উপলব্ধি করতে পারছে যে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তাদের প্রায় ৮০ বছরের নিবিড় সম্পর্কের হয়তো আপাতত অবসান হতে চলেছে। যুক্তরাষ্ট্রকে বাদ দিয়ে নিজেদের নিরাপত্তাকৌশল বিনির্মাণে এখন তারা নতুন করে মনোযোগী হচ্ছে। একই সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্য নিয়েও ধীর গতিতে তাদের অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। গত বেশ কিছুদিন ধরে কয়েকটি ইউরোপীয় দেশ ফিলিস্তিন সমস্যা সমাধানে আগে গৃহীত দ্বিরাষ্ট্রতত্ত্বকে সামনে রেখে ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়ার পরিকল্পনা করছে। বিষয়টি নিয়ে গাজাসংকটের শুরু থেকেই তারা সরব ছিল এবং ইসরাইলের হামলাকে তারা বরাবরই বিরোধিতা করেছে।
এ পর্যন্ত বেশ কয়েক বার গাজায় যুদ্ধবিরতির জন্য জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে চেষ্টা করা হয়েছে, যেখানে ইউরোপ থেকে দুই স্থায়ী সদস্য—যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সসহ অন্য দুই দেশ রাশিয়া ও চীন সমর্থন দিলেও যুক্তরাষ্ট্র সমর্থন দেওয়া থেকে বিরত থেকেছে। তবে আন্তর্জাতিক চাপে গত বছরের মার্চ মাসে নিরাপত্তা পরিষদে এ-সংক্রান্ত একটি সর্বসম্মত প্রস্তাব পাশ হওয়ার পর ধারণা করা হয়েছিল যে ইসরাইল নিবৃত্ত হবে এবং গাজা সংকটের অবসান হবে।
সবাইকে অবাক করে ইসরাইল তাদের হামলা অব্যাহত রাখে, যেখানে যুক্তরাষ্ট্র সমর্থন করে যায়। সেই সঙ্গে ইসরাইলের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সহায়তাও অব্যাহত থাকে। গাজায় ইসরাইল কর্তৃক অভিযান আন্তর্জাতিকভাবে মানবাধিকার পরিপন্থি এবং গণহত্যা হিসেবে ঘোষিত হওয়ার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হলেও তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে ভালো বন্ধু হিসেবে বহাল রয়েছেন।
জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো ইসরাইলের এই যুদ্ধাপরাধের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাই নিতে পারেনি, যেমন পারেনি ইরানের ওপর ইসরাইলের হামলার বিষয়েও। নিরাপত্তা পরিষদের এক স্থায়ী দেশ হওয়া সত্ত্বেও ইসরাইলের হামলার পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন এবং ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় বোমাবর্ষণ আন্তর্জাতিক আইনের মান্যতাকে গভীর সংকটের মধ্যে ফেলেছে। এখন এটাই একটা স্বাভাবিক রীতিতে পরিণত হয়েছে যে, আন্তর্জাতিক আইন আর তার স্বাভাবিক রীতিতে চলে না; বরং তা ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলো দ্বারা নিয়ন্ত্রিত—একই বিষয় রাশিয়ার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য হওয়া সত্ত্বেও তারা ইউক্রেনের বিরুদ্ধে আগ্রাসী হয়েছে।
গাজা নিয়ে ট্রাম্প-নেতানিয়াহুর পরিকল্পনা একটি স্থায়ী যুদ্ধবিরতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে। ট্রাম্পের দায়িত্ব গ্রহণের ছয় মাসের মধ্যে নেতানিয়াহু তৃতীয় বারের মতো যুক্তরাষ্ট্র সফর করলেন। যখন একটি স্থায়ী যুদ্ধবিরতি নিয়ে আলোচনা চলছে এবং এটি কেবল স্বাক্ষরের অপেক্ষা, এই সফরের মধ্য দিয়ে যুদ্ধবিরতির সম্ভাবনাটি আরো অনিশ্চিত হয়ে পড়ল! নেতানিয়াহুর হামাস নির্মূলের দাবি কার্যত তার গাজা খালি করার পরিকল্পনা, যেখানে ট্রাম্প তার সমর্থনের দিকটিকে পরোক্ষভাবে ইঙ্গিত করেছেন।
ইসরাইলের ভবিষ্যৎ-মুখী পরিকল্পনায় রয়েছে নিজেদের রাষ্ট্রকে আরো বিস্তৃত করা, যা মধ্যপ্রাচ্যে তাদের একচেটিয়া আধিপত্যকে নিশ্চিত করবে। যুক্তরাষ্ট্রও বিষয়টিকে নিজেদের স্বার্থের আলোকেই ভাবছে। আর তাই ইরান নিয়ে অনিশ্চয়তা এখনো কাটেনি। তাদের পরমাণু অস্ত্রধারী দেশ হওয়া থেকে বিরত রাখার নামে ইরানকে দুর্বল করতে যা করার দরকার, তা করতে কোনো ধরনের দ্বিধা করবেন না যুক্তরাষ্ট্র-ইসরাইল। একদিকে ইউক্রেন, অন্যদিকে গাজা আর ইরান, আর এশিয়ায় চীনের স্বার্থে উত্তর কোরিয়ার সদা-প্রস্তুতি—এসব কিছু বিবেচনা করলে বর্তমানে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো কেবল আলংকারিক ভূমিকায় অবতীর্ণ, যা বৈশ্বিক শাসনকাঠামো ভেঙে পড়ার ইঙ্গিত দিচ্ছে।
লেখক : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
(এই লেখা লেখকের একান্ত ব্যক্তিগত অভিমত; এ সংক্রান্ত কোনো দায় দৈনিক মূলধারা বহন করবে না।)