বরাদ্দ ছিল ৫০ কোটি টাকা। কাজটা হয়ে গেছে বরাদ্দের অর্ধেকেরও কমে ২৪ কোটি ৯৮ লাখ ৯৫ হাজার টাকায়। এ নিয়ে ধন্য ধন্য করার আয়োজন নেই। সভা-সেমিনার, সম্ভাষণে ভরিয়ে দেওয়ার প্রচার-প্রসারের পর্বও নেই। মোটকথা মোটা দাগের কোনো ঘটনা বা নিউজলিস্টের আইটেম নয় এটি। সেনাবাহিনীর কর্মপ্রক্রিয়া ও শৃঙ্খলার ধরন এমনই। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর পর ২০২৪ সালের আগস্ট-সেপ্টেম্বর আক্রান্ত হয় দেশের দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলের ফেনী, নোয়াখালী, কুমিল্লা ও চট্টগ্রামের বেশ কিছু এলাকা। মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয় অসংখ্য ঘরবাড়ি। কোনোভাবে মাথা গোঁজার মতো অবশিষ্ট ঘরও থাকেনি কারো কারো।
কোনো হাঁকডাক বা মানবতার দৃষ্টান্তের প্রসেশন না করে অনেকটা নীরবে-স্বাভাবিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ৩০০টি পরিবারের জন্য বিশেষ আবাসন প্রকল্পের মাধ্যমে ঘর নির্মাণের জন্য সেনাবাহিনীকে বরাদ্দ দেওয়া হয় ৫০ কোটি টাকা। অ্যাসাইনমেন্টটি দেওয়া হয় সেনাবাহিনীর ২৪ ও ৩৩ ডিভিশনকে। তারা কোনো ঘটা প্রচার-প্রসার বা মিডিয়া কাভারেজের অপেক্ষা না করে ৪৯২ ও ৫০০ বর্গফুটের দুটি ডিজাইনে দ্রুত গতিতে শেষ করে কাজটি। ফেনীর ছয়টি উপজেলায় ১১০টি, নোয়াখালীর সাতটি উপজেলায় ৯০টি, কুমিল্লার ছয়টি উপজেলায় ৭০টি এবং চট্টগ্রামের তিনটি উপজেলার ৩০টিসহ মোট ৩০০টি ঘর কীভাবে তৈরি হলো, জানেন কেবল সংশ্লিষ্টরা। বরাদ্দের অর্ধেকেরও বেশি টাকা বাঁচল দেশের।
প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক, এত কম খরচে সেনাবাহিনী কাজটি করল কীভাবে? জাদুতে বা অন্য জগতের কাউকে এনে কাজ করে দিয়ে গেছে? ইট-বালু, রড-সিমেন্ট কি মাগনা বা অর্ধেক দামে মিলেছে? দেশে সচরাচর এ ধরনের কাজে দফায় দফায় বাজেট-বরাদ্দ বাড়ানোর ঘটনা বেশি। কাজ পরের বিষয়। কাজ না করে বা ঘর না বানিয়েও বিল তুলে নেওয়ার বহু দৃষ্টান্তের বিপরীতে সেনাবাহিনীর এ কর্মযজ্ঞের মধ্যে ভাবনার অনেক উপাদান আছে। রয়েছে বিশ্লেষণের বিষয়ও। এখানে অলৌকিকতার কিছু নেই। সেনাবাহিনীর কাজের ধরন তথা বৈশিষ্ট্যই এমন।
দুর্যোগ-দুর্বিপাকসহ বাংলাদেশে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে সেনাবাহিনী দায়িত্ব পালন করেছে। বিভিন্ন কাজে মাঠ প্রশাসনকে সহায়তাও করেছে। এখনো করছে। তাও ব্যাপক ক্ষমতা ম্যাজেস্ট্রিসি পাওয়ার নিয়ে। মাঠেও অনেক কিছু করার ক্ষমতা রয়েছে। সাধারণত দেশে জরুরি অবস্থার পরিস্থিতি ছাড়া সেনাবাহিনীর হাতে এই ক্ষমতা দেওয়া হয় না। প্রয়োজনে এবার দেওয়া হয়েছে। বিচারিক ক্ষমতা পাওয়ার পর কোনো ধরনের