বিশ্বে উষ্ণতা বৃদ্ধি এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সারা বিশ্বের আবহাওয়ার ব্যাপক পরিবর্তন আসছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বজ্রপাতের পরিবর্তন ও আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি বজ্রপাত ঘটে থাকে কঙ্গো ও ভেনিজুয়েলাতে। আবহাওয়াবিদদের মতে বহু আগে থেকেই বাংলাদেশ বজ্রপাতের ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল হিসেবে বিবেচিত ছিল। বর্তমানে বজ্রপাতে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয় বাংলাদেশে।
সেফ দ্য সোসাইটি অ্যান্ড থান্ডারস্টর্ম অ্যাওয়ারনেস ফোরামের তথ্য অনুযায়ী, ২৮ এপ্রিল এক দিনেই বাংলাদেশে বজ্রপাতে নিহত হয়েছে ১৭ জন মানুষ। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০১০ সালে যখন ৬৫৮টি অথচ ২০১৫ সালে ১২৯৫টি বজ্রপাত সংঘটিত হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সারা বিশ্বে যেমন বজ্রপাতের সংখ্যা ৫০ ভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে। যেখানে বাংলাদেশে বৃদ্ধি পেয়েছে দ্বিগুণেরও বেশি এবং উপকূলীয় এলাকায় এর মাত্রা কয়েক গুণ বেশি। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বজ্রপাতে দুর্ঘটনায় বহিরাঙ্গনে কর্মরত শ্রমিকগণের দুর্ঘটনার শিকার সবচেয়ে বেশি; যেমন—কৃষিকাজে নিয়োজিত শ্রমিকগণের সম্ভাবনা শতকরা ৩৪ ভাগ, ছাদে শতকরা ১৫ ভাগ, নির্মাণকাজে শতকরা ১১ ভাগ।
বর্ষা মৌসুমে সাধারণত ঝড়-বাদলের সঙ্গে বজ্রপাত ঘটে থাকে। আকাশে পানির কণা যখন উড়তে থাকে, তখন বরফকণাসৃষ্ট ঘর্ষণের ফলে প্রত্যেক সময়ে বিদ্যুৎ জমা হয়। যখন বৃহত্ আকারে মেঘ জমা হয়, তখন বড় আকারে বিদ্যুত্ জমা হয়। তড়িতায়িত দুইটি মেঘমালার মধ্যে যখন সংঘর্ষ হয়, তখন শব্দ সহকারে আলোর সৃষ্টি হয়, যাকে আমরা বজ্রপাত বলি। প্রচুর পরিমাণ বিদ্যুত্শক্তিসম্পন্ন মেঘ তখন নিজেদের মধ্যে বিদ্যুত্ নিঃসারণ করে থাকে। আবার মেঘমালা পৃথিবীর ভূপৃষ্ঠের সঙ্গে নিঃসারণ করে থাকে। মেঘমালার নিচের দিকে ঋণাত্মক চার্জ এবং পৃথিবীর পৃষ্ঠের ধনাত্মক চার্জের মধ্যে সংযোগ সৃষ্টি হয়, তখন ভূপৃষ্ঠে বজ্রপাত ঘটে। এ ধরনের বজ্রপাত গড়ে ৩০ হাজার অ্যাম্পস, ১৫ কুলম্ব এবং ৫০০ মেগা জুলস শক্তি উৎপন্ন করে এবং প্রায় ১০০ মিলিয়ন ভোল্ট উৎপন্ন করে।
বজ্রপাতে সাগরতীরে বালুতে প্রায় ১ হাজার ৮০০ সেন্টিমিটার তাপমাত্রা উত্পন্ন করে থাকে। অনেক ক্ষেত্রে বালু সিলিকা জেলে রূপান্তরিত হয়ে থাকে। বজ্রপাতের সময় ভূমির বহুলাংশ জুড়ে বিদ্যুতায়িত হয়ে পড়ে। যার জন্য বজ্রপাতে মৃত্যুর চেয়ে আহতের সংখ্যা বেশি হয়। আহত ব্যক্তিগণের প্রায় শতকরা ৯০ ভাগ পরবর্তী সময় স্নায়ুরোগে ভোগে। এতে গবাদি পশুরও মৃত্যু ঘটে। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, সরাসরি বজ্রপাতের কারণে মৃত্যুর সংখ্যা মাত্র শতকরা ৩-৫ ভাগ। ভূমি বিদ্যুতায়িত মৃত্যুর সংখ্যা শতকরা ৩০-৩৫ ভাগ, ঊর্ধ্বমুখী স্টির্মারের কারণে ১০-১৫ ভাগ। যার জন্য বজ্রপাত সংঘটিত এলাকার ভূমি বিদ্যুতায়িতের কারণে মৃত্যু/আহতের সংখ্যা অত্যধিক।
