পাহাড় প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অনন্য আধার। সৃষ্টির অনন্ত ভাবনার খোরাক। কিন্তু বর্ষাকালে পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসকারী মানুষের আতঙ্কের আরেক নাম পাহাড়ধস। বাংলাদেশে বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বর্ষাকাল (আষাঢ়-শ্রাবণ) এর আগেই জ্যৈষ্ঠ মাসেও টানা বৃষ্টি দেখা যায়। প্রাকৃতিক যেমন মাটির গঠন ছাড়াও মনুষ্য সৃষ্ট বিভিন্ন কারণ পাহাড়ধস নামক আপদের অন্যতম কারণ।
আমাদের দেশে তিন পার্বত্য জেলা, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, সিলেট অঞ্চল ছাড়াও উত্তর বঙ্গের কিছু কিছু জেলায় ছোট বড় পাহাড় রয়েছে। তবে সবচেয়ে বড় পাহাড়গুলো রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানে। তিন পার্বত্য জেলা এবং চট্টগ্রাম হচ্ছে পাহাড়ধসের মূল ‘হটস্পট’। পাহাড় পৃথিবীর ভারসাম্য রক্ষার প্রধান উপাদান। বিজ্ঞানীদের মতে, পাহাড় সৃষ্টির রহস্য হচ্ছে টেকটোনিক প্লেটের সংঘর্ষ এবং ফ্রন্ট ব্লকগুলোর চলাচলের কারণে ক্রমাগত উঁচু হয়ে যাওয়া। অন্যদিকে, ভূমির নিচে থাকে বেশির ভাগ অংশ। ওপরের এ অংশ কাটার ফলে পৃথিবী ভারসাম্যহীন হয়ে যায়। নেমে আসে বিপর্যয়।
ভূতাত্ত্বিক দিক থেকে বাংলাদেশের পাহাড়ের মাটির গঠন দুর্বল প্রকৃতির, যার উপাদান হচ্ছে বেলে বা বেলে দোঁআশ। অন্যদিকে, অন্যান্য দেশের পাহাড় পাথর বা এঁটেল মাটির হওয়ায় মজবুত প্রকৃতির। টানা বা অতিবৃষ্টির কারণে পানি শোষণ করায় মাটি খুবই দুর্বল হয়ে যায় এবং পাহাড়ধসের মতো দুর্ঘটনা ঘটে।
অন্যদিকে, পৃথিবীর যে সব দেশে পাহাড় রয়েছে, সেখানে এমন বৃষ্টিপাতের কথা খুব বেশি শোনা যায় না। হলেও মাটির গঠনের কারণে খুব বেশি প্রভাব ফেলতে পারে না। অধিক জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা মেটাতে গিয়ে পাহাড় খুঁড়ে জুম চাষ করে থাকে, যা পাহাড়ধসকে ত্বরান্বিত করে। উন্নত রাষ্ট্রে এটিকে পর্যটনের সংরক্ষিত এলাকা ঘোষণা করা হয়। আমাদের আরেকটি সমস্যা হচ্ছে কারণে অকারণে বন কেটে উজাড় করা। অন্যান্য দেশে সেটি নিয়ন্ত্রিত। বিস্ময়কর বিষয় হচ্ছে, তিন পার্বত্য জেলায় কোনো সংরক্ষিত বন নেই। নদী রক্ষায় নদী শাসন নিয়ে পদক্ষেপ দৃশ্যমান হলেও পাহাড় রক্ষায় পাহাড় শাসন না হওয়ায় পাহাড় ধসের আপদ বারবার আমাদের মৃত্যুপুরীতে নিয়ে যায়।
২০০৭ সালে চট্টগ্রামে বড় ধরনের ভূসিধসের ঘটনা ঘটেছে। এতে ১২৭ জনের মৃত্যু হয়। সে থেকে বিভিন্ন সময়ে শুধু চট্টগ্রামেই প্রায় ৩০০ জন এ দুর্ঘটনায় মারা যান। চট্টগ্রামে পাহাড়ের ঢালে তৈরিকৃত ঘরে স্বল্প আয়ের মানুষ অল্প টাকার ভাড়ায় বসবাস করায় এমন দুর্ঘটনার সম্মুখীন হচ্ছে। এছাড়া ২০১৭ সালের ১৩ জুন টানা তিন দিনের বৃষ্টিতে সরকারি-বেসরকারি ১২০ জন মানুষের মৃত্যু হয়।
বিভিন্ন স্থানে বিচ্ছিন্ন বিক্ষিপ্তভাবে আরো হতাহতের ঘটনা নিয়মিত খবর। ২০০৭ সালে চট্টগ্রামে ভূমিধসের পর এর কারণ অনুসন্ধানে গঠিত কমিটি ২৮টি কারণ ও ৩৬টি সুপারিশ পর্যালোচনাপূর্বক বাস্তবায়নের কথা বলেছেন। এগুলোর মধ্যে কিছু বাস্তবায়িত হয়েছে, কিছু বাস্তবায়নাধীন রয়েছে।
পার্বত্য অঞ্চলে ভূমিধসের সঙ্গে কাপ্তাই হ্রদের পানি প্রবাহ অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। তাই এর পানি প্রবাহ এবং পরিমাণের হালনাগাদ তথ্য সংশ্লিষ্ট সকলকে অবহিতকরণ ও জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করা প্রয়োজন। পাহাড়ের মালিকানা নির্ধারণপূর্বক স্থানীয় পর্যায়ে কমিটি গঠন করলে উক্ত পাহাড়ে সংঘটিত যে কোনো ঘটনা বা পরিস্থিতির জন্য মালিককে দায়বদ্ধ করা সহজ হবে। পাহাড়ের অবস্থা, অবস্থান, প্রকৃতি, প্রেক্ষাপট, পাহাড়ের ভূমি ব্যবহার ইত্যাদি বিষয়ে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা, পরিকল্পনা প্রণয়ন পাহাড় রক্ষায় এবং পরিবেশবান্ধব উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করতে সহায়ক হবে।
পাহাড় সমৃদ্ধ ভারত, নেপাল, মায়ানমার, থাইল্যান্ড, চীনের আলোকে চলমান জাতীয় পাহাড় ব্যবস্থাপনা নীতিমালা প্রণয়ন কার্যক্রমের আওতায় ভূমির শ্রেণি বিভাগপূর্বক ভূমি ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ পাহাড়ধস রোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা সম্ভব।
এছাড়া সামাজিক বনায়ন নীতিমালা-২০০৪ অনুযায়ী বনবিভাগ কর্তৃক ভূমির গঠন অনুসারে পাহাড়ের ঢালে উপযোগী বিভিন্ন বৃক্ষ যেমন নানান জাতের বাঁশ রোপণের চলমান কার্যক্রম এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধির গতিশীলতা অন্যতম নিয়ামক হিসেবে কাজ করবে। অসাধু বনখেকো কর্তৃক অবৈধভাবে পাহাড় কাটা রোধে চলমান জরিমানা ও দণ্ডের বিধান এক্ষেত্রে সার্বিক কার্যক্রমে ভূমিকা রাখছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের দুর্যোগ ঝুঁকি কিছুটা ভৌগোলিক, ভূতাত্ত্বিক এবং কিছুটা মনুষ্য সৃষ্ট। দুর্যোগ স্বেচ্ছাসেবীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। সরকারি এবং বেসরকারি পর্যায়ে তাদের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ প্রদান এবং স্বেচ্ছাসেবীর সংখ্যা বাড়াতে উত্সাহব্যঞ্জক কার্যক্রম গ্রহণ করা যেতে পারে। আধুনিক প্রযুক্তি যেমন Land Management for disaster নামক Apps তৈরি করে তাতে ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ের তালিকা তৈরি এবং ভারী বর্ষণে পাহাড়ধস এলাকার নাগরিক উক্ত Apps এর মাধ্যমে কর্তৃপক্ষের দৃষ্টিগোচর করতে পারে। ভূমিধস বা পাহাড়ধস মনিটরিং এবং ওয়ার্নিং সিস্টেম, Debris flow ওয়ার্নিং সিস্টেম চালুকরণ অন্যতম একটি পদক্ষেপ হতে পারে। স্থানীয় কর্তৃপক্ষের কাছে বিদ্যমান যন্ত্রপাতি (Excavator, Dump truck, pay wader, Grader, chain, Dodger, Roller, Racker, Bulldodyer) এর সংখ্যা বৃদ্ধি পাহাড়ধসের মাটি দ্রুত সরিয়ে স্বাভাবিক জনজীবনের জন্য অন্যতম নিয়ামক। পানি প্রবাহ এবং ধারণক্ষমতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হওয়ায় কাপ্তাই হ্রদ ও তিন পার্বত্য জেলায় অবস্থিত গুরুত্ব বিবেচনায় নদীগুলোর নাব্যতা বৃদ্ধির জন্য খনন কার্যক্রম ব্যবস্থা জরুরি।
বিবিএস ২০২২ সালের তথ্য অনুযায়ী জাতীয়ভাবে দরিদ্রের হার ১৯.২ শতাংশ। তিন পার্বত্য জেলায় দারিদ্র্যের হার ৪৮ শতাংশের বেশি। এর মধ্যে অতিদরিদ্রের হার বান্দরবানে ২৫ শতাংশ, খাগড়াছড়িতে প্রায় ১৬ শতাংশ ও রাঙ্গামাটিতে সাড়ে ১৪ শতাংশ। ভূমিধস ও পাহাড়ি ঢল এরূপ পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জীবন দারিদ্র্যতার কষাঘাতে আরো জটিল করে তোলে। যেহেতু পাহাড়ে মাটির গুণ বিবেচনায় বিভিন্ন মৌসুমি ফল চাষে বিপ্লব ঘটেছে; তাই ফল প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প, উদ্যোক্তা প্রশিক্ষণ এবং কমিউনিটি পর্যায়ে পর্যটনের বিস্তৃতি এক্ষেত্রে আশীর্বাদস্বরূপ হতে পারে।
দেশি-বিদেশি অংশীজনদের সহায়তায় মহাপরিকল্পনা গ্রহণপূর্বক গবেষণা কার্যক্রম গতিশীল করে পদক্ষেপগুলো বাস্তবায়নই পাহাড়ধসের মতো ভয়াবহ দুর্যোগের হাত থেকে পাহাড়ি জনপদের মানুষের রক্ষাকবচ হতে পারে।
পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, জুন মাসের প্রথম পাক্ষিকে টানা বৃষ্টি ও মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে পাহাড়ধসের মতো দুর্ঘটনা বেশি হয়ে থাকে। সে লক্ষ্যে তিন পার্বত্য জেলার তথ্য অফিসসমূহ এক্ষেত্রে জনসচেতনতামূলক প্রচার কার্যক্রমের মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। প্রশাসনসহ সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন পর্যায়ের অংশীজনরা সমন্বিত কার্যক্রম করছে। জনসচেতনতাও পূর্বের চেয়ে বৃদ্ধি পাওয়ায় পাহাড়ধসের ঘটনা ঘটলেও অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুর সংখ্যা কমে আসছে।
-
লেখক : তথ্য অফিসার, জেলা তথ্য অফিস, খাগড়াছড়ি