ব্যবস্থা নিতে সেনাবাহিনীকে প্রশাসনের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের জন্য অপেক্ষা করতে হয় না। অপরাধীদের সরাসরি গ্রেফতার করা যাবে। ছাড়াও যাবে। গ্রেফতারি পরোয়ানা কার্যকর করতে পুলিশকে নির্দেশও দিতে পারবেন দায়িত্বপ্রাপ্ত কমিশন্ড সেনা কর্মকর্তারা। বেআইনি সভা-সমাবেশ নিজেরা ছত্রভঙ্গ করে দিতে পারবে, এ কাজে বেসামরিক বাহিনীকেও ব্যবহার করতে পারবে সেনাবাহিনী।
এছাড়া স্থানীয় উপদ্রব নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন আদেশ জারি করতে পারবে, আটক করতে পারবে সন্দেহভাজন ব্যক্তিকেও। এমন এখতিয়ার দেওয়ার পরও বাস্তবে সেনাবাহিনী ম্যাজিস্ট্রেসি পাওয়ার তেমন এক্সেস করছে না। কোথাও বাড়তি বল প্রয়োগেও যাচ্ছে না। এর নেপথ্যে একদিকে পেশাদারিত্ব, আরেক দিকে বাস্তবতা বোধ। জনতার পালস উপলব্ধি। কিছু ক্ষেত্রে অন্য দেশের সেনাবাহিনীর সঙ্গে বাংলাদেশের সেনাবাহিনীকে মেলানো যাবে না। আরোপিত বা চাপিয়ে দেওয়া নয়, জনতার সঙ্গে সেতুবন্ধন দিয়েই এ দেশে সেনাবাহিনীর জন্ম। আর কোথাও সেনা-জনতার ক্যামেস্ট্রি বলবত্ থাকলে বাহিনীটির মেজাজ-বৈশিষ্ট্য অন্যরকম হওয়াই স্বাভাবিক। চব্বিশের গণআন্দোলন সেখানে আরেকটি মাত্রা যোগ করেছে। সেনাবাহিনী শেষতক আর কেবলই বাহিনী থাকেনি। জনতার অংশ হয়ে গেছে। একাত্তরে এ মন্ত্রের মধ্য দিয়েই বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর জন্ম। বাহিনীটির জাতির পরম আস্থা ও ভালোবাসার প্রতীক হয়ে ওঠার মূল রহস্য সেখানেই।
প্রশিক্ষণহীন জনতাকে সঙ্গে নিয়ে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠার সঙ্গে দেশ গঠনে তাদের যুক্ত থাকার আবশ্যকতা তাই জরুরি। ‘সমরে আমরা, শান্তিতে আমরা, সর্বত্র আমরা, দেশের তরে’ মন্ত্রটি সেনা সদস্যদের মনে আপনাআপনিই বাজে। দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব অক্ষুণ্ন রাখার পাশাপাশি তারা ছুটে যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন সেবামূলক ও উন্নয়ন কাজে। সমতল-পাহাড়-জল-জঙ্গল সবখানেই। তা প্রাকৃতিক বা মানবিক দুর্বিপাকে, বন্যার্তদের উদ্ধার ও ত্রাণকাজেও। পুনর্বাসনেও আন্তর্জাতিক শান্তি স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তা রক্ষায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যগণ তাদের আত্মত্যাগ, কর্তব্যনিষ্ঠা ও পেশাদারিত্বের মাধ্যমে বাংলাদেশের জন্য বয়ে এনেছে সম্মান ও গৌরব। আবার শান্তিরক্ষার কাজে সোমালিয়া-রুয়ান্ডা-উগান্ডায়ও। ঐসব দেশে মানুষকে শিক্ষাদান, কৃষিকাজ শেখানোর মতো কাজেও বাংলাদেশ সেনাবাহিনী রেকর্ড তৈরি করছে। যার সুবাদে বিশ্বশান্তির দূত হিসেবে বিশ্বের অনেক দেশে বাংলাদেশের পতাকা উড়ছে।