শহরাঞ্চলে আধুনিক ইমারত ভবনে বজ্রনিরোধক বিদ্যমান থাকার কথা। তবে, অনেক ইমারত ভবনে বজ্রনিরোধক পর্যাপ্ত আছে কি না এবং কার্যকর আছে কি না, তা পরীক্ষা করা প্রয়োজন। ছাদে বজ্রপাত প্রতিরোধ রডের সংখ্যা, অর্থাৎ লাইটনিং প্রোটেকশন জোন কভার করে কি না। যথাযথ ভূমির আর্থিং (Earthing/grounding)-এর ব্যবস্থা ভূমির সঙ্গে সংযোগ আছে কি না। আর্থিং প্রতিরোধ (Resistence) অবশ্যই তিন ওহমের নিচে হওয়া বাঞ্ছনীয়। টাওয়ার ইমারত ভবনের ক্ষেত্রে ছাদে প্রতিরোধব্যবস্থা করলে, মধ্যবর্তী স্থানে Mesh/Ring থাকা বাঞ্ছনীয়। কারণ ছাদে বজ্রপাত না পড়ে, অনেক সময় টাওয়ার ভবনের মধ্যবর্তী স্থানে তির্যকভাবে বজ্রপাত ঘটতে পারে। অভ্যন্তরীণ ওয়্যারিংয়ের ক্ষেত্রে, অর্থাৎ ECC (Earth Continuity Conductor) থাকা অপরিহার্য। নিরাপত্তার স্বার্থে কোনোভাবে আর্থিং (Earthing)-এর কাজে অবহেলা করা উচিত নয়। রাস্তায় চলমান গাড়ি বজ্রপাতে সম্ভাবনা অনেক কম। কারণ গাড়িতে টায়ার থাকাতে অনেক নিরাপদ। গাড়ির বডিতে মেটালিক থাকাতে, দরজা-জানালা বন্ধ থাকাতে ভ্রাম্যমাণ ফ্যারাডে কেজ (Mobile Faraday Cage)-এর কাজ করে।
বহিরাঙ্গনে কর্মরতরা বজ্রপাতের অধিকতর ঝুঁকিতে অবস্থান করেন। যার জন্য বহিরাঙ্গনে নিয়োজিত কর্মচারীদের নিরাপত্তার জন্য প্রত্যেকটি কর্মস্থলে জরুরি কর্মপরিকল্পনা থাকা বাঞ্ছনীয়; যেমন—(ক) সুপারভাইজারগণ আকাশের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে পারেন। বজ্রপাতে আলো দেখা বা শব্দ শোনার সঙ্গে সঙ্গে সতর্কতা গ্রহণ করতে পারেন। (খ) মাঠে কর্মরত শ্রমিকগণকে মাইকিং/বেলের মাধ্যমে নিরাপদ সময়ের আগে সতর্ক করা যেতে পারে। যাতে প্রত্যেক শ্রমিক নিরাপদ স্থানে অবস্থান করতে পারেন। (গ) আগে থেকে নিরাপদ স্থান চিহ্নিতকরণ এবং অবহিতকরণ খুবই জরুরি। এক্ষেত্রে, দরজা ও জানালা বন্ধ যে কোনো মেটালিক যানবাহন, বজ্রনিরোধক ব্যবস্থাসংবলিত ইমারত ভবন, নিম্নভূমি, খাদ, গন্দ, গর্ত এবং সম-উচ্চতার গাছে আশ্রয় নেওয়া অনেকটা নিরাপদ।
বাংলাদেশে সাধারণত বর্ষা মৌসুমে ঝড়-বাদলের সময় বজ্রপাত হয়ে থাকে। তথাপি কিছু বিষয় সতর্ক হলে বহুলাংশে দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব; যেমন—প্রত্যেক সকালে আবহাওয়ার বার্তা পর্যবেক্ষণ করা। যখনই দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া থাকে, তাহলে ঘনঘন পর্যবেক্ষণ করা।
