আগামী অর্থবছরের (২০২৫-২০২৬) জন্য প্রস্তাবিত বাজেট জাতীয় বাজেট প্রণয়নের কাজ বর্তমানে প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। সবকিছু ঠিক থাকলে ৫ জুন প্রস্তাবিত বাজেট উপদেষ্টা পরিষদে উপস্থাপন করা হতে পারে। যেহেতু বর্তমানে সংসদ কার্যকর নেই, তাই প্রস্তাবিত বাজেট উপদেষ্টা পরিষদে অনুমোদিত হবে। নানা কারণেই আগামী অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেট বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।
বর্তমানে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বপ্রাপ্ত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের এটাই প্রথম জাতীয় বাজেট। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য বাজেট প্রণয়ন করা সব সময়ই চ্যালেঞ্জিং। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে বাজেট প্রণয়নের ক্ষেত্রে আরো বেশি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। বাজেট প্রণয়নের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে প্রয়োজনীয় অর্থ সংকুলান করা। আমাদের দেশে বাজেট অর্থায়নের ক্ষেত্রে প্রধানত রাজস্ব আহরণের ওপর নির্ভর করতে হয়। কিন্তু বাংলাদেশে রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ খুব একটা উল্লেখযোগ্য নয়।
কয়েক বছর আগেও ট্যাক্স-জিডিপি রেশিও ১০ শতাংশের ওপরে ছিল। বর্তমানে ট্যাক্স-জিডিপি রেশিও ৭ দশমিক ৫০ শতাংশে নেমে এসেছে। বাংলাদেশে ট্যাক্স-জিডিপি রেশিও বিশ্বের সবচেয়ে কম ট্যাক্স আদায়কারী কয়েকটি দেশের মধ্যে অন্যতম এবং দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় সর্বনিম্ন। চলতি অর্থবছরের ৯ মাস অর্থাত্ মার্চ মাসে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত ছিল ৪২ হাজার ৯৩ কোটি ৪৩ লাখ টাকা। আর আদায় হয়েছে ৩৪ হাজার ৬৬৯ কোটি ৭৫ লাখ টাকা।
চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে (জুলাই-মার্চ) রাজস্ব আদায়ের সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩ লাখ ২২ হাজার ১৫২ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। কিন্তু বাস্তবে আদায় হয়েছে ২ লাখ ৫৬ হাজার ৪৮৬ কোটি ৮৪ লাখ টাকা। অর্থাত্ লক্ষ্যমাত্রার ৭৯ দশমিক ৬২ শতাংশ অর্জিত হয়েছে। রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ানো না গেলে বাজেট অর্থায়নের জন্য বিদেশি ঋণের ওপর নির্ভর করতে হয়।

বাজেট যেভাবেই প্রণীত হোক না, কোনো কোনো বছরই তা সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হয় না। বছরান্তে দেখা যায়, বরাদ্দকৃত অর্থ অব্যবহূত রয়ে গেছে। ন্যাশনাল বোর্ড অব রেভিনিউ (এনবিআর) রাজস্ব আহরণের পরিমাণ বাড়ানোর জন্য উদ্যোগ নিয়েছে। বর্তমানে দেশে ৪১টি করাঞ্চল রয়েছে। ভবিষ্যতে এর সঙ্গে আরো ৯টি করাঞ্চল যুক্ত করা হচ্ছে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে, কোনো বছরই এনবিআর রাজস্ব আহরণের নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারছে না।
প্রতি বছর বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির আওতায় বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য যে অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়, তার একটি বড় অংশই অব্যবহূত থেকে যায়। দেখা যায়, অর্থবছরের প্রথম সাত/আট মাসে হয়তো বরাদ্দকৃত অর্থের ৩০/৩৫ শতাংশ ব্যায়িত হচ্ছে। আর অর্থবছর শেষ হওয়ার দুই/তিন মাস আগে অর্থ ব্যয়ের পরিমাণ বা হার বৃদ্ধি পায়। এতে বাস্তবায়িত প্রকল্পের গুনগত মান নিশ্চিত করা সম্ভব হয় না। অর্থের অপচয় হয়। শেষ পর্যন্ত বছর শেষে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির জন্য বরাদ্দকৃত অর্থের হয়তো ৬০/৬৫ শতাংশ ব্যয় করা সম্ভব হয়।
মূল্যস্ফীতিকে কিছুটা কমিয়ে রাখার জন্য কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভর্তুকি প্রদানের ব্যবস্থা করতে হতে পারে। তবে ভর্তুকি প্রদানের ক্ষেত্রে উন্নয়ন সহযোগীদের আপত্তি থাকতে পারে। পাশাপাশি সাপ্লাই চেইন সঠিকভাবে কাজ করে কি না, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। সাপ্লাই চেইন সঠিকভাবে কাজ না করলে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে বলে মনে হয় না।
আগামী অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেট সম্ভবত সংকোচনমূলক হবে। সংকোচনমূলক বাজেট দিয়ে উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়, যদি সাপ্লাই চেইন ঠিকভাবে কাজ না করে। গত প্রায় তিন বছর ধরে অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৯ শতাংশের ওপরে রয়েছে। মূল্যস্ফীতির কশাঘাতে সব শ্রেণি-পেশার মানুষ বিপদে রয়েছে। আগামী বাজেটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি সর্বোচ্চ গুরুত্ব পাওয়ার দাবি রাখে।
বাজেট যেহেতু সার্বিক ম্যাক্রো ইকোনমিক ডকুমেন্ট, তাই ব্যাংকিং খাতের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। আমরা জানি, ব্যাংকিং সেক্টরে খেলাপি ঋণের মাত্রা ক্রমশ বেড়েই চলেছে। কোনোভাবেই খেলাপি ঋণের এই ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা রোধ করা যাচ্ছে না। মাঝখানে কোনো কোনো ব্যাংকের গ্রাহকদের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ উত্থাপিত হলে পুরো ব্যাংকিং ব্যবস্থায় অস্থিতিশীলতার সৃষ্টি হয়েছে। সাধারণ গ্রাহকগণ আতঙ্কিত হয়ে আমানত উত্তোলন করেছিল।
গত ৬ মাসে ব্যাংকিং ব্যবস্থায় আমানত ফিরেছে ২১ হাজার কোটি টাকা। গত বছর আগস্ট মাসে ব্যাংকের বাইরে থাকা অর্থের পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৯৪ হাজার ৪৩৪ কোটি টাকা। এ বছর ফেব্রুয়ারি মাসে ব্যাংকিং চ্যানেলের বাইরে থাকা টাকার পরিমাণ কমে দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৭১ হাজার ৪৯৫ কোটি টাকা। বিগত সরকার আমলে ব্যাংকিং সেক্টরে অনুসৃত বেশ কিছু আন্তর্জাতিক আইন পরিবর্তন করে ঋণখেলাপিদের সুবিধা দেওয়া হয়েছিল। কোনোভাবেই ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের কোনো রকম ছাড়া দেওয়া যাবে না। উন্নয়নের জন্য বিনিয়োগ দরকার। আর বিনিয়োগের জন্য সুস্থ ধারার ব্যাংকিং ব্যবস্থার কোনো বিকল্প নেই।
উন্নত দেশগুলোতে দীর্ঘমেয়াদি পুঁজির জন্য সাধারণত ক্যাপিটাল মার্কেটের ওপর নির্ভর করা হয়। ক্যাপিটাল মার্কেট থেকে পুঁজি সংগ্রহ করা হলে তা উদ্যোক্তাদের জন্য সুবিধাজনক হয়। কারণ ক্যাপিটাল মার্কেটে কোম্পানির শেয়ার ছেড়ে অর্থ সংগ্রহ করা হলে প্রকল্প বাস্তবায়নের পর মুনাফা অর্জন করলেই শুধু ডিভিডেন্ড দিতে হয়। কিন্তু ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ করলে প্রকল্প উত্পাদন শুরু করুক আর না-ই করুক, একটি নির্দিষ্ট সময় পর ব্যাংক ঋণের কিস্তি প্রদান কার্যক্রম শুরু করতে হয়। তাই উন্নত দেশগুলোর উদ্যোক্তারা সাধারণত ব্যাংক থেকে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ গ্রহণ না করে ক্যাপিটাল মার্কেট থেকে পুঁজি সংগ্রহ করে থাকেন। কিন্তু বাংলাদেশের ক্যাপিটাল মার্কেট এখনো সেভাবে বিকশিত হতে পারেনি। বিনিয়োগকারীদের আস্থা অর্জন করতে পারেনি।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ ব্রোকারেজ হাউজ-মালিকদের সংগঠন ডিবিএ তাদের এক অনুষ্ঠানে তথ্য প্রকাশ করেছে যে, গত ১৬ বছরে দেশের শেয়ার বাজার ৩৮ শতাংশ সংকুচিত হয়েছে। বর্ণিত সময়ে ১৩৪টি কোম্পানি শেয়ার বাজারে তালিকাভুক্ত হয়েছে। প্রাথমিক গণপ্রস্তাবেব (আইপিও) মাধ্যমে তারা বাজার থেকে ৯ হাজার কোটি টাকা মূলধন সংগ্রহ করেছে। এসব কোম্পানির মধ্যে ৪২টিই বর্তমানে ‘জেড ক্যাটাগরি’তে রয়েছে। বর্তমানে শেয়ার বাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির সংখ্যা ৩৬০টি। এর মধ্যে ‘জেড ক্যাটাগরি’তে রয়েছে ১০৩টি কোম্পানি। শেয়ার বাজার উন্নয়নের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন হলেও এক্ষেত্রে উদ্যোগের ঘাটতি রয়েছে।
ব্যাংকিং সেক্টর যদি উদ্যোক্তাদের পর্যাপ্ত পরিমাণ ঋণ দিতে না পারে তাহলে দেশে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ হবে না। তারা চাইলেও উদ্যোক্তাদের চাহিদামতো ঋণ দিতে পারবে না। বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশে প্রতি শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির জন্য ব্যক্তি খাতে অন্তত ৫ শতাংশ বিনিয়োগ হওয়া প্রয়োজন।
দেশে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগের হার অনেক দিন ধরেই জিডিপির ২২/২৩ শতাংশে ওঠানামা করছে। সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাকালে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ২৮ শতাংশ। কিন্তু তা অর্জিত হয়নি। চলতি অর্থবছরের বাজেটে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত রয়েছে ২৭ শতাংশ। এটা অর্জিত হওয়ার কোনোই সম্ভাবনা নেই। যদি ব্যক্তি খাতে কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় বিনিয়োগ না হয়, তাহলে কর্মসংস্থানের নতুন নতুন সুযোগ সৃষ্টি হবে না। ফলে দারিদ্র্য বিমোচন কার্যক্রম বিঘ্নিত হবে।
আগামী অর্থবছরের জন্য বাজেট প্রণীত হতে যাচ্ছে। তাতে রাজনৈতিক বিবেচনার পরিবর্তে বাস্তবতার নিরিখে প্রকল্প গ্রহণ করা হবে বলেই মনে হচ্ছে। কোনো বাস্তবায়নকারী সংস্থা যদি নির্দিষ্ট সময়ে প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যর্থ হয় এবং সে কারণে ব্যয় বৃদ্ধি পায়, তার দায়ভার সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকেই বহন করতে হবে। এ ক্ষেত্রে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের বিধান থাকা প্রয়োজন।
লেখক : বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও সর্বশেষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা
অনুলিখন : এম এ খালেক
(এই লেখার যাবতীয় দালভার লেখকের সম্পূর্ণ নিজের; এ সংক্রান্ত কোনো বিষয়ে দৈনিক মূলধারা কোনোভাবেই দায়ি নয়)