বাংলাদেশে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রোপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন (পিআর) বা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতি চালুর প্রস্তাব নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে তুমুল আলোচনা-সমালোচনা চলছে। কেউ বলছেন, এটি ন্যায্য ও অন্তর্ভুক্তিমূলক ভোটব্যবস্থা; আবার কেউ বলছেন—এটি গণতন্ত্রের কবর রচনার আরেকটি কৌশল। আসুন, এর বাস্তবতা আমরা একটু গভীরভাবে দেখি।
পিআর পদ্ধতির মূল কথা কী? এই পদ্ধতিতে জনগণ সরাসরি প্রার্থীকে ভোট দেন না। বরং দলকে ভোট দেন। দল যেসব প্রার্থী তালিকাভুক্ত করবে, দলীয়ভাবে প্রাপ্ত ভোট অনুযায়ী সেই তালিকা থেকেই এমপি নির্বাচিত হবেন। সুতরাং, একজন জনপ্রিয় নেতা নির্বাচিত হবেন কি না, তা নির্ভর করবে দলপ্রধানের ইচ্ছার ওপর—জনগণের মতের ওপর নয়।
কেন এই পদ্ধতি নিয়ে শঙ্কা? পিআর পদ্ধতির সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হলো, এতে জনগণের সঙ্গে সাংসদের সরাসরি সম্পর্ক থাকে না। সংসদ সদস্যদের জবাবদিহি থাকে দলীয় প্রধানের কাছে, জনগণের কাছে নয়। একজন জনপ্রিয়, জনভিত্তিসম্পন্ন, মাঠপর্যায়ের কর্মী দলপ্রধানের মনোভাবে তালিকা থেকেই বাদ পড়তে পারেন। আবার আত্মীয়, তোষামোদকারী, এমনকি বিতর্কিত ব্যক্তিরাও এমপি হয়ে যেতে পারেন শুধু তাদের ‘তালিকায় থাকার’ সুবাদে। এতে স্থানীয় সমস্যা ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে সাংসদদের দায়বদ্ধতা ও সক্রিয়তা কমে যাবে।
নেদারল্যান্ডস, ইসরাইল, সুইডেন, নরওয়ে, ডেনমার্ক, সুইজারল্যান্ড, ফিনল্যান্ড, পোল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকাসহ বেশ কিছু উন্নত দেশ এই পদ্ধতি অনুসরণ করে। তবে এসব দেশের রাজনৈতিক পরিপক্বতা, গণতান্ত্রিক মানসিকতা ও প্রশাসনিক দক্ষতা বাংলাদেশের মতো নয়
তাহলে কি বর্তমান পদ্ধতিই শ্রেষ্ঠ? না, বর্তমান পদ্ধতিতেও দুর্নীতি, টাকার প্রভাব, প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ ইত্যাদি সমস্যা আছে। তবে এখানে ভোটারদের একটি ‘বাছাইয়ের’ সুযোগ আছে। একজন প্রার্থী ভালো না লাগলে তাকে প্রত্যাখ্যান করা যায়। পক্ষান্তরে, পিআর পদ্ধতিতে ভোটার শুধু দলকে ভোট দেন, প্রার্থীর চরিত্র, দক্ষতা বা মাঠে জনপ্রিয়তা কোনো ব্যাপারই নয়।
অবশ্য পিআর পদ্ধতির কিছু সুবিধাও আছে; যেমন—এতে ছোট দলগুলোর প্রতিনিধিত্ব পাওয়ার সুযোগ তৈরি হয়। ভোটের অপচয় কমে, যে দল হারলেও, তার ভোট কিছু আসন এনে দেয়। এতে বৈচিত্র্যময় রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে ওঠে। নারী, সংখ্যালঘু বা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ সহজ হয়। সহানুভূতিশীল রাজনীতি ও জোট সরকার তৈরির সুযোগ বাড়ে। তবে বিপদের দিকগুলো বেশি গুরুত্বপূর্ণ; যথা— জনগণের সঙ্গে এমপির দূরত্ব বাড়বে, দলীয় প্রধানের একনায়কতন্ত্র তৈরি হবে, চাটুকার ও আত্মীয়রা বেশি সুযোগ পাবে, ভোটারদের হাতে প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষমতা থাকবে না, নির্বাচন হবে জটিল, ব্যয়বহুল ও প্রযুক্তিনির্ভর, স্বার্থান্বেষী দল সংসদে ঢুকে পড়তে পারে। কিছু দেশে পুরোপুরি পিআর পদ্ধতি চালু আছে। যথা নেদারল্যান্ডস, ইসরাইল, সুইডেন, নরওয়ে, ডেনমার্ক, সুইজারল্যান্ড, ফিনল্যান্ড, পোল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকাসহ বেশ কিছু উন্নত দেশ এই পদ্ধতি অনুসরণ করে। তবে এসব দেশের রাজনৈতিক পরিপক্বতা, গণতান্ত্রিক মানসিকতা ও প্রশাসনিক দক্ষতা বাংলাদেশের মতো নয়।
এমতাবস্থায় বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে করণীয় কী? আমরা চাই গণতন্ত্র আরো শক্তিশালী হোক। কিন্তু সেটির পথ পিআর নয়, বরং দলীয় গণতন্ত্র, প্রশাসনিক নিরপেক্ষতা, স্বচ্ছ নির্বাচন ব্যবস্থা এবং জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার ওপর গুরুত্ব দেওয়া উচিত। তবে এখানে একটি ‘মিশ্র পদ্ধতি’ও গ্রহণ করা যেতে পারে। যেখানে কিছু আসনে সরাসরি ভোটে, আর কিছু আসনে পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন করার বিষয়টি ভবিষ্যতে বিবেচনায় আনা যেতে পারে।
পিআর পদ্ধতির মোহে পড়ে যদি আমরা জনগণের ক্ষমতা কেড়ে নিই, তাহলে তা গণতন্ত্রের নামে নতুন এক একনায়কতন্ত্র দাঁড় করানো হবে বলে অনেকে মনে করেন। তাই তাদের দাবি, নির্বাচন হোক সরাসরি, দায়িত্বও থাকুক সরাসরি। গণতন্ত্রে জনগণই সর্বোচ্চ ক্ষমতার উত্স, তাদের প্রতিনিধি ঠিক করার অধিকারও তাদের হাতেই থাকা উচিত।
লেখক : অধ্যাপক ও গবেষক, চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও অ্যানিমেল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম
(এই লেখা লেখকের একান্ত ব্যক্তিগত অভিমত; এ সংক্রান্ত কোনো দায় দৈনিক মূলধারা বহন করবে না)