নন্দিত কথাসাহিত্যিক ও নির্মাতা হুমায়ূন আহমেদের ত্রয়োদশ মৃত্যুবার্ষিকী ১৯ জুলাই ২০২৫। ২০১২ সালের এই দিনে লাখো ভক্তকে কাঁদিয়ে না ফেরার দেশে পাড়ি জমান হিমু কিংবা মিসির আলির এই স্রষ্টা। তার প্রথম উপন্যাস ‘নন্দিত নরকে’ এনে দেয় তার পরিচিতি। এরপর থেকে লিখেছেন তিন শতাধিক গ্রন্থ। লেখার জাদুকর হুমায়ূন আহমেদ একদিকে সাহিত্য দিয়ে মন্ত্রমুগ্ধ করেছেন পাঠককে, অন্যদিকে নির্মাণ করেছেন অনন্য সব নাটক, চলচ্চিত্র ও গান। তার হাত ধরেই তারকার সম্মান পেয়েছেন এ দেশের অনেক শিল্পী। তার অনন্য সৃষ্টিতে উঠে এসেছে নৈসর্গিক দৃশ্য, জোছনা, বৃষ্টিসহ বাংলার চিরচেনা প্রকৃতির ব্যঞ্জনা।
শৈশবের বালক হুমায়ূন আহমেদ যেমন ভালোবাসতেন গাছপালাশোভিত সবুজ অরণ্যানীর ভেতর ঘুরে বেড়াতে, বিটোভেনের সুরের মতন টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ শুনতে, তেমনি ৬০ বছরেও তার সবুজের ভেতর হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করত, ইচ্ছে করত বৃষ্টির শব্দের ভেতর নিজেকে লুকিয়ে ফেলতে। ইট কাঠের খাঁচায় বন্দি রাজধানী ঢাকা তার দম বন্ধ করে আনত। আর তাই তিনি গাজীপুরের শালবনের ভেতর তৈরি করেছিলেন এক বিশাল নন্দনকানন নুহাশ পল্লী। সাহিত্যের প্রতি, প্রকৃতির প্রতি নতুন প্রজন্মকে যেভাবে আকৃষ্ট করেছেন সাহিত্যে তা দুর্লভ।
হিমুর কাহিনিগুলো নিছক বিনোদনের জন্য নয়। ফাজলামির ফেনা সরালে নজরে পড়বে এক গাঢ় রসের পাক, তাতে এক দিকে নাগরিক সভ্যতার ভণ্ডামি নিয়ে চোরাবিদ্রুপ, আবার অন্তর্লীন বিষাদ, মায়াবাঁধনের তার কেটে বেরিয়ে আসার করুণ প্রয়াস, মায়াবী কল্পকাহিনি।
বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ এবং শরৎচন্দ্রকে বাদ দিলে যে বাংলাসাহিত্য নিয়ে আমরা গর্ব করি, তার সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখকের নাম হুমায়ূন আহমেদ। যার বই প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে হাজার হাজার কপি নিমেষেই শেষ হয়েছে। ১৯৯২ সালের একুশের বইমেলায় এক অনন্য সুন্দর দৃশ্য এখনো মানসপটে গেঁথে আছে। মেলায় ঢুকেই দেখি বিশাল লাইন। বই হাতে মানুষ দাঁড়িয়ে আছেন। ওরা হুমায়ূন আহমেদের বই কিনে দাঁড়িয়ে আছেন লেখকের অটোগ্রাফ নেওয়ার অপেক্ষায়! একজন লেখক কোন জনপ্রিয়তার শিখরে আরোহণ করলে এমন হয়, তা ভাবতেও অনাবিল এক আনন্দ! গল্প উপন্যাস নাটক গান চলচ্চিত্র নির্মাণ সব ক্ষেত্রে এমন জনপ্রিয় লেখক সত্যিই দুর্লভ।
লেখকের অমর সৃষ্টি এক চরিত্র হিমু। হিমুর ঘোরে থাকত তরুণ যুবারা। হিমুর আবেশে আবেশিত হয়ে ঘুরে ঘুরে বেড়াত দেশের হাজার হাজার তরুণ। থানায় বসে যে ওসি সাহেবকে জিগ্যেস করতে পারে, ‘দিনে ক’প্যাকেট বেনসন অ্যান্ড হেজেস খান?’ বান্ধবী রূপার বাড়ি রাতদুপুরে ফোন করে জানতে চায়, ‘আচ্ছা, এটা কি রেলওয়ে বুকিং?’ যাতে বান্ধবীর হাইপারটেনসিভ বাবা উত্তেজিত হয়ে চ্যাঁচামেচি জুড়ে দেন আর বান্ধবীটি বুঝে যায় কার ফোন এসেছে। প্রায় একুশটির মতো উপন্যাস এই একটি চরিত্রকে ঘিরে, এখনো এই চরিত্র বাংলা ভাষাভাষী সাহিত্যপ্রেমীদের কাছে সমান জনপ্রিয়। এপার-ওপার সব বাংলাতেই হইহই করে বিক্রি হয় এই বই। তা কি কেবল হাস্যরসের জোরে? হুমায়ূন নিজেও বলেছিলেন, ‘মনমেজাজ খারাপ থাকলেই হিমু লিখতে বসি। মন ঠিক হয়ে যায়।’
হিমুর কাহিনিগুলো নিছক বিনোদনের জন্য নয়। ফাজলামির ফেনা সরালে নজরে পড়বে এক গাঢ় রসের পাক, তাতে এক দিকে নাগরিক সভ্যতার ভণ্ডামি নিয়ে চোরাবিদ্রুপ, আবার অন্তর্লীন বিষাদ, মায়াবাঁধনের তার কেটে বেরিয়ে আসার করুণ প্রয়াস, মায়াবী কল্পকাহিনি। হিমু আসলে কে? তার নিজের ভাষায় ঢাকা শহরে সে একজন হণ্টক। চাকরি দিলেও সে করবে না, কারণ সে বেকার নয়, হাঁটা তার কাজ। মাসোহারা জুটে যায় এই শর্তে—সে তার ফুপার ছেলেকে বা ভালোমানুষ বড়লোক বন্ধুকে নিজের জীবনদর্শনে প্রভাবিত করবে না। কথা বলে লোককে বিভ্রান্ত করতে সে ওস্তাদ। সে নিঃস্বার্থ। নিরুদ্বেগ, কিছুটা নিস্পৃহ, কিন্তু সম্পূর্ণ নিরাসক্ত নয়। ভালোমন্দ খাবার ইচ্ছে হলে অবলীলাক্রমে কোনো বিয়েবাড়িতে ঢুকে যেতে পারে। বড়লোকের সুদর্শনা কন্যারা তার আকর্ষণে পড়ে যায়, হিমুর টেলিফোন-ব্যাধি জেগে ওঠে, সে এক প্লেটোনিক সম্পর্ক গড়ে তোলে, অথচ উদাসীন পুরুষ, কথা দিয়ে কথা রাখে না। তার সাইকোপ্যাথ বাবা হিমুকে মহাপুরুষ বানানোর গবেষণায় কী না করেছেন। পোষা টিয়াকেই শুধু নয়, তার মাকেও হত্যা করেছেন, যাতে আসক্তি না জন্মায়। পিশাচ প্রকৃতির মামাদের কাছে বড় হয়েছে হিমু, ক্রূরতা যেখানে স্বাভাবিক। তবু সে হলো এক নিস্পৃহ যুবক। মহাপুরুষ হওয়ার অনুশাসন তাকে পুরোপুরি বাঁধতে পারল না, সংসারের মায়াকেও সে সম্পূর্ণ স্বীকার করল না। অথচ পরিব্রাজক হিমু হয়ে গেল নাগরিক সন্তের মতো।
না, হিমু নীলু নয়। তবু দুই বাংলার দুই জনপ্রিয়তম লেখকের অতি জনপ্রিয় দুটো চরিত্র—হুমায়ূন আহমেদের হিমু আর নীললোহিতের (সুনীল গঙ্গোপধ্যায়) নীলু—তুলনা আসাটাই স্বাভাবিক। দুজনেই চালচুলোহীন রোমান্টিক যুবক, ভ্যাগাবন্ডের মতো ঘুরে বেড়াতে ভালোবাসে, আত্মীয়পরিজনের আদর-অনাদরের মাঝে যেন ভেসে বেড়ায়, তবু উদ্বাস্তু নয়। নীলুর আছে দিকশূন্যপুর। আর হিমুর আছে এক কল্পনদী ময়ূরাক্ষী। দিকশূন্যপুর আর ময়ূরাক্ষী—দুটোই বাস্তব থেকে হারিয়ে যাওয়ার ঠিকানা। তবু, নীলুর রোমান্টিকতা যেমন বায়বীয় কিশোরকল্পনা, হিমুর চরিত্রে নাগরিক বিষণ্নতা অনেক প্রবল, সামাজিক প্রেক্ষাপট অনেক প্রকট এবং বিদ্রুপবিদ্ধ। নীলু কখনো মহাপুরুষ হতে চায়নি, হিমু মহাপুরুষ হওয়ার দ্বন্দ্বে দীর্ণ। আর হিমুর আছে এক প্রফেটিক পাওয়ার। সে যা বলে তা অনেক সময়ই ফলে যায়। ফলত সে কিছুটা সমীহ আদায় করে নেয়। বিজ্ঞানের অধ্যাপক হুমায়ূন সম্ভবত সচেতনভাবেই এই ফ্যান্টাসিটা রচনা করেছেন, যাতে বাস্তব আর পরাবাস্তবের মধ্যে যাতায়াত করতে পারে কাহিনিটি।