বজ্রনিরোধক ব্যবস্থা-সংবলিত আধুনিক ভবনের অভ্যন্তরে বজ্রপাতের সময় যতটুকু সম্ভব, মেঝেতে খালি পায়ে না দাঁড়ানো। কংক্রিটের দেওয়ালে হেলান না দেওয়া, প্লাম্বিং পাইপ, ধাতব বস্তু স্পর্শ না করা। ঝরনা ছেড়ে গোসল না করা। কডলেস ফোন ও বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার না করা অধিকতর নিরাপদ।
বহিরাঙ্গনে হঠাৎ বজ্রপাতের মধ্যে পড়ে গেলে, অর্থাত্ আগে থেকে কোনো নিরাপদ স্থান না থাকলে, প্রতিরোধ-ব্যবস্থাবিহীন কোনো উচ্চ স্থানে আশ্রয় গ্রহণ না করা। কোনো উঁচু অবস্থানের পাশে অবস্থান না করা (কারণ উঁচু অবস্থানে বজ্রপাত বেশি ঘটে)। উঁচু গাছের নিচে, পাহাড়ের চূড়ায়, বৈদ্যুতিক খুঁটি টাওয়ারের নিচে, টেলিফোন টাওয়ার, ভারী যন্ত্রপাতির নিচে না থাকা নিরাপদ। ছাদে ও উন্মুক্ত স্থানে না থাকা নিরাপদ। কোনোভাবেই মাঠে শুয়ে পড়া যাবে না। পানি ও ধাতব বস্তু থেকে দূরে থাকা, বৈদ্যুতিক ওয়্যারিং, ফেন্সিং ও প্লাম্বিংয়ের কাজ না করা। তবে শেড, প্যাভিলিয়ন অস্থায়ী শেডে আশ্রয় গ্রহণ না করা।
বজ্রপাতের বিদ্যুতায়িত অবস্থানের মধ্যে পড়ে গেলে; অর্থাৎ মাথার চুল দাঁড়িয়ে গেলে দ্রুত সর্তকতা ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। প্রয়োজনে গাম বুট পরতে হবে। মাথায় হেলমেট খুলতে হবে। দু পা একসঙ্গে রাখতে হবে। বাস্কেটবল খেলোয়াড়দের মতো মাথা নিচু করে দুই হাত দিয়ে কান চেপে ধরে নিকটতম নিরাপদ স্থানের দিকে যাওয়াটা নিরাপদ। বর্ষাকালে গবাদি পশু তড়িৎ নিরোধক; যেমন—কাঠ, রবারের ওপর রাখা অধিক নিরাপদ।
বাংলাদেশে বর্তমানে ইলেকট্রিক মিড়িয়া গুরুত্ব সহকারে যত দ্রুত আবহাওয়া বার্তা প্রচার করে, যার কারণে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বহুলাংশে হ্রাস পাওয়ার কথা। তবে বজ্রপাতের সতর্কতা/বুলেটিন প্রচার করা হয় না। বজ্রপাতের ভয়াবহতা সম্পর্কে মাঠ পর্যায়ের শ্রমিকগণ, বিশেষ করে কৃষক ভীষণভাবে উদাসীন। লক্ষণীয় যে, ঝড়-বাদলের সময় অধিকাংশই বড় গাছের নিচে আশ্রয় নেন; যা অধিকতর বিপজ্জনক। মানুষ গাছের চেয়ে ভালো বিদ্যুত্পরিবাহক বলে গাছ থেকে মানুষের মধ্য দিয়ে ভূমিতে যায়। আর মানুষের মৃত্যু ঘটে। যার জন্য জনসচেতনতামূলক অনুষ্ঠান অপরিহার্য। বজ্রপাতে আহত রোগীকে নিঃসন্দেহে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া প্রয়োজন। এক্ষেত্রে সংশয়ের কোনো অবকাশ নেই। বিদ্যুতায়িত দ্বারা আহত রোগীর শরীরে পরবর্তী কোনো চার্জ/জীবাণু থাকে না। বজ্রপাতে আহত রোগী সাধারণত হৃদযন্ত্রের প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়। এক্ষেত্রে প্রাথমিক চিকিৎসা হিসেবে হূদ্যন্ত্রের প্রক্রিয়া চালুকরণের প্রাথমিক চিকিৎসা দিতে হবে।
মনে রাখতে হবে, বজ্রপাত অপ্রতিরোধ্য। মেঘলা আকাশ থেকে বজ্রপাত কোথায় আঘাত হানবে, তাও নিশ্চিত নয়। যার জন্য পূর্বাভাস পাওয়া মাত্র নিরাপদ স্থানে থাকা বাঞ্ছনীয়।
লেখক : প্রকৌশলী