কারণে-অকারণে প্রতিদিনই বাড়ছে নিত্যপ্রয়োজনীয়সহ অন্যান্য পণ্যের দাম। কোনোভাবেই থামানো যাচ্ছে না দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির এই পাগলা ঘোড়া। আমরা যেন অসহায় হয়ে পড়েছি, জিম্মি হয়ে গেছি সিন্ডিকেটের হাতে। গুটিকয়েক সিন্ডিকেটের হাতে বন্দি দেশের ১৮ কোটি মানুষ। সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যের কারণে আমাদের মৌলিক অধিকার খাদ্য, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিত্সা, বাসস্থান, বিনোদন ব্যাহত হচ্ছে। সিন্ডিকেটের কাছে বারবার হেরে যাই বলেই কৃষক তার ফসলের ন্যায্যমূল্য না পেয়ে ঋণের বোঝা নিয়ে দুর্বিষহ জীবন যাপন করেন। বাংলাদেশে চলতি বছর নতুন করে ৩০ লাখ মানুষ অতি গরিব হবে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছে বিশ্বব্যাংক। এর পেছনের বড় একটি কারণ বাজার সিন্ডিকেট এবং বাজার অস্থিরতা। কোনোভাবেই বাজারকে নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। আমার মতো সাধারণ মানুষের প্রশ্ন বাজার নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে নাকি বাজার নিয়ন্ত্রণে আমরা শতভাগ আন্তরিক এবং উদ্যোগী নই। বিশ্বব্যাংকের এই আশঙ্কা যদি সত্যি হয়, তাহলে আমাদের বাজার অর্থনীতি এবং গতিশীল অর্থনীতির জন্য কঠিন সময় অপেক্ষা করছে।
যারা নিম্ন আয়ের মানুষ, তাদের এখন টিকে থাকতেই কষ্ট হচ্ছে। আর তার মধ্যে বাচ্চাদের লেখাপড়া আছে। একটা পূরণ হয় তো আরেকটায় টান পড়ে। অসুখ বিসুখ হলে তো রীতিমতো ভিক্ষা করতে হয়। ধারের ওপরে ধার। আবার কেউ কেউ ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ছেন। বিশ্লেষকরা বলছেন, সিন্ডিকেট ভাঙতে হলে সবার আগে সরকারকে আন্তরিক হতে হবে। এর জন্য দরকার রাজনৈতিক অঙ্গীকার। তবে এসব সিন্ডিকেটের সঙ্গে অনেক ক্ষেত্রে সরকারের নীতিনির্ধারকরাও জড়িত থাকায় তা কখনোই ভাঙা সম্ভব হচ্ছে না। এমনকি এ সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে শক্ত কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সম্ভব হয় না। মানুষের কল্যাণে কিছু করতে হলে এ সিন্ডিকেট ভাঙতে হবে। বিশেষ করে পরিবহন, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও নিত্যপণ্যের মতো অতি জরুরি খাতের সিন্ডিকেট ভাঙতে না পারলে মানুষকে স্বস্তি দেওয়া সম্ভব নয়।
সিন্ডিকেটের প্রভাবে বাড়ছে আত্মহত্যা, খুন, ধর্ষণ, নির্যাতন, শোষণ-বৈষম্য, পারিবারিক ভাঙন-কলহ, ঘুষ, দুর্নীতি, খেলাপি ঋণের পরিমাণ, চুরি-ছিনতাই- ডাকাতি, বিদেশে টাকা পাচার। বাড়ছে কিশোর গ্যাংয়ের মতো সামাজিক অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড। আমাদের সমাজে এমন কোনো অপরাধ নেই, যার সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সিন্ডিকেটের সম্পৃক্ততা নেই। কৃষকরা সিন্ডিকেটের কারণে উত্পাদিত পণ্যের সঠিক মূল্য বঞ্চিত হন এবং এতে প্রকৃত উত্পাদক লাভবান না হয়ে মধ্যস্বত্বভোগীরা লাভবান হয়, লাভবান হয় সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীরা। সিন্ডিকেট আমাদের অর্থনীতি, ন্যায্যতা ও নৈতিকতাকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। আমরা সিন্ডিকেটমুক্ত, ন্যায়ভিত্তিক ও জনবান্ধব সমাজ চাই, যেখানে প্রত্যেক মানুষের মৌলিক চাহিদার নিশ্চয়তা থাকবে এবং বিকশিত জীবনের নিশ্চয়তা থাকবে। প্রয়োজনীয় পণ্যের সংকট ও মূল্যবৃদ্ধির কারণে জনজীবনে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়, যা সামাজিক অস্থিরতায় রূপ নিতে পারে।
এইভাবে চলতে থাকলে আগামী প্রজন্মের জন্য আমরা রেখে যাব এক অনিশ্চিত ভবিষ্যত্। যেখানে মানবিক মর্যাদা হবে অপমানিত, ন্যায়বিচার হবে বিলাসিতা, আর মৌলিক অধিকার হবে কেবল বইয়ের পাতার শব্দ। এই সিন্ডিকেট ব্যবস্থাকে রুখতে না পারলে স্বাধীনতার স্বপ্ন কেবল ইতিহাসের পাতায় বন্দি হয়ে যাবে। আমরা যদি এখনই একজোট না হই, যদি এখনই সোচ্চার না হই, তবে দুর্ভোগ আরো গভীর হবে, সংকট আরো ঘনীভূত হবে। প্রয়োজন এখন সাহসী সিদ্ধান্ত, জনগণের ঐক্য এবং দৃঢ় সামাজিক আন্দোলন। এই দৈত্যাকার সিন্ডিকেট ভাঙতে হবে জনতার শক্তিতে, নীতির শক্তিতে এবং সুশাসনের অঙ্গীকারে। না হলে আমাদের কষ্ট, আমাদের স্বপ্ন, আমাদের স্বাধীনতা—সবই ধূলিসাত্ হয়ে যাবে ক্ষমতালোভী কয়েক জন মানুষের হাতে। এরা জনগণের স্বার্থের দিকে নজর দেয় না। এরা বাজার সন্ত্রাসী। কীভাবে অসত্ উপায় অবলম্বন করে দ্রুত ধনী হবে, এটাই তাদের প্রধান উদ্দেশ্য। ফলে তাদের কাছে দেশের অসহায় জনগণ জিম্মি হয়ে পড়ে। ক্ষেত্র বিশেষ সরকারও তাদের কাছে জিম্মি। বাজার নিয়ে অতীতে অনেক পদক্ষেপ ও পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে, প্রচুর লেখালেখি হয়েছে, আমরাও সম্পাদকীয় কলামে বহুবার লিখেছি, কিন্তু কোনো কাজ হয়নি।
এই অমানবিক শোষণের অবসান না হলে, এই বৈষম্যমূলক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সম্মিলিত প্রতিরোধ না গড়ে তুললে আমরা হারাব আমাদের মানবিকতা, আমাদের স্বাধীনতার স্বপ্ন, আমাদের ভবিষ্যত্। এখন সময় এসেছে জেগে ওঠার, সময় এসেছে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার, সময় এসেছে সিন্ডিকেটের দানবীয় শাসনের বিরুদ্ধে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলার। আমরা যদি এখনই রুখে না দাঁড়াই, তাহলে একদিন ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে না। আমরা মনে করি, বিক্রেতাদের মানসিকতার পরিবর্তন যতদিন না ঘটবে ততদিন নিত্যপণ্যের বাজার অস্থির থাকবেই এবং দেশের জনগণও তাদের কাছে জিম্মি থাকবে। দেশের উন্নয়ন হচ্ছে ভালো কথা, সেই উন্নয়নের সুফল যেন সাধারণ মানুষ ভোগ করতে পারে, সেদিকে সরকারকে বিশেষ নজর দিতে হবে। এজন্য দ্রুত বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, ভাঙতে হবে বাজার সিন্ডিকেট। সিন্ডিকেটমুক্ত হতে হলে সর্বাগ্রে প্রয়োজন আইনের কঠোর প্রয়োগ ও প্রশাসনের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা। বাজারে প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করা, ভোক্তাদের সচেতনতা বৃদ্ধি এবং গণমাধ্যমের সাহসী ভূমিকা অপরিহার্য। পাশাপাশি রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও সুশাসন ছাড়া সিন্ডিকেট দমন সম্ভব নয়। সিন্ডিকেট গঠনে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির বিধান করতে হবে। প্রয়োজনে আইনের সংস্কার করতে হবে। সরকার ও রাষ্ট্রকে সাহসী উদ্যোগ নেওয়ার পাশাপাশি বাস্তবায়নও করতে হবে। সিন্ডিকেটমুক্ত বাজারব্যবস্থা গঠনে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী যারা রাষ্ট্র এবং সরকারকে অসহযোগিতা করবে, তাদেরকেও আইনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। বাজারে নজরদারির জন্য বিশেষ ট্রাইব্যুনাল বা টাস্কফোর্স গঠন করা যেতে পারে। প্রশাসনের অভ্যন্তরে যারা সিন্ডিকেটকে আশ্রয় দেয়, তাদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিতে হবে।
দুর্নীতিমুক্ত ও জবাবদিহিমূলক প্রশাসন গড়ে তোলা সুশাসনের জন্য অপরিহার্য। সিন্ডিকেটের অপকর্ম জনসমক্ষে আনা, তথ্যপ্রমাণ প্রকাশ করা এবং জনমত গড়ে তোলার মাধ্যমে গণমাধ্যম শক্তিশালী ভূমিকা রাখতে পারে। সাধারণ মানুষকে সিন্ডিকেট সম্পর্কে সচেতন করতে গণমাধ্যম ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রচার চালানো জরুরি। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরকে আরো শক্তিশালী করতে হবে। নৈতিকতা, আইন, প্রশাসনিক স্বচ্ছতা ও গণসচেতনতার সমন্বয়েই একটি সিন্ডিকেটমুক্ত, ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গড়া সম্ভব।
লেখক : শিক্ষক।