চমকে উঠবেন না; এই নিউ ওয়্যারটি সামরিক অস্ত্রনির্ভর হবে না—মিনারেলস-নির্ভর হবে। বিশ্বের আগামী শিল্পযুদ্ধটা হচ্ছে খনিজ সম্পদের ওপর। আগামী দিনের ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রাধান্য পাচ্ছে মোবাইল ইন্ডাস্ট্রি, ইলেকট্রিক ভেহিকেল এবং সোলার এনার্জি। বাণিজ্যিক জগতে যে তারাই রাজত্ব করবে, তা প্রায় নিশ্চিত। এই তিনটি রাজত্বের সবচেয়ে বেশি যা কাঁচামাল প্রয়োজন, তার নাম ‘লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারি’। আর এই ব্যাটারি নির্মাণে প্রয়োজন খনিজ সম্পদের। এই খনিজ সম্পদের অন্য নাম ‘ক্রিটিক্যাল মিনারেলস’। আগামী দিন যে দেশের হাতে যত বেশি ক্রিটিক্যাল মিনারেলস থাকবে, সেই দেশের অর্থনীতি তত বেশি ফুলেফেঁপে উঠবে। তাই এই মিনারেলস নিয়েই হবে আগামী বিশ্বের আন্তর্জাতিক কূটনীতি জগতের নতুন কোল্ড ওয়্যার। বিশেষজ্ঞদের মতে, এ মুহূর্তের সবচেয়ে অত্যাবশ্যকীয় ও দুর্লভ চারটি খনিজ যারা জোগান দিতে পারবে, তাদের হাতেই থাকবে আগামী বিশ্বের নিয়ন্ত্রণ। এ চারটি খনিজ হলো—লিথিয়াম, কোবল্ট, নিকেল ও তামা। ইতিমধ্যেই ‘ইউনাইটেড স্টেটস ডিপার্টমেন্ট অব এনার্জি’ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ১৭টি ক্রিটিক্যাল মিনারেলসের তালিকা প্রকাশ করেছে। এর অন্যতম হলো কোবল্ট, লিথিয়াম, নিকেল, তামা, ডিসপ্রোসিয়াম, ন্যাচারাল গ্রাফাইট, ইরিডিয়াম, গালিয়াম ইত্যাদি। এই ১৭টি মিনারেলস প্রয়োজন পড়ে আর্থ ম্যাগনেট, ব্যাটারি, এলইডি, হাইড্রোজেন ইলেকট্রোলাইজার উত্পাদনে। অন্যদিকে, আমেরিকার ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা মোট ৫০টি খনিজকে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন ৩৪টি খনিজকে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
আমেরিকা-ইউক্রেন চুক্তি সই হয়েই গেল। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কিকে হোয়াইট হাউজে ডেকে নিয়ে যতই হম্বিতম্বি করুন না কেন, দিনশেষে ইউক্রেনের খনিজ সম্পদের দরজা খুলে দিতে বাধ্য করতে তিনি ইউক্রেনের সঙ্গে চুক্তিটি করেই ফেললেন। আমেরিকা ৩০০ থেকে ৫০০ বিলিয়ন ডলার অনুদান দেবে ইউক্রেন পুনর্গঠনের জন্য। বিনিময়ে কী করতে হবে ইউক্রেনকে? ইউক্রেনের খনিজ সম্পদের দরজা খুলে দিতে হবে আমেরিকার কাছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের চিহ্নিত ৩৪টি গুরুত্বপূর্ণ খনিজ সম্পদের মধ্যে ২২টিই রয়েছে ইউক্রেনে। এর মধ্যে রয়েছে শিল্প ও নির্মাণসামগ্রী, মূল্যবান ধাতু, ইস্পাত শিল্পের উপকরণ, টিভি ও বাতি নির্মাণসামগ্রী। রয়েছে উইন্ড টারবাইন ও বৈদ্যুতিক গাড়ির ব্যাটারি উপকরণ ‘ল্যান্থানাম’ ও ‘সেরিয়াম’ নামের বিরল খনিজ, পারমাণবিক বিদ্যুেকন্দ্র ও লেজার প্রযুক্তিতে প্রয়োজনীয় ‘ইরবিয়াম’ ও ‘ইট্রিয়াম’ খনিজ। বিশ্ব অর্থনীতি ফোরাম বলেছে—ইউক্রেন ভবিষ্যতে লিথিয়াম, বেরিলিয়াম, ম্যাংগানিজ, গ্যালিয়াম, জিরকোনিয়াম, গ্র্যাফাইট, অ্যাপাটাইট, ফ্লোরাইট ও নিকেলের অন্যতম সম্ভাবনাময় সরবরাহকারী দেশ হতে যাচ্ছে। ইউক্রেনের ভূতাত্ত্বিক সংস্থা জানিয়েছে, তার দেশে ইউরোপের অন্যতম বৃহত্ লিথিয়াম মজুত রয়েছে, যার পরিমাণ ৫ লাখ মেট্রিক টনের ওপর। এই খনিজ সম্পদের লোভেই রাশিয়া আক্রমণ করেছিল ইউক্রেনকে। আর এখন ইউক্রেনকে পুনর্গঠনের নামে সুযোগ বুঝে ঝাঁপিয়ে পড়ছে আমেরিকা। দুই জনের আসল দৃষ্টি তাদের খনিজ সম্পদের দিকে। ইতিমধ্যে দেশটির প্রায় এক-পঞ্চমাংশ ভূখণ্ড রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণে। ইউক্রেনের কয়লার ভান্ডার এখন রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণে। ইউক্রেনের প্রায় ৪০ শতাংশ খনিজ সম্পদের মজুত এখন রাশিয়ার দখলে। অন্যদিকে, ইউক্রেনের রাষ্ট্রীয় ভূতাত্ত্বিক সংস্থা প্রায় ১০০টি খনিজ কেন্দ্র যৌথভাবে লাইসেন্স ও উন্নয়নের জন্য প্রস্তুত করছে, যাতে এগুলোর ওপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে আমেরিকা, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও ইতালি। যদিও ইউক্রেনের খনিজ সম্পদ আমেরিকার হাতে চলে আসাটা খুব সহজ হচ্ছে না! রাশিয়া এতদিন ধরে তাহলে কী কারণে যুদ্ধ করল? যুদ্ধের সময়সীমায় ইউক্রেনের যে এলাকা রাশিয়া সর্বাগ্রে দখল করে নিয়েছে, সে অঞ্চলগুলো হলো মাটির নিচে বা পাহাড়ের অন্দরে মিনারেলস থাকা অঞ্চল। সব মিলিয়ে ইউক্রেনের প্রায় ৩৫০ বিলিয়ন ডলার মূল্যের ক্রিটিক্যাল মিনারেলস এ মুহূর্তে রয়েছে রাশিয়ার অধিকৃত এলাকায়। ইউক্রেনের বাকি অংশের খনিজ সম্পদে শানিত দৃষ্টি আমেরিকার। দৃষ্টি খানিকটা ছোট হলেও পাশেই আছে যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, ইতালি। অবশেষে জলে ভাসতে চলেছে শিলা? ইউক্রেনের খনিজ সম্পদ নিয়ে জমে উঠছে আমেরিকা-রাশিয়ার বন্ধুত্ব?
কঙ্গো বা লিবিয়া, লেবানন বা নাইজেরিয়া। ভেবে দেখেছেন, সারাক্ষণ কেন যুদ্ধ বা গৃহযুদ্ধ লেগেই থাকে? সবাই দেখে অভ্যন্তরীণ সংঘাত; দুই গোষ্ঠী বা সরকার বনাম বিদ্রোহীর ক্ষমতার লড়াই :গণতন্ত্র বনাম স্বৈরাচার। কিন্তু মুখ্য কারণটা হলো মিনারেলসের লড়াই। খনিজ সম্পদের অধিকারী এসব দেশ। তাদের প্রতি তাই শ্যেনদৃষ্টি কানাডা, চীন, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, রাশিয়া, ইউরোপসহ আন্তর্জাতিক বহু সংস্থার। কিন্তু সবার চোখের ফাঁক গলে পৃথিবীর প্রায় ৫০ শতাংশ খনিজ সম্পদের ওপর রয়েছে চীনের নিয়ন্ত্রণ। ১৯৭৮ সাল থেকে চীনের জিডিপির বৃদ্ধি গড়ে প্রায় প্রতি বছর ৯ শতাংশ। বিশ্বে অন্যতম উত্পাদনের হার হিসেবে চীন ইতিমধ্যেই নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করেছে। প্রযুক্তিগতভাবে অভাবনীয় সাফল্য দেশটিকে পৌঁছে দিয়েছে এক নতুন মাত্রায়। তার ওপর পৃথিবীর ৫০ শতাংশ ক্রিটিক্যাল মিনারেলস তাদের হাতে। এর বাইরে আফ্রিকা এবং অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশে এই খনিজের সন্ধানে চীনের কোম্পনিগুলোর মাধ্যমে ৫ হাজার ৭০০ কোটি মার্কিন ডলারের বিনিয়োগ রয়েছে চীনের। ২০২৩ সালে প্রকাশিত পরিসংখ্যান বলছে, চীনের রেয়ার আর্থ ম্যাটেরিয়ালস খনি থেকে তোলা হয়েছিল ২ লাখ ৪০ হাজার টন; যেখানে দ্বিতীয় দেশ হিসেবে আমেরিকার এই খনিজ উত্তোলনের পরিমাণ ছিল ৪৩ হাজার টন। ২০২৩ সালে চীনে মাইনিং রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৪৪ মিলিয়ন টন এবং আমেরিকার ছিল মাত্র ১ দশমিক ৮০ মিলিয়ন টন। সাম্প্রতিক অন্য এক সমীক্ষায় জানা যায়, চীনের আধিপত্যে ইতিমধ্যেই ৩ হাজার কিলোমিটার লিথিয়াম খনিজের বেল্ট রয়েছে, যেখানে মজুত রয়েছে প্রায় ২০ থেকে ৩০ মিলিয়ন টন লিথিয়াম। গ্যালিয়াম, জার্মেনিয়াম ও লিথিয়ামসহ গুরুত্বপূর্ণ রেয়ার আর্থ মিনারেলস সরবরাহের ক্ষেত্রে চীনের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে আমেরিকাসহ সব পশ্চিম দুনিয়া। এখন পর্যন্ত ক্রিটিক্যাল মিনারেলসের ক্ষেত্রে আমেরিকা সিংহভাগই আমদানিনির্ভর হয়ে আছে। আমেরিকা এগুলো চীন থেকেই আমদানি করতে বাধ্য হচ্ছে। তাই তো আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের চোখ এখন দোল খাচ্ছে পৃথিবীর নতুন নতুন খনিজ সম্পদসম্ভারের দিকে।
আমেরিকার ইউক্রেন চাই, গ্রিনল্যান্ড চাই, লিবিয়া-লেবানন চাই, কঙ্গো-নাইজেরিয়া চাই। কেননা, ঐসব দেশে মিনারেলসের সম্ভার আছে। চীন ইতিমধ্যে যা নিয়ে নিয়েছে, তা তো নিয়েই নিয়েছে; এরপর যেন হয় আমাদের আস্তানা, আমাদের ঠিকানা। চীনকে তাই পাল্লা দিতে ‘প্রয়োজনে গলার মালা রাশিয়ার দিকে’—এমনই আজকের আমেরিকা। কিন্তু তার পরও প্রশ্ন থেকে যায়! সামনের এই বিশ্ব বাণিজ্যিক যুদ্ধে মূল খেলোয়াড় কে হবে—চীন, না আমেরিকা? নাকি শক্তিশালী কয়েকটি রাষ্ট্র মিলে ক্রমেই হবে অঘোষিতভাবে পৃথিবীর শাসক? বাকিরা সব প্রজা! দুনিয়া বদলে যাচ্ছে। এই বদলের সঙ্গে তাল মেলাতে হলে মন্দির, মসজিদ, গির্জা, প্যাগোডা, হিন্দু, মুসলমান, খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ এসব থেকে এবার একটু বেরিয়ে আসতে হবে; সামনের দিকে দুই চোখ বড় করে দেখতে হবে দুনিয়াটাকে।
লেখক : কলামিস্ট