বর্ষার স্যাঁতসেঁতে গুমোট পরিবেশের পর বাংলাদেশের প্রকৃতিতে শরৎ আসে বিপুল সমারোহে। ঘষা কাচের মতো মেঘলা আকাশ সরে গিয়ে সেখানে গাঢ় নীলের আলপনা জেগে ওঠে। নদীতীরের অপরূপ কাশফুলের শুভ্র দোলা আমাদের হৃদয়কেও দুলিয়ে দেয়। সোনালি আলো ঝরে পড়ে মাঠেঘাটে। ধানগাছের কচি শিষে সেই আলোর ঝিলিক, প্রভাতবেলা শিউলির পসরা— সব মিলে বাংলার প্রকৃতি যেন নিজেই উৎসবমুখর হয়ে ওঠে। প্রকৃতির বুক জুড়ে যেন এক স্বতঃস্ফূর্ত আবেশ ছড়িয়ে পড়ে। ঋতু চক্রের এই অনন্য সৌন্দর্য কেবল চর্মচক্ষুর আনন্দ নয়; বরং এটা সনাতন বাঙালির অন্তরেও বাজিয়ে তোলে দেবী দুর্গার আগমনি সুর। যদিও জলবায়ু পরিবর্তনের ছোঁয়া বাংলার প্রকৃতিতেও লেগেছে। শরতেও যেন বর্ষা ফুরিয়েও ফুরায় না। তার পরও দুর্গাপূজার মাহাত্ম্য কেবল প্রকৃতির সঙ্গে যুক্ত নয়, এটা সনাতন বাঙালি সমাজের প্রাণস্পন্দন-তুল্য।
দেবী দুর্গা পৌরাণিক অর্থে অসুরবিনাশিনী— তিনি দমন করেন অশুভশক্তি, রক্ষা করেন শুভদীপ্তি। সনাতন শাস্ত্রকথায় আমরা দেখি, দেবতারা যখন অসুরের দম্ভে পরাজিত, তখন সবাই সম্মিলিত শক্তি দিয়ে একত্র হয়ে আহ্বান করলেন দেবীশক্তিকে। সেই মিলিত তেজরশ্মি থেকেই আবির্ভূত হলেন মহাশক্তি দুর্গা। অর্থাৎ, ঐক্যের দ্বারা উদ্ভাসিত হয়েছে অজেয় শক্তি। এই কাহিনি কেবল পুরাণের পাতা নয়, আধুনিক জীবনেরও এক দর্পণ। সমাজে যখন বিভাজন, অহংকার, লোভ ও হিংসা বিস্তার লাভ করে, তখনই প্রয়োজন হয় শুভশক্তির সম্মিলন। তারাই পারে অশুভের পরাভব ঘটাতে। সনাতন বাঙালির দুর্গোৎসব তাই কেবল দেবী আরাধনার পূজা নয়, এটা এক মহাসম্মিলনের প্রতীক। সনাতন ধর্মাবলম্বীরা মনে করেন, তারা কেবল মহাশক্তি হিসেবেই দেবী দুর্গার পূজা করে না; বরং তাকে ‘ঘরের মেয়ে’ বলে বরণও করে।
ঘরের কোলেই যিনি জন্ম নেন, যিনি মায়ের রূপে সংসার চালান, তিনিই আবার মহাশক্তি দুর্গা— এই ভাবনার ভেতর নিহিত রয়েছে হিন্দু সমাজের অন্তর্গত এক মর্মস্পর্শী উপলব্ধি— অসুরবিনাশী শক্তি দূর স্বর্গলোকে নয়, তা আমাদের নিকটেই রয়েছে। রয়েছে আমাদের সংসারের অন্দরে, নারীশক্তির মধ্যেই। এসব দিক ছাপিয়ে দুর্গাপূজা কেবল আধ্যাত্মিকতায় নয়, সনাতনদের মধ্যে বিপুল আনন্দেরও স্ফুরণ ঘটায়। মণ্ডপসংলগ্ন পথভরা আলোকসজ্জা, গ্রামের উঠানে ঢাকের বাদ্য, সন্ধ্যার আরতিতে শঙ্খধ্বনি— সব মিলিয়ে দুর্গাপূজা বাঙালির হিন্দুজীবনে বয়ে আনে উৎসবের অপরূপ উল্লাস। এই উল্লাস কেবল আনন্দের ফল্গুধারা নয়; এটা সনাতন ধর্মাবলম্বীদের দান করে এক অশুভবিনাশের শক্তি। যতই দুঃখ, বিপর্যয়, অনিশ্চয়তা আসুক, উৎসব মানুষকে শেখায়— জীবন অমলিন, আশার আলো কখনো নিভে যায় না।
শাস্ত্র অনুযায়ী, এবারের দুর্গোৎসবে দেবী গজে আগমন করেছেন— যা সমৃদ্ধি ও ফলনের বার্তা বহন করে; কিন্তু গমন ঘটবে দোলায়, যা মড়ক বা বিপদের আশঙ্কা জাগায়। এই পূর্বাভাস যেন প্রতীকীরূপে আমাদের শিক্ষা দেয়— সাময়িক আনন্দ ও সমৃদ্ধির ভেতরেও লুকায়িত রয়েছে বিপদের আশঙ্কা। তাই কেবল বাহ্যিক উজ্জ্বলতায় বিভোর না হয়ে মানুষের উচিত অন্তরের শক্তিকে সঞ্জীবিত রাখা, ঐক্যের প্রদীপ প্রজ্বলিত রাখা। ঐক্যই প্রকৃত শক্তি। সমাজে যত অশুভই আসুক, সম্মিলিত ঐক্যবদ্ধ শুভশক্তিই পারে তাকে প্রতিহত করতে। দম্ভ, লোভ, হিংসা কিংবা বিভাজন— এসবই আধুনিক যুগের আসুরিক রূপ।
মহাদশমীর এই পুণ্যক্ষণে আমরা তাই অনুধাবন করি— শুভশক্তির জাগরণই মানুষের আসল শক্তি। অসুরের বিনাশ মানে কেবল পুরাণের যুদ্ধ নয়, এটা জীবনের অশুভ প্রবণতাকে প্রতিহত করার চেতনা। আর এই চেতনাই দুর্গোৎসবকে সনাতন বাঙালির চিরকালীন আশার প্রতীক করে তুলেছে। সুতরাং, মানব অন্তরে যেন সদা জেগে থাকে শুভশক্তির দীপ্তি, সমাজে যেন বিরাজ করে ঐক্যের সমবেত আলো। ঐক্যই মানুষের মুক্তির পথ।
শুভশক্তির আরাধ্য দেবী হিসেবে শুভ হোক দশমীর এই বিজয়ক্ষণ। শুভ বিজয়া উপলক্ষ্যে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের জানাই আন্তরিক শুভেচ্ছা।