এ গ্রহের কল্যাণে বৈশ্বিক জনসচেতনতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে জাতিসংঘের আওতায় ১৯৭০ সাল থেকে প্রতি বছর ২২ এপ্রিল আন্তর্জাতিক ধরিত্রী দিবস পালন করা হয়। মানবজাতির অর্থনৈতিক, সামাজিক ও পরিবেশগত চাহিদার মধ্যে ন্যায্য ভারসাম্য অর্জন এবং গ্রহটির গুরুত্ব ও বাস্তুতন্ত্র সংরক্ষণার্থে চলতি বছরের প্রতিপাদ্য হচ্ছে, ‘আমাদের শক্তি, আমাদের গ্রহ’।
সৌরজগতের একমাত্র পৃথিবীতেই জীবন আছে, আছে মানববসতি। প্রাকৃতিক গতিময়তায় পরিচালনাধীন ভূমণ্ডল, জলমণ্ডল, বায়ুমণ্ডল ও জীবজগত্ সমন্বয়ে এর বাসযোগ্যতা। প্রতি ফোঁটা পানি, প্রতি অণু অক্সিজেন, প্রতি গ্রাস খাবার সবই দেয় প্রকৃতি। ধারণামতে খ্রিষ্টীয় প্রথম বছরে পৃথিবীর জনসংখ্যা ১৭-৩০ কোটির মতো ছিল, ২০২২ সালে যা ৮০০ কোটি হয়েছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে মানুষের বাঁচার মৌলিক উপাদানের চাহিদা বেড়েছে, শিল্পবিপ্লব পরবর্তীকালে চাহিদা বৃদ্ধি ছাড়াও ক্ষেত্রসমূহ দ্রুততায় সম্প্রসারিত হচ্ছে। এ বাড়তি ও অতিরিক্ত চাহিদা মেটাতে মানুষ প্রকৃতিতে অদৃষ্টপূর্ব হস্তক্ষেপ করছে। এ বিষয়গুলোর কিছু অতি সংক্ষেপে নিচে আলোচনা করা হলো।
কার্বন ডাইঅক্সাইড ও অন্যান্য গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসারণের কারণে পৃথিবীর উষ্ণতা বাড়ছে। উষ্ণতা হ্রাসকল্পে তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রাখতে (২০২৪ সালে এ সীমা অতিক্রান্ত হয়েছে) জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার থেকে সরে আসার জোরালো দাবি উঠেছে, বিকল্প ও নবায়নযোগ্য জ্বালানির খোঁজ চলছে বিশ্বব্যাপী। চীনাদের এক বিস্ময়কর পরিকল্পনার কথা শোনা যাচ্ছে, ১৫০ টনের বেশি পে-লোড ক্ষমতার ভারী রকেটের সাহায্যে যন্ত্রাংশ মহাকাশে প্রেরণ ও সংযোজন করে এক কিলোমিটার প্রস্থের একটি স্পেস সোলার পাওয়ার যন্ত্র মহাকাশে স্থাপন করা হবে। মহাকাশে দিনরাতের ব্যাপার না থাকায় সব সময়ই সৌরশক্তি আহরণ সম্ভব হবে এবং মাইক্রোওয়েভে রূপান্তরের পর শক্তি পৃথিবীর সংগ্রাহক স্টেশনে প্রেরণ করা হবে।
যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশসমূহও মহাকাশ-ভিত্তিক সৌরশক্তি উৎপাদনের লক্ষ্যে কাজ করছে। তাই পরবর্তী বিশ বছরে নবায়নযোগ্য জ্বালানি হিসেবে মহাকাশ থেকে পৃথিবীতে সোলার শক্তি প্রেরণ অনেকটা নিশ্চিত। ব্যাপারটি জটিল ও চ্যালেঞ্জিংও বটে; এর পরিণতি দেখতে বিশ্ববাসীকে আরো অনেক দিন অপেক্ষা করতে হবে।
ভূপৃষ্ঠে সৌরবিকিরণ পৌঁছানোর পরিমাণ কমিয়ে গ্রহকে শীতল রাখার লক্ষ্যে সৌর জিয়োইঞ্জিনিয়ারিং পদ্ধতি প্রয়োগের কথাও উঠেছে। কাগজপত্রে ব্যাপারটা সম্ভাবনাময় সমাধান মনে হলেও বৈজ্ঞানিক আলোচনায় বিভেদজনক এবং অর্থবহ জলবায়ু কাজে হুমকি হিসেবে মনে করা হচ্ছে। তবে মোদ্দা কথা হলো এগুলোর ভূপ্রাকৃতিক-রাজনৈতিক পরিণতি সম্বন্ধে আমরা এখনও ভালোভাবে জানি না।
‘নেচার জিওসাইন্স, ২০২৫’ নিবন্ধ জানাচ্ছে, ১৯৬০-এর দশক থেকে অস্থিতিশীল সেচ ও খরার কারণে পৃথিবীর অন্যতম বৃহত্ জলাভূমি মধ্য এশিয়ার আরল সাগরের (আয়তন ৭০ হাজার বর্গকিলোমিটার থেকে ১ হাজার বর্গকিলোমিটারে সংকুচিত হয়েছে) পানি প্রায় শূন্যতার প্রভাবে পৃথিবীর ভূত্বক ও ঊর্ধ্বস্থ ম্যান্টেলের প্রতিক্ষিপ্তের সূত্রপাত হয়েছে। এটাই সম্ভবত মানবীয় কর্মকাণ্ডের উদাহরণ, যা গ্রহের অভ্যন্তরের গভীরতম কঠিন অংশে প্রভাব ফেলেছে। “আর্থ’স ফিউচার” (মার্চ ২০২৫)-এর নিবন্ধ অনুযায়ী বায়ুমণ্ডলের ক্রমবর্ধমান উষ্ণ ও শুষ্ক আবহাওয়াজনিত বাষ্পীভবনের ফলে বিশ্বব্যাপী মাটি প্রচুর পরিমাণে আর্দ্রতা হারাচ্ছে, ফলে কৃষি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
অনেক ক্ষেত্রে স্থানীয়দের মতামত ও আইনকে উপেক্ষা করে অপরিকল্পিত ও অনিয়ন্ত্রিত বালি উত্তোলনের প্রবণতা দেখা যায়; ফলে পরিবেশ, অর্থনীতি, সমাজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এতে নদীতীর ক্ষয়, প্লাবনভূমি বিলুপ্তি, পানিস্তরের ওঠা-নামা, উপকূলভাগে পলির ঘাটতি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষার ক্ষমতা হ্রাস, বসতির বিলুপ্তি ইত্যাদি নেতিবাচক প্রভাব বিশ্বব্যাপী লক্ষণীয়।
এছাড়া পৃথিবীর জনসংখ্যার এক বড় অংশ নগরবাসী, বাস করে কংক্রিট বনে। পৃথিবীর ৪০ শতাংশ ভূমি কৃষিকাজে ব্যবহূত হয়, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ভূমির অবক্ষয় ঘটছে। খাদ্যচাহিদা ৫০ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে ২০৫০ সালের মধ্যে। বিশ্বের প্রায় পনেরো শতাংশ কৃষিভূমি বিষাক্ত ধাতুতে দূষিত, ৯০-১৪০ কোটি মানুষ উচ্চ ঝুঁকি অঞ্চলে বাস করছে (দি গার্ডিয়ান, ১৭ এপ্রিল ২০২৫)।
মানবীয় কর্মকাণ্ড, এমনকি গ্রহ সম্বন্ধীয় প্রক্রিয়ায় প্রভাব ফেলছে। ‘জিয়োফিজিক্যাল রিসার্চ লেটারস্’-এ প্রকাশিত এক নতুন গবেষণায় বলা হয়েছে যে, গত বিশ বছরের কম সময়ে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন পৃথিবীর অক্ষকে প্রায় ৮০ সেমি সরাতে সক্ষম হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ সংস্থা নাসার এক পর্যবেক্ষণ জানাচ্ছে, চীনের থ্রি-গর্জেজ বাঁধের ৪০ বিলিয়ন ঘনমিটার ধারণক্ষমতার জলাধার পৃথিবীর ভর পুনঃবণ্টন করাতে পৃথিবীর ঘূর্ণনকে ০.০৬ সেকেন্ড হ্রাস করেছে। এটার চেয়ে তিন গুণ বড় আরেকটি বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা করেছে তারা।
উপকূল অঞ্চলের ম্যানগ্রোভ বন সাইক্লোন থেকে রক্ষা, কার্বন মজুত, মত্স্য ও কাঠ সরবরাহে এবং এর ইকোসিস্টেম জীববৈচিত্র্যে ও অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখে। জলবায়ুর অত্যধিক পরিবর্তনজনিত সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি ও শক্তিশালী ঝড় ম্যানগ্রোভ বনের ইকোসিস্টেমে ব্যাপক পরিবর্তন আনবে। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সুন্দরবন পৃথিবীর অন্যতম বৃহত্ ম্যানগ্রোভ বন, যা দেশের আর্থসামাজিক, পরিবেশের উন্নয়নে ও দুর্যোগের ক্ষতি হ্রাসে অবদান রাখছে।
সমুদ্রের চার থেকে ছয় কিলোমিটার গভীরের তলদেশের নিকেল, কপার, কোবাল্ট ও ম্যাংগানিজসমৃদ্ধ নডিউল আহরণের কথা শোনা যাচ্ছে, যদিও বর্তমান পরিকল্পনার বিরোধিতাও হচ্ছে নানা মহল থেকে। পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে সমুদ্রের গভীরের ইকোসিস্টেমে অপরিবর্তনীয় ক্ষতি ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হবে।
যোগাযোগ, আবহাওয়া, ভূসম্পদসংক্রান্ত হাজারো কৃত্রিম উপগ্রহ মহাকাশে প্রদক্ষিণরত আছে। কোনোটা কার্যক্ষম, কোনোটা অবসরে, কোনোটা ভেঙে পরিণত হয়েছে জঞ্জালে—পরিমাণ দ্রুততায় বাড়ছে। সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী সংখ্যায় ১০ সেন্টিমিটারের চেয়ে বড়গুলো ৫০ হাজারের বেশি, এক সেন্টিমিটারের চেয়ে বড়গুলো ১.২ মিলিয়নেরও বেশি এবং অসংখ্য ক্ষুদ্রতর টুকরো প্রাণঘাতী গতিতে ঘুরছে। মহাকাশ জঞ্জালগুলো ক্ষতিকর, এমনকি কার্যক্ষম উপগ্রহের জন্য হুমকির কারণ।
বৈশ্বিক উষ্ণায়নজনিত জলবায়ু পরিবর্তন নানাভাবে পৃথিবীতে প্রভাব ফেলছে—বরফ গলন, সমুদ্রের পানস্ফীিতি, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, উপকূল অঞ্চল নিমজ্জন, মৃত্তিকার আর্দ্রতার অবক্ষয়, লবণাক্ত পানির অনুপ্রবেশ, প্রাকৃতিক দুর্যোগের পৌনঃপুনিকতাসহ তীব্রতা বৃদ্ধি, স্বাস্থ্যঝুঁকি অন্যতম। বিশ্বব্যাপী গত ৫০ বছরে বন্যপ্রাণীর সংখ্যা প্রায় ৬৯ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। জাতিসংঘের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী শিকার, মত্স্য আহরণ, আবাসন ধ্বংস, দূষণ, খাদ্যপ্রাপ্তিতে ব্যাঘাত এবং জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে জীববৈচিত্র্য হুমকিতে পড়েছে। মানুষের অস্তিত্বের জন্য জীববৈচিত্র্যের গুরুত্ব অপরিসীম।
পৃথিবীব্যাপী প্লাস্টিকের অবাধ বিচরণ এখন সর্বত্র। ব্রাজিলের গবেষকগণ প্লাস্টিকের মিশেলে নতুন এক শিলার সন্ধান পেয়েছেন, তাপে-চাপে পলল দানাসহ অন্যান্য ধ্বংসাবশেষ প্লাস্টিকের বাঁধনে যা সৃষ্ট; নাম তাই ‘প্লাস্টিগ্লোমেরেটস’। মানবীয় কর্মকাণ্ড প্রাকৃতিক প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত বা নিয়ন্ত্রণের জোরালো প্রমাণ এটি। আরো উদ্বেগজনক হলো মানবশরীরের রক্ত, মস্তিষ্ক, নানা অঙ্গ ও মাতৃজঠরের ভ্রুণে প্লাস্টিকের উপস্থিতি। ভবিষ্যতে মানুষের ডিএনএ-তে ন্যানোপ্লাস্টিকের অনুপ্রবেশ ও রূপান্তরের কিছু ঘটলে বিস্ময়কর হবে না।
আলোচনান্তে মনে হতে পারে, এসব কর্মকাণ্ডে বাংলাদেশের মানুষের সংশ্লিষ্টতা নেই, শুধু উন্নত বিশ্ব দায়ী। যদিও বৈশ্বিক উষ্ণায়নে আমাদের অবদান অতি নগণ্য, দেশের ভেতরে নিজ স্বার্থে আমরা প্রকৃতিবিরোধী কাজ করছি।
বায়ু-পানি-মাটি প্রতিনিয়ত দূষণ, নদীদূষণ-দখল, প্লাস্টিকের যথেচ্ছ ব্যবহার, বন ধ্বংস ও বাস্তুতন্ত্রের ক্ষতি, পাহাড় কাটা, অনিয়ন্ত্রিতভাবে বালু তোলা, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, কংক্রিটের আবরণ বৃদ্ধিতে ভূগর্ভে পানি প্রবেশে বাধা প্রদান ও জলাবদ্ধতা সৃষ্টি করছি, যার অনেকগুলোই অপরিবর্তনীয় হওয়ায় প্রকৃতির স্থায়ী ক্ষতি হচ্ছে।
দেশে দ্রুতহারে নগরায়ণ হলেও যথাযথ বর্জ্য ব্যবস্থাপনা না থাকায় আগুনে পোড়ানোর প্রবণতা বায়ুদূষণকে চরমে তুলেছে। ঢাকার বায়ুদূষণে উন্মুক্ত স্থানে বর্জ্য পোড়ানোর অবদান ১১ শতাংশ। কাজেই প্লাস্টিক ব্যবহারসহ অন্যায্য কাজগুলো আমাদের পরিহার করা অতিব জরুরি।নিজেদের অভিলাষ মেটাতে গিয়ে মানুষ জীবজগত্সহ পুরো গ্রহটিকেই অস্তিত্বসংকটে ফেলেছে। ভূতাত্ত্বিক সময়াবলির দৃষ্ট প্রমাণাদি বলছে পৃথিবীর অতীত-প্রক্রিয়াসমূহ প্রাকৃতিকভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়েছে। বর্তমানে প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় মানবীয় কর্মকাণ্ড অংশগ্রহণ, কোথাও নিয়ন্ত্রণ করছে। আশঙ্কা হচ্ছে মানুষের সীমাহীন চাহিদা ও উচ্চাকাঙ্ক্ষা মেটাতে গিয়ে পৃথিবী নামের গ্রহটি অন্যরূপ পরিগ্রহ করে কি না।
লেখক : ভূতত্ত্ববিদ ও গবেষক