প্রচারে অভ্যস্ত না থাকায় নিজ দেশেও তাদের অনেক কাজই থেকে যাচ্ছে বেখবরে। সেনা সদস্যরা পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষা বা সম্প্রীতি রক্ষা নয়, অবকাঠামোগত যে পরিবর্তন এনেছে, তা গবেষণার বিষয়। সেনা সদস্যদের সুবাদে দেশের পার্বত্য অঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি নিজ চোখে না দেখলে বা ভিডিও ফুটেজ দেখে কারো বোধগম্য হওয়ার নয়। দেশের সর্বাধিক উচ্চতাবিশিষ্ট সড়ক থানচি-আলীকদম সড়ক, চিম্বুক-থানচি সড়ক, বাঙ্গালহালিয়া-রাজস্থলী সড়ক, বান্দরবান-বাঙ্গালহালিয়া-চন্দ্রঘোনা-ঘাগড়া সড়ক, খাগড়াছড়ি-দীঘিনালা-বাঘাইহাট সড়ক, দীঘিনালা-ছোটমেরুং-চঙ্গরাছড়ি-লংগদু সড়ক, বাঘাইছড়ি-মাসালং-সাজেক সড়ক এবং দীঘিনালা-মারিশ্যা সড়ক সেনাবাহিনী কর্তৃক নির্মাণ করার কারণে পাহাড়ি জনপদে কী পরিবর্তন এসেছে উন্নয়ন ও প্রাণের স্পন্দন। শিক্ষার হার বৃদ্ধি পেয়েছে, রাস্তা-ঘাটের উন্নতি উপাখ্যানের মতো। দুর্যোগ মোকাবিলায় বিশ্বের বুকে বাংলাদেশের মডেল হওয়ার পেছনে সেনাবাহিনীর সম্পৃক্ততা একটি দৃষ্টান্ত। পেশাগত দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগকবলিত অঞ্চলে আর্তমানবতার সেবায় জানমাল রক্ষায় সেনাবাহিনীর আন্তরিকতা ও দায়িত্ববোধ বিপন্ন মানুষের কাছে পরম প্রত্যাশিত।
বন্যার্তদের ঘর বানাতে বরাদ্দকৃত ৫০ কোটি টাকার অর্ধেকেরও বেশি ফেরত দেওয়া তাদের জন্য ঐ রকমই। এ নিয়ে ধন্য হওয়া বা সভা-সেমিনারে মিডিয়া কাভারেজে অভিষিক্ত হওয়ার প্রবণতার বাইরে তারা। জাতীয় পর্যায়ে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের নকশা থেকে কাজের শেষ পর্যন্ত প্রতিটি পর্যায়ে তাদের কাজের ধরন এমনই। এ কাজ কিন্তু বাইরে থেকে এসে কেউ করে দিয়ে যায় না। মালসামানা থেকে ম্যান-ম্যানু সব দেশেরই। সেখানে মূলমন্ত্র হচ্ছে পেশাদারিত্ব, সততা, নিষ্ঠা ও আন্তরিকতা। তদারকি থাকে ব্যাপক। পান থেকে চুন খসার ফাঁকই রাখা হয় না। সেনাদের মধ্যে কাজের গুণ ও কারিগরি মান রক্ষায় বিন্দুমাত্র আপস না করা অনেকটা মজ্জাগত বিষয় হয়ে উঠেছে। তাই কেবল কুমিল্লা-ফেনী-নোয়াখালী-চট্টগ্রামে বন্যার্তদের মধ্যে কয়েক শত ঘর বানিয়ে দেওয়া নয়, দেশের বড় বড় কাজ ও জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের কাজে সেনা সদস্যদের সম্পৃক্ততার আবশ্যকতা। বরাদ্দকৃত বাজেটের মধ্যে বা কমে এবং প্রাক্কলিত সময়ের আগেই কাজ শেষ করাও একটি বিষয়। যার এক পশলা খণ্ডচিত্র দেখল ফেনী, নোয়াখালী, কুমিল্লা ও চট্টগ্রামের কিছু এলাকার বন্যাদুর্গতরা